ইলু ও আলোরা

ছবি: ফ্রিপিক
ইলু যখন ছোট ছিল, মা তাকে এভাবেই গল্প শোনাত। সে এক পা-দু পা ফেলে এগোয়। পেছন থেকে আবারও ডাকতে থাকে—ইলুউউউউউউ! যেয়ো না ইলু!

কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে! বহু রকম, বহু কণ্ঠে। কারা কাঁদছে গভীর রাতে নীরব রাস্তায়?

ইলু হাঁটছে আর থেমে যাচ্ছে। উদ্ভাবন করতে চাইছে কান্নার আসল রহস্য। ভয়ের বদলে উদ্বিগ্নতা বেশি। ইলু যখন হাঁটছে, সঙ্গে চাঁদও যেন হেঁটে যাচ্ছে। বহুবার এই পথে বাড়ি যেতে কবরস্থানে লক্ষ্মীপ্যাঁচার ডাক শুনত আগে। কদিন ধরে তা–ও শুনতে পায়নি। অপেক্ষা করে—আজ হয়তো শুনতে পাবে!

এই তো কদিন আগে দূরে বস্তায় ভরে তাকে কারা যেন ফেলে দিয়েছিল। পথঘাট শুঁকতে শুঁকতে চোখের আন্দাজ করতে করতে আজ ফিরে এসেছে। মাত্র কদিনের অনুপস্থিতিতেই যেন পাল্টে গেছে সব।

কিছু পথ পার হওয়ার পর অদ্ভুত গন্ধ আসে নাকে। এ রকম গন্ধ খুব ছোটবেলায় পেয়েছিল। যেদিন তার মা মুখে ফেনা নিয়ে মরে গিয়েছিল। ইলু থমকে যায়। তার ভেতরটা কেমন যেন হয়ে ওঠে। তবে কি...মায়ের মতো ধানখেতের বিষাক্ত পানি খেয়ে অন্য কেউ মরে যাচ্ছে!

ইলু এবার কান দুটো তুমুল সচেতনতায় সজাগ করে। এগিয়ে যেতে থাকে কান্নার শব্দ এবং অদ্ভুত গন্ধ ধরে। ভয় পেলেও ভয়কে জয় করে এগোতে থাকে। পেছন থেকে কেউ একজন ডেকে ওঠে—
ইলু…? ইলু...? তুমি কি ইলু?
ইলু ছুটতে থাকে।
কণ্ঠটা আরও স্পষ্ট এবং কাছাকাছি হয়। ইলু ভাবতে থাকে...তবে কি মায়ের বলা গল্পের সেই ভয়ানক রাতের রাক্ষস পিছু নিল?

ইলু যখন ছোট ছিল, মা তাকে এভাবেই গল্প শোনাত। সে এক পা-দু পা ফেলে এগোয়। পেছন থেকে আবারও ডাকতে থাকে—ইলুউউউউউউ! যেয়ো না ইলু!
ইলু থেমে যায়। পেছন ফিরে তাকিয়ে বন্ধু কোলাব্যাঙ, কচি ঘাস ও অন্যদের কাতর অবস্থায় দেখে আহত হয়। মানুষের বন্ধুত্ব দেখেই ইলুও অনুপ্রাণিত হয়েছিল প্রাণী ও প্রকৃতির সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে। আজ সেই বন্ধুদের এ অবস্থা!

আরও পড়ুন

ইলু: তোমাদের কী হয়েছে? এমন অবস্থা কী করে হলো?
বন্ধুদ্বয়: তোমাদের মনিবেরাই এসব কারণের হোতা!
ইলু: আমার মনিব তো এমন ছিলেন না!
বন্ধুদ্বয়: জানো না ইলু...তোমার মা বারবার গর্ভধারণ করতেন; এ জন্য তোমার মনিব বিরক্ত হতেন।
ইলু: মনিবের বাড়িতে তো গরু, ছাগল এবং অন্যরাও গর্ভবতী হতেন; তারা তো তখন খুশিই হয়েছেন। আমার মায়ের বেলায় নারাজ হতেন কি না, এটা খেয়াল করিনি।
বন্ধুদ্বয়: তোমার মায়ের বারবার গর্ভধারণই ছিল তার অপরাধ। তোমাকে যারা লালন করেছে, তারাই তোমাকে রেখে এসেছিল অন্যলোক দিয়ে। তাদের শখ মিটে গেছে তোমাকে লালনের। আর তোমার মাকেও ঘাস মারা বিষ খাইয়ে মেরে ফেলেছে!

ইলুর চোখ ছলছল হয়ে ওঠে। অথচ মানুষ ও মনিবকে কত সরলভাবে বিশ্বাস করত!
ইলু: সেই গন্ধ আজ আমিও এখানে পেলাম!
বন্ধুদ্বয়: আমি ব্যাঙ ও কচি ঘাস, জোনাকি, কেঁচো সবাই অন্য জাত হয়েও তোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছি ইলু। তুমি কুকুর হলেও খুব ভালো মনের।
ইলু: আমার সব কথা ভুক ভুক শব্দ হিসেবে মানুষেরা শুনলেও ভাষা বোঝে কেউ কেউ। তেমন তোমরাও বুঝতে পারো বলেই আমার বন্ধু।
বন্ধুদ্বয়: আমাদের বন্ধুত্ব এখানেই শেষ। আমরা একটু পরেই মরে যাব। আমাদের কেউ বাঁচাতে পারবে না। বাঁচা সম্ভব নয়।

একে একে মরে যায় চোখের সামনে সবাই। বেঁচে থাকে ধানখেত। লাল নিশান পোঁতা! পড়ে আছে ঘাস মারা বিষের কৌটো—বিষাক্ত কীটনাশকের লোগোসহ পলিব্যাগ।

ইলু আরেকটু এগোয়। কান্নার শব্দ এদিক থেকেই আসছিল। ওর বুকটা ভেঙে যেতে থাকে। এলোমেলোভাবে মরে পড়ে আছে অসংখ্য জোনাক পোকা। তখনো তাদের আলোটা টিমটিমে আভা ছড়াচ্ছিল। একটু দূরেই সেই লক্ষ্মীপ্যাঁচার ফুলে ওঠা শরীর। অসংখ্য ব্যাঙ, উচুঙ্গা, কেঁচো, পিঁপড়া আর ঘাসেরাও মরে পড়ে আছে!

ইলু সামনের আখখেতের দিকে আগে যখন তাকাত, তখন মনে হতো আলোকসজ্জায় সাজিয়ে রেখেছে এ গাঁ! অসংখ্য জোনাক পোকা উড়ত-ভাসত আর আলো ছড়াত।
এখন জোনাক পোকার কোনো চিহ্ন নেই। এক-দুটো যা ছিল বা থাকবে, তা–ও কীটনাশকের থাবায় শেষ! মানুষ এখন অতি আধুনিক হতে গিয়ে, সহজে চাষাবাদ করে অধিক ফলনের লোভে ফসলের জমিনে ঘাস মারা বিষ—বিষাক্ত কীটনাশক প্রয়োগ করে সাময়িক সুবিধা পেলেও তারা নিজেরাই নিজেদের ধ্বংস প্রবলভাবে করছে প্রতিনিয়ত। জমিতে কীটনাশকমাখা পানি খেয়ে মরে যাচ্ছে উপকারী ও অপকারী সব প্রাণ!

ইলু ভাবতে থাকে আর নাকের ডগা দিয়ে মৃত জোনাকি, কেঁচো, ব্যাঙ এবং অন্যদের জড়ো করতে থাকে। ইলুর চোখের পানি টপ টপ করে পড়তে থাকে মাটির বুকজুড়ে। মাটিও তার বুকে জৈব সারের বদলে রাসায়নিক সারের ছোঁয়ায় কেমন যেন শুকনা খড়খড়ে হয়ে পড়েছে। ইলুর অগাধ শোকের কান্না দেখে মুখ ফুটে কান্না থামাতে বলার ক্ষমতাটুকুও যেন হারিয়ে ফেলেছে মাটি।