হঠাৎ ফুরিয়ে যাওয়া সময়

অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান

ঘুম ভাঙতেই মুখটা ভীষণ তেতো হয়ে গেল। প্রথমে ভাবলাম গ্যাস হয়েছে। গত রাতে কী খেয়েছিলাম? মসুর ডাল আর আলুভর্তা—ওতেই গ্যাস হলো! পরে বুঝলাম গ্যাস হয়নি, বুক বা পেটের মধ্যে তেমন অস্বস্তি নেই। তাহলে নিশ্চয়ই কোনো খারাপ খবর আছে। ইংরেজিতে একটা কথা আছে, ‘মর্নিং শোস দ্য ডে।’ আমার বেলায় কথাটা আরও বেশি সত্য। ছোটবেলা থেকে দেখছি, যেদিন খুব খারাপ কিছু হয়, সেদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে এ রকম কোনো একটা সংকেত পাই। হয় বমি ভাব হয়, নয়তো মুখটা পানসে লাগে বা চোখের পাতা লাফায়। আজ কি তবে...?

লাবণ্য ডাকছিল। এতক্ষণ টের পাইনি। সংবিৎ ফিরে ওর দিকে তাকালাম, চিন্তিত মুখে সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
কী হয়েছে? এত কী ভাবছ?
কই কিছু না তো! হঠাৎ ছোটবেলার কথা...
তোমার ফোন বাজছে কখন থেকে। টের পাওনি?
না, টের পাইনি।
এমনকি তখন যে বিকেল, সকাল নয়, তা–ও টের পাইনি। ফোন হাতে নিয়ে সবটা বুঝলাম।

অফিস থেকে এসে দুপুরে ঘুমিয়েছিলাম। হঠাৎ ঘুম ভাঙায় মাথা কাজ করছিল না। কললিস্টে ঢুকে দেখলাম একটা অচেনা নম্বর—দুবার ফোন করেছে। ঠিক চিনতে পারলাম না। ভালো করে দেখারও উপায় নেই। ফোন সম্পর্কে ভালো বুঝি না। শুভকে বললে ঠিক দেখে দেবে! বারকয়েক ডেকেও সাড়া পেলাম না। লাবণ্য বলল, ‘ওকে ডাকছ কেন? বাসায় নেই, প্রাইভেট পড়তে গেছে!’

অগত্যা ওই নম্বরে কল দিলাম। দুবার রিং হওয়ার পরে ওপাশ থেকে ভারী গলা শুনতে পেলাম। অফিস থেকে ফোন করেছে। একবার দেখা করতে বলল। এই অসময়ে দেখা করতে বলার মানে জানি। মনে করতে চাই না, ভাবতে চাই না, বুঝতে চাই না; তবু এই তো বাস্তবতা, পালাব কই! বয়স হয়েছে, হাই প্রেশার, এত ভারী বাস্তবতা ঠেলে সরানোর শক্তিই-বা কই!

আরও পড়ুন

এরপরের ঘটনা খুবই সংক্ষিপ্ত। অফিসে ডেকে নীতিনৈতিকতার ঈশপের গল্প শোনাল। আমি দায়িত্ব ছাড়লে যে দুনিয়ার কী বিরাট উপকার হয়, তা–ও বোঝাল! কিছুক্ষণের জন্য মনে হলো আমি ওখানে চাকরি করছি বলেই সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ থামছে না। রেজিগনেশন লেটারে স্বাক্ষর করাটা যেন বিরাট এক শান্তিচুক্তি! প্রতিবাদ আমি করতে পারি, শ্রমিক ইউনিয়নে গিয়ে আন্দোলন করতে পারি; তবে তাতে নগদ প্রাপ্যে কিছুটা তারতম্য হবে, এর বেশি কিছু নয়।

দুই দিন পরে অফিসে আবার যেতে হয়েছিল। এর মাঝের দুই দিন কেমন করে কাটল জানি না। সেদিন অফিস থেকে বের হওয়ার সময় আরিফের সঙ্গে দেখা। আমাকে দেখে চমকে উঠল, ‘দাদা, আপনি এই অসময়ে?’ কোনো উত্তর দিইনি, দিতে পারিনি বোধ হয়।

আরিফ যখন অফিসে প্রথম এল, তখন ওর গোঁফের রেখাও ঠিক করে ওঠেনি। প্রথম দিনই কী যেন একটা ভুল করে বিরাট বক্তৃতা শুনল। ওয়াশরুমে গিয়ে দেখি এক কোনায় বসে কাঁদছে। পাশে গিয়ে বসলাম, এরপর হাতে ধরে কাজ শিখিয়েছি। মাঝেমধ্যে মনে হতো, আমারই ছোট ভাই। সেই আরিফকে আজকে মুখ ফুটে বলতেও পারছি না, আমি চলে যাচ্ছি। সময় ফুরিয়েছে।

দুই দিন পরে গিয়ে আরও কী কী সব কাগজে স্বাক্ষর করাল, টাকাপয়সাও কিছু পেলাম। কিন্তু তাতে কী হয়? এই যে ১৭ বছর রক্ত জল করে, কৈশোর আর যৌবনের দুর্দান্ত বিকেল ওদের মেশিনের পাশে দাঁড়িয়ে কাটিয়ে দিলাম, তা এই কয়টা টাকার জন্য? একটাবার আমাকে আপন ভাবতে পারলে না! কতই-বা টাকা, ওতে মানুষের চোখের জল, হৃদয়ের রক্তক্ষরণ সব কেনা যায়? না, শুধু টাকাই নয়, সঙ্গে আরেকটা জিনিস দিয়েছিল—ধর্মগ্রন্থ!

বাড়ি ফিরে আসি। এবার আমার অখণ্ড অবসর। ধু ধু মরুভূমির মতো। সেই মরুভূমির এক প্রান্তে বসে ধর্মগ্রন্থটি খুলে ধরলাম চোখের সামনে। একটু বাদে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। হঠাৎ হঠাৎ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলতে থাকলাম, ‘হা ঈশ্বর, হা ঈশ্বর!’

শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়