চিঠি
বাসুন বারোতে (অষ্টম পর্ব)
চিঠিটি আমার একমাত্র ছেলেকে উদ্দেশ করে লেখা। এই চিঠি যখন লিখি, তখন তার বয়স ছিল ১১ বছর। এখন সে ২৫ বছরের তরুণ।
বাসুন,
রোববার সকাল শুরু হলেই বুকের ভেতর কেমন করে ওঠে। এই রে, আরও একটা সপ্তাহ শুরু হবে কাল থেকে। আরও একটা ছুটির দিন শেষ হয়ে গেল।
এখন বেলা সাড়ে ১১টা। আমরা মা-বেটা এইমাত্র সকালের নাশতা শেষ করলাম, একদম বাংলাদেশি কায়দায়। ভারী পরোটা, ডিম, আলু ভাজি ও মাংস। তুই তো একদম আমার মতোই হয়েছিস; ছোটবেলা থেকেই আমি চর্বিজাতীয় খাদ্য খেতে চাইতাম, তুইও তাই। ছুটির এই দুই দিনে আমরা তাই মনের আনন্দে নাশতা করি। কারণ, সপ্তাহের অন্য দিনগুলোতে তো তুই সিরিয়াল খেয়ে স্কুলে যাস। আমি অফিস গিয়ে চা খাই।
সময় সময় ভাবি, অন্ধবিশ্বাস কি সত্যিই কোনো অর্থ বহন করবে কোনো দিন? তাই প্রতি বেলা নামাজ শেষ করে বাংলায় কথা বলি আল্লাহর সঙ্গে। সেই শক্তির সঙ্গে, যেখানে মাথা নত করলে শান্তি পাই, অদেখা সেই প্রবল বিশ্বাস।
আজকে সকাল থেকেই আকাশ ভার হয়ে আছে। বৃষ্টি পড়বে নাকি পড়েছে জানি না। এখন আকাশ কেমন শান্ত, যেন অভিমানী এক বিকেল। অপরূপ হয়ে আছে প্রকৃতি। কোনো শব্দ নেই। আমাদের ছোট বারান্দা দিয়ে তাকালে সার সার একতালা বাড়ি আর সবুজ চোখে পড়ে। যত দূর চোখ যায় কেবল সবুজ আর বড় বড় গাছ। বিদেশ নিয়ে কেমন সব ধারণা ছিল মনের ভেতর। আর আজ সেই বিদেশেই তোকে বড় করে তুলছি। তাও আবার শুধুই আমি আর তুই, তাই না বাবু? তোর কি মনে থাকবে আমার আর তোর এই দিনগুলোর কথা? তুই যে সারা দিন ঘুরে ঘুরে আমার কাছে আসিস আর বলিস, ‘মা আই লাভ ইউ, আই লাভ ইউ সো মাচ, ডু ইউ লাভ মি? ডু ইউ?’ সারা দিন তোর মুখে একটাই কথা। কী অবাক! জানিস বাবু, আমরা কিন্তু এভাবে বড় হইনি।
জীবনের ২১-২২ বছর পর্যন্ত কতবার মাকে আমি জড়িয়ে ধরেছিলাম, সেটা গুনে বলতে পারব। কী ভীষণ ভয় পেতাম আম্মাকে। আল্লাহকে তো চোখে দেখিনি। কিন্তু আল্লাহর পরেই আমরা চার বোন আম্মাকে ভয় পেতাম। ক্লাস সিক্স, সেভেন, এইট, নাইন ও টেনের অনেকগুলো দিন কেটেছে আম্মু কখন মারবে, সেই ভয়ে। বোনদের ভেতরে আমি সবচেয়ে বেশি মার খেতাম। সেই অভিমান আজও আছে। এখনো মনে হয়, আম্মু কেন মারত আমাকে? কী এমন করতাম যে আম্মু মারত? আজ তাই কত দূরের দেশে বসে ভাবি সময় সময় মাকে। কেন ভাবি? মা তো দূরের নয়, বরং বিশ্বাস করি, ভালো চাইত বলেই মেরেছে। কিন্তু সব ভালো কি মেরে হয়?
কানাডা, আমেরিকায় বাচ্চাদের গায়ে হাত তোলা যাবে না। এটা আইন। এর কোনো ব্যত্যয় হওয়া যাবে না। নিজে সমাজকর্মী, একই সঙ্গে দোভাষীর কাজ করি; এমন ঘটনা অনেক দেখেছি। শুধু কালচারাল ব্যারিয়ারের কারণে মা–বাবারা কী সব ভুল করেন আর সারা জীবন তাঁদের খেসারত দিতে হয়।
এই দেশে বাবু, এসব ঘটনায় যাঁরা একবার না পড়বেন, তাঁরা জানবেন না এটা কত বড় গ্যাঁড়াকল। এটা কেবল সন্তানের ক্ষেত্রে নয়, অনেক নতুন আসা স্বামী-স্ত্রীর ক্ষেত্রেও বলতে শুনেছি। তাঁরা বলেছেন, ‘কী বলেন আপা, আমার স্ত্রীকে আমি শাসন করতে পারব না?’ তাঁদের বলতে ইচ্ছা করে, ‘না, আপনি পারবেন না। কে আপনাকে শাসন করার অধিকার দিয়েছে? আপনি অন্যায় করলে আপনাকে মেরে শাসন করবে কে? আপনার স্ত্রী আপনাকে শাসন করলে আপনি কি ঠিক হবেন? তাহলে আপনি মেরে শাসন করলে আপনার স্ত্রী ঠিক হবে, সেটা কে বলেছে আপনাকে?’
কিন্তু আমরাও বলতে পারি না বা বলি না। আর যখন সেই মানুষকে আইন দিয়ে শাসন করে, সেটা খুব ভয়াবহ হয়। এমন ভূরি ভূরি মানুষ (কি দেশি, কি বিদেশি) যাঁরা এই আইনের চক্রে পড়েন, গোটা জীবনে আর সোজা হতে পারেননি।
তোকে যা বলছিলাম, ছোটবেলায় পড়াশোনা করতাম, ভালো রেজাল্ট করতে হবে তাই। বই যে ভালোবেসে পড়তে হয়, শিক্ষা যে মানুষকে আরও বেশি মানবিক করে তোলে, এটা বুঝলাম তো এই সেদিন। পড়ালেখা যে কেবল টাকা কামাই করার মেশিন নয়, সে কথা কে বোঝাবে আমাদের?
কত অপচয় করে গোটা ছোটবেলা শেষ হয়ে গেল বাবু, সেই হিসাব কার কাছে ফিরে পাব আজকে?
আমাদের এক আরবি শিক্ষক ছিলেন, বাসায় এসে পড়াতেন। আম্মাকে বুবু ডাকতেন বলে আমরা ওনাকে ডাকতাম এনামুল মামা। সুরা ফাতিহা মুখস্থ না বলতে পারার জন্য একদিন এনামুল মামা বেত দিয়ে অনেক মারলেন। তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি। কী অবাক, আম্মু কিছুই বলল না! কারণ, আম্মু বিশ্বাস করত, মার না খেলে বাচ্চা মানুষ হবে না! কী অদ্ভুত দুনিয়াতে বড় হলাম আমরা?
কিন্তু ফলাফল কী হলো? ক্লাস টেন পর্যন্ত ছয়-সাতবার কোরআন খতম দেওয়ার পরও এক অক্ষর আরবিও শিখলাম না। এখনো যে নামাজ পড়ি, তা–ও সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে। একটা সুরার মানে, বানান-অর্থ ঠিক আছে কি না, কিছুই জানি না। ছোটবেলা থেকে শিখেছি, নামাজ পড়তে হয়, নইলে গুনাহ হবে। তাই নামাজ পড়ি, রোজা করি, আল্লাহকে বিশ্বাস করি।
সময় সময় ভাবি, অন্ধবিশ্বাস কি সত্যিই কোনো অর্থ বহন করবে কোনো দিন? তাই প্রতি বেলা নামাজ শেষ করে বাংলায় কথা বলি আল্লাহর সঙ্গে। সেই শক্তির সঙ্গে, যেখানে মাথা নত করলে শান্তি পাই, অদেখা সেই প্রবল বিশ্বাস।
এই বিশ্বাসই পৃথিবীর সব দেশের জাতি–ধর্ম–বর্ণনির্বিশেষে আল্লাহ, ভগবান, জেসাস। এই বিশ্বাসই ধর্ম বাবু।
তোকে অন্ধের মতো ধর্মচর্চা শেখাইনি। তোকে বলছি, তোকে বলব সারা জীবন, নিজের ভেতরের ভালো-মন্দের সঙ্গে বোঝাপড়া করে চলতে হবে। মানুষকে সম্মান করতে হবে, নিজের ভেতরের শক্তিকে চিনতে হবে, আল্লাহ সেখানেই থাকেন।
আজকে আর না বাবু, বেলা বয়ে যাচ্ছে, তোকে নিয়ে বের হব একবার। এখনো বাইরের পৃথিবী শান্ত। তুই একমনে বসে বই পড়ছিস। কী ভীষণ ভালোবাসিস তুই বই পড়তে। জানিস তো, এটা মানুষের কত বড় পাওয়া। অনেক অনেক বড় হওয়ার পরে জেনেছিলাম, বই পড়তে হয় ভালোবেসে। সেটা যে তুই ছোট থেকেই শিখে গেছিস। তাই তোকে নিয়ে আর ভাবনা কী বল? তোর কপালে অনেক অনেক আদর সোনা।
আদর বাসুন
তোর মা
১৫ এপ্রিল ২০১২
ব্রাম্পটন, অন্টারিও, কানাডা