বাসুন বারোতে (সপ্তম পর্ব)

চিঠিটি আমার একমাত্র ছেলেকে উদ্দেশ করে লেখা। এই চিঠি যখন লিখি, তখন তার বয়স ছিল ১১ বছর। আজ সে ২৫ বছরের তরুণ।

অলংকরণ: তুলি
বাসুন, ফেলে আসা দেশ নিয়ে কষ্ট পাই, নিজে কষ্ট করি; কিন্তু অন্য কারও মুখ থেকে সেটা শুনতে  চাই না, কিছুতেই না। যা আমার ভালোবাসা তার সঙ্গে সব বোঝাপড়া আমার, অন্য মানুষের কথা কেন শুনব আমি?

বাসুন,

ব্রায়ানের বয়স সত্তর বছর।
আজকে অফিস শেষে বাড়ির সামনে বড় শপিং মার্কেটে ঘুরতে গেলাম। তখনই ব্রায়ানের সঙ্গে আলাপ। ব্রায়ানের কথায় কয়েক মিনিট পরে আসছি।

আজকে তুই আমাকে খুব মজার একটা কথা বলেছিস। কথাটা মাথার ভেতরে ঘুরছে। তুই তো জানিস, আমাদের একটু চিন্তা করে চলতে হয়। কারণ, সংসার চলে একার রোজগারে। সারা দিন ডলারের হিসাব শুনেই ছোটতেই এত কথা শিখে গেছিস তাই না? ঘুরতে ঘুরতেই তুই বললি, ‘আম্মু, আমাদের নতুন বাসায় আরও বেশি খরচ হবে, প্রতিদিন মার্কেটে আসব আর ডলার পে করতে হবে, তাই না বলো?’
বলেই তুই নিজেই হেসে কুটি কুটি। কি ভীষণ মায়াকারা হচ্ছে তোর মুখটা দিন–দিন। যত বড় হচ্ছিস, পাকনা পাকনা কথা বলছিস। বললাম, ‘না রে বাবা, পয়সা নিয়ে ভেবে কোনো লাভ নেই, যার অনেক থাকে সে হিসাব করে আমার তো কিছুই নেই, খরচ করবি কি?’

ব্রায়ানের কথা বলছিলাম তোকে। পথ চলতে চলতে কত মানুষের সঙ্গে দেখা হয়। কত বিচিত্র জীবন, কত রং জীবনের। আমি অবাক হয়ে ভাবি কোথা থেকে কোথায় যায় জীবনের গতি। মাত্র ১২ দিন আগে নতুন এলাকায় এসেছি; অথচ কি ভীষণ আপন লাগছে। মনে হচ্ছে যুগ যুগ ধরে বুঝি এখানেই আছি, তাই না সোনা?

গত কয়েক দিন ধরে নোটিস করছি, একটা ফুড শপের কাছে হুইল চেয়ার মতো একটা চেয়ার নিয়ে একজন সাদা লোক বসে থাকে। ডায়েরি মতো কি যেন উল্টাতে থাকে, দেখলে খুব গরিব বা অসহায় মনে হয়, তা কিন্তু না; লোকটা একই জায়গায় বসে থাকে প্রতিদিন। আজকে যখন তুই বললি মা বার্গার খাব, তখনই ভাবলাম আজকেই আলাপ করব লোকটার সঙ্গে।

ব্রায়ানের মূল বাড়ি আয়ারল্যান্ডে। পাঁচ-ছয় বছর বয়সে ওর বাবা-মা কানাডায় পাড়ি জমিয়েছিল ভালো জীবনের আশায়। ব্রায়ান খুব সফল একজন প্রকৌশলী ছিল। ব্যক্তিগত জীবনে কানাডিয়ান সরকারের বড় বড় পদে জব করেছে অনেক বছর। কিন্তু কেন এমন করে মার্কেটের ভেতরে বসে থাকে ও?

আরও পড়ুন

অবাক হয়ে গেলাম সেই কথা জেনে। একটা বড় ধরনের গাড়ি দুর্ঘটনায় ব্রায়ান সব হারিয়েছে। ওর ব্যকবোন, হাত–পায়ের বেশ কিছু অংশ ভেঙে গেছে। ব্রায়ান আজকে চলতশক্তিহীন মানুষ। ৩০ বছর আগে ওর বউ ওকে ছেড়ে গেছে। কারণ, বউয়ের অভ্যাস ছিল মদ খাওয়া আর শপিং করা। ব্রায়ান সেই পয়সা জোগাতে পারেনি। তাই বউ ওকে ছেড়ে অন্য একজনের সঙ্গে চলে গেছে। ব্রায়ান আজকে একা, নিঃসঙ্গ। ব্রায়ান জানায়, ও পরে আর বিয়েও করেনি।

এই লেখা যখন লিখছি তখন তোর আর আমার এই ছোট্ট সংসারে সন্ধ্যার আধার নেমে এসেছে বাসুন। আমি মাগরিবের নামাজ পড়ার সময় ভাবছিলাম আজকে লিখব তোকে।

বাংলাদেশের ৯৯ শতাংশ মেয়ে এখনো বিশ্বাস করে স্বামীর ঘর করা তাদের একমাত্র কাজ। সেই মেয়ে যত বড় কর্মকর্তা বা যত বড়লোকের মেয়েই হোক না কেন, এক জীবনে স্বামী না থাকা মানে তাদের জীবন অসম্পূর্ণ। বাংলাদেশের মেয়েরা আজও মন থেকে বিশ্বাস করে স্বামীকে বাঁচিয়ে রাখতে বা স্বামীর মান রাখতে গিয়ে যদি মিথ্যা বলতে হয়, তাতেও কোনো অপরাধ নেই। এমন কি উপরে আল্লাহ নিচে স্বামী, যেভাবে পারো স্বামীকে খুশি রাখতে হবে।

বছর দশেক আগে হবে, বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত সাহিত্যিক মুখের সামনে বলেছিল, ‘শোন লুনা, তসলিমা নাসরিন মেলা বড় বড় কথা বলে; কারণ, তাঁকে কোনো স্বামীর ভাত খেতে হয় না। একজন স্বামীকে মেইনটেইন করে তসলিমা যদি কথাগুলো বলতে পারত, তাহলে বুঝতাম সে বাপের বেটি।’

সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম সেই সাহিত্যিক মহিলা কতখানি চাপের মুখে থাকলে তাঁর মুখ দিয়ে এমন কথা বের হয়। কিন্তু আমার আজকের আলোচনা সেটা না, বাসুন।

ব্রায়ানের সঙ্গে কথা বলতে বলতে বারবারই ওর মুখ থেকে বউ লুরেনের কথা শুনছিলাম। লুরেন অ্যালকোহোলিক ছিল আর দামি জিনিস কিনতে চাইত। আমি তখন ব্রায়ানকে জিজ্ঞেস করি, ‘তুমি কি সাউথ এশিয়ান মেয়েদের কথা জানো? বউ হিসেবে বা লাইফ পার্টনার হিসেবে তারা কেমন তুমি শুনেছ কোনো দিন?’ ব্রায়ান এরপর যা বলল, তাতে আর কথা এগোয় না।
ব্রায়ান বলে, ‘ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, রুমানা মাঞ্জু্র, দ্যাট ইয়াং লেডি ফ্রম ইউর কান্ট্রি, রাইট? দ্য স্টোরি ইজ ট্রু, কারেক্ট।’
ব্রায়ানকে বলি, ‘তুমি কি জানো রুমানার স্বামী মারা গেছে এবং রুমানা ওর স্বামীকে মন থেকে মাফ করে দিয়েছে।’ ব্রায়ান এবার নড়ে বসে। বলে, ‘হাউ ইট পসিবল?’

বাসুন, ফেলে আসা দেশ নিয়ে কষ্ট পাই, নিজে কষ্ট করি; কিন্তু অন্য কারও মুখ থেকে সেটা শুনতে  চাই না, কিছুতেই না। যা আমার ভালোবাসা তার সঙ্গে সব বোঝাপড়া আমার, অন্য মানুষের কথা কেন শুনব আমি? কিন্তু রুমানা কি করে থাকেন কানাডায়? কত কত মানুষের প্রশ্নের উত্তর ওকে দিতে হয়? আজকে সারা বিকেল ব্রায়ানের সঙ্গে কথা বলে বার বার রুমানা মঞ্জুরের কথা আর গল্প মনে পড়ছে বাবু। আবার লিখব তোকে।

আদর বাসুন
তোর মা
৩ এপ্রিল ২০১২

ব্রাম্পটন, অন্টারিও, কানাডা