ঘা (দ্বিতীয় পর্ব)

ছবি: এআই/বন্ধুসভা
হঠাৎ দারোয়ান এসে একটা চিঠি দিয়ে গেল। দেখি আমার নামে লেখা, তবে ঠিক চিঠি না। একটা চিরকুট একটা খামে ভরে পাঠিয়েছে।

মেয়েটা একদৃষ্টিতে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে কোনো কিছুর জন্য অপেক্ষা করছে, কিছুটা হীনম্মন্যতা আর সংকোচ নিয়ে। কিন্তু কিসের? মেয়েটা কি আগে থেকেই বুঝতে পারছে যে আমি তার কাছে কিছু জানতে চাইব? কিন্তু সেটাই-বা ও আগে থেকে বুঝবে কী করে?
‘আচ্ছা, তুমি কিছু মনে না করলে একটা কথা জিজ্ঞেস করব?’
‘জে, জিগান।’
‘তোমার যে হাতে–পায়ে ঘা, সেটা তো এমন কিছু না, যার জন্য এই ভোররাতে ছুটে আসতে হবে। কেন জানি মনে হচ্ছে অন্য কোনো কারণ আছে!’
‘জে, অন্য কারণ আছে।’

এরপর আমার আর কিছু বলার থাকে না। মেয়েটা হয়তো সেই কারণ প্রকাশ করতে চাইছে না বা আমার কাছে বলতে চাইছে না। এখন ওর কাছে কারণটা জানতে চাওয়া রীতিমতো অভদ্রতা। মেয়েটা কিছুক্ষণ ঝিম ধরে বসে রইল। আমি ততক্ষণে কৌতূহল দমন করার চেষ্টা করছি। মেয়েটা আর কিছু বলবে বলে মনে হচ্ছে না। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াতে যাব, তখনই মেয়েটা আবার মুখ খুলল।
‘আফনারে আমার ভাল্লাগছে। আফনারে মনে লয় কওন যায়।’
‘কী বলতে চাও?’
মেয়েটা খুব সাবধানে চারদিকটা একবার দেখে নিল। না, কেউ নেই। তার মা ছিল, তাকেও একটু আগে বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছি। সব দিক থেকে নিশ্চিত হয়েই মেয়েটা আমার দিকে আরেকটু সরে এল, গলাটা যথাসম্ভব নিচু করে বলল, ‘একখান গফ আফনারে আমি শুনাইবার পারি, তয় আল্লার কসম কাইটা কওন লাগব আফনে এই কথা কাওরে কইতে পারবেন না।’
‘ঠিক আছে, কাউকে বলব না। তুমি বলো।’
‘আমার আম্মায় যে আফনারে নিয়া খারাপ কথা কইয়া গেল, হেইডা এমনি এমনি কয় নাই। কারণ আছে। এর আগে আমি পেট বাঁধাইয়া ফালাইছিলাম, তারপরের তন আম্মায় এই সব কয়।’

কথা শুনে চমকে গেলাম। আর যে আশঙ্কাটা এতক্ষণে একবারের জন্যও মাথায় আসেনি, সেই আশঙ্কাটা জ্বলজ্বল করতে জ্বলতে লাগল চোখের সামনে। তবে...তবে কি এরা…? এ রকম জোর করে বাড়িতে ঢুকে খদ্দের খোঁজে?
‘কী চিন্তা করবার লাগছেন? আমারে খারাপ মাইয়া ভাইবা ডরাইতাছেন তাই না? ডরাইয়েন না। আমি খারাপ মাইয়া না। খারাপ মাইয়াগো পেট বান্ধে না, বান্ধলেও কয় না। পেট বান্ধে ভালো মাইয়ার। একবার না, বারবার বান্ধে।’
মানে? মেয়েটা কী বলতে চায়? তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গর্ভে সন্তান এসেছিল? মানে রেপ? মেয়েটা এত রাতে তার ধর্ষণের ঘটনা শোনাতে এসেছে? কিন্তু কেন? আমার কাছে কেন?
‘তোমার কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছি না। তুমি কি কাইন্ডলি একটু সোজা ভাষায় কথা বলবা?’
‘আমি যেই বাড়িতে কাম করি, সেইখানে আছি মেলা ছোট বয়স থেইক্যা। সাব খুব ভালা মানুষ। আমারে খুব সোহাগ করেন, আফাও তাই। তাগো বিয়ার মেলাদিন হইয়া গেছিল, তয় বাচ্চাকাচ্চা হয় না। মেলা ডাক্তার কবিরাজ দেখাইল, দ্যাশ-বিদেশের কত কত ডাক্তার দেখাইল, কিন্তু কোনো কাম হয় না। দুইজনের খালি ঝগড়া লাগে, পরভাতে উইঠাই দেখি ঝগড়া শুরু করছে, রাইতে ঘুমাইতে যাইতেও সেই আওয়াজ কানে আহে। তাগো রে জীবন খান যে একখান পোলা কি মাইয়ার লাগি এক্কেরে তচনচ হইয়া যাইতাছে, তা বোঝোন যায়। আমি দূর থেইক্যা তাগো এই সব কাজকর্ম দেহি। দেইখা খারাপ লাগে, কিন্তু যার কপালে যেইডা লেইখ্যা রাখছে আল্লায়, তা মাড়াইব ক্যাডা! আম্মায় তহন আমার লগে থাকতে না, আমি একাই থাকতাম। তাগো দুক্ষে মাঝেমইধ্যে আমিও কয়েক ফোঁটা চক্ষের জল ফেলতাম। এমনেই চলতে আছিল। একদিন রাইতে আফা আমারে ডাইকা পাঠাইল। ডাইকা কয়, সালমা, তুই আমার বইন। তুই আমার একটা উফকার কইরা দে বইন। কইয়া পেরায় পা চাপাইয়া ধরছে। আমি লাজে বাঁচি না। হেয় মোর মালকিন, হেয় পায়ে ধরলে আমার গুনা হইব। তাড়াতাড়ি কইরা পা–ও ছাড়াইয়া কই আফনের কী করন লাগব কন আফা। আমি আমার জান সুদ্ধা খুইলা দিমু। তহন কি জানতাম হেয় কী চাইতে যাইতাছে! তারপর হেয় ঘরের দরজা খিল তুইলা দিল। তারপর মিনমিনাইয়া কানের গোড়ে আইসা কয়, তুই আমারে একটা বাচ্চা দে।’
‘মানে? তোমার বাচ্চা সে দত্তক নিতে চায়?’

আরও পড়ুন

মেয়েটা আমার কথা শুনে মুচকি হাসল। তারপর আবার বলতে শুরু করল। ‘হেইডা হইলে তো হইতোই। তয় আমার তো বিয়া হয় নাই, বাচ্চাও নাই। সে দত্তক নিব কারে? সে চায় তার সোয়ামির বাচ্চা আমার পেটের তন বাইর হোক।’
‘মানে? সে চায় তুমি তার স্বামীর সঙ্গে…।
‘জে, ঐডাই। পেত্তমে আমি কিছুতেই রাজি হই নাই। হেয় আমার বড় ভাইয়ের মতন। হের লগে...ছি ছি। ভাবতেও ঘেন্না লাগে। কিন্তু আমি রাজি না হইলাম যখন, তখন আমারে ডর দেখাইল।’
‘ডর? কিসের ডর?’
মেয়েটা এবারও আমার কথা শুনে হাসল। ‘গরিব মাইনষ্যের একটাই ডর, জানের ডর! হেইডাই দেখাইল। তাগো কথা না শুনলে জানে মারব। বাঁইচা থাকনের খায়েস ছুটাইতে পারি নাই ডাকতার সাব। আম্মায় দ্যাশের বাড়িতে আশা কইরা থাকে, আমি টাকা পাঠামু। আব্বা খাটের ওপরে বান্ধা পইড়া তহন, এখন না হয় গোল্লায় গেছে। তাগে ফালাইয়া আগে আগে আমি ক্যামনে মরি!’
‘তাহলে তুমি জীবন বাঁচানোর ভয়ে রাজি হলে তাই তো?’
‘জে, রাজি হইলাম। নিজের লাজশরমের মাথা খাইয়া রাজি হইলাম। কিন্তু আল্লাপাক নারাজ। পেত্তমবার তিন মাসের ভিত্রে বাচ্চায় মরল। আমি ভাবলাম, হেয় মইরা আমারে বাঁচাইল, কিন্তু না। আমারে আবার ঠেইলা দিল হেই জাহান্নামে। এবার আর আল্লায় নারাজি দেখাইল না। পাক্কা দশ মাসের পর জন্মাইলাম একটা ফুটফুইটা পোলা।’

কথা শেষ করতে পারে না মেয়েটা। চোখের চারদিকে জমানো জল গড়িয়ে গাল বেয়ে নিচে নামে। টিস্যু বক্স থেকে কয়েকটা টিস্যু নিয়ে মেয়েটার দিকে এগিয়ে দিই। সে চোখের জল মোছে। তারপর আবার বলে, ‘সেই শ্যাষ দেহা, তারপর আর পোলাডারে একটাবারের জন্যও দেখতে পাই নাই। পোলাডারে খাওয়াতেও পারি নাই, হুনছি কৌটার দুধ কিইনা খাওয়ায়। আমারে এখন নিচের তলায় কাম করতে দেয়, থাকোনের জায়গাও নিচতলায়। ওপরতলায় তাগোরে পোলা থাহে!’
বলেই মেয়েটা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। কিন্তু সেই হাসি দেখে আমার ভয় হয়। কী বিশ্রী হাসি, কী কুৎসিত!
‘কিন্তু তারপরের থন আরেক ঝামেলা হইল। আফায় কইছিল পোলাপাইনের জন্য খালি একবার...। কিন্তু পুরুষের জাত তো! একবার মাইয়া মাইনষ্যের শইলের গন্ধ পাইলে এত সহজে ছাড়বার চায়! ওর পরের থন শুয়োরের বাচ্চায় রোজ রাইতে আইতে লাগল। হাতে একটা বেলেড নিয়া আহে, কিছু কইলে গলা ছিলা ফালাইব আমার। বেলেডের ভয়ে আমি অবশ হইয়া থাকি। পোলাডাও রাইতে কান্দে। কান্দনের শব্দ নিচতলায়ও আহে। শুয়োরের বাচ্চার ঐ চিঁ চিঁ শব্দের আওয়াজে ঘুম হয় না। তাই আম্মারে মিছা কইয়া ঘুইরা বেড়ায়।’
‘যদি কিছু মনে না করো, তোমার মুনিবের নামটা বলা যাবে?’
‘কী করবেন আফনে? কিচ্ছু করতে পারবেন না। কিচ্ছু না। তয় নাম আমি আফনারে কমু। দেন একখান কাগজ আর কলম দেন। ছোটবেলার লেহাপড়া যা শিখছিলাম, তা দেহাইয়া দিই আজ। হা হা। দেন দেন কাগজ, কলম দেন।’

একটা কাগজ আর কলম এগিয়ে দিলাম। মেয়েটা একটা কাগজে একটা নাম আর ঠিকানা লিখল। তারপর সেটা ভাঁজ করে আমার হাতে দিয়ে বলল, ‘আল্লাহর কসম কাটেন যে আপনে এইটা বিষ্যুদবারের পরে খুলবেন।’
‘কেন?’
‘অত কথা কইতে পারুম না। আফনে কথা দিছেন সেইটা রাইখেন। আইজ যাই আমি।’ বলে হুড়মুড় করে বেরিয়ে চলে গেল। ভেতর থেকে আমি শুনলাম তার মা পেছন–পেছন কী কী সব বলে চিৎকার করতে করতে যাচ্ছে। আমার আর কিছু কানে গেল না।

চিঠিটার প্রেরক কে, তা বুঝতে খুব বেশি সময় লাগে না। সকালের খবরের কাগজের হেডলাইনটা স্পষ্ট করে আবারও চোখের সামনে ভেসে উঠতে দেখি—

পরদিন সকালে শারমিন এল। আমি তাকে সবটা খুলে বললাম। ও প্রথমে কিছুতেই আমার কথা বিশ্বাস করল না। তারপর যখন কাগজটা দেখালাম, তখন মেয়েটার কষ্টে ওর প্রায় কেঁদে ফেলার মতো অবস্থা। এর মধ্যে কয়েকটা দিন কেটে গেল। মানুষ ধীরে ধীরে সব ভুলে যায়, এমনকি পৃথিবীর সবচেয়ে গাঢ় দুঃখটাও। আমাদেরও তাই হলো।

সেদিন শুক্রবার। বিকেলের দিকে বাগানে বসে শারমিনের সঙ্গে গল্প করছিলাম। হঠাৎ দারোয়ান এসে একটা চিঠি দিয়ে গেল। দেখি আমার নামে লেখা, তবে ঠিক চিঠি না। একটা চিরকুট একটা খামে ভরে পাঠিয়েছে। সাতপাঁচ না ভেবে চিরকুটটা খুললাম।
‘ডাকতার সাব, আমার জিনিস আমি লইয়া গেছি। তারে এরা চুরি কয় ক্যান?’

চিঠিটার প্রেরক কে, তা বুঝতে খুব বেশি সময় লাগে না। সকালের খবরের কাগজের হেডলাইনটা স্পষ্ট করে আবারও চোখের সামনে ভেসে উঠতে দেখি—
‘বিশিষ্ট লেখক আলফাজ আহমেদের বাসা থেকে তার শিশুসন্তান চুরি। গৃহকর্মী নিখোঁজ।’

একটা বড় চাপা দীর্ঘশ্বাস বুকের ভেতর থেকে মোচড় দিয়ে বেরিয়ে আসে। একটা চুরির খবর এতটা স্বস্তির!
(সমাপ্ত!)

শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়