ব্রাম স্টোকারের ‘ড্রাকুলা’ ১৮৯৭ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। এটি কেবল একটি ভৌতিক উপন্যাস নয়, গথিক হরর সাহিত্যের এক অমর ক্ল্যাসিক এবং আধুনিক ভ্যাম্পায়ার মিথের ভিত্তি। উপন্যাসটি প্রকাশের ১২৫ বছরেরও বেশি সময় পরও এর আবেদন এতটুকু কমেনি। বাংলায় অনুবাদ করেন লুৎফুল কায়সার।
‘ড্রাকুলা’র সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো এর আখ্যানশৈলী। এটি কোনো একক লেখকের বর্ণনায় লেখা নয়, বরং বিভিন্ন চরিত্রের ব্যক্তিগত ডায়েরি এন্ট্রি, চিঠি, টেলিগ্রাম, সংবাদপত্রের প্রতিবেদন এবং ফনোগ্রাফ রেকর্ডের মাধ্যমে তৈরি একটি আখ্যানের জালিকা। এই পদ্ধতি পাঠককে গল্পের কেন্দ্রে নিয়ে আসে। জোনাথন হারকার বা ড. সেওয়ার্ডের ব্যক্তিগত ডায়েরি পড়ার সময় পাঠক সরাসরি তাঁদের আতঙ্ক, সন্দেহ এবং মানসিক অবস্থার অংশীদার হন। একাধিক দৃষ্টিকোণ থেকে গল্প জানার ফলে ড্রাকুলার রহস্যময় চরিত্র এবং তার ভয় আরও বেশি বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে।
কিছু পাঠকের কাছে গল্পের গতি কিছুটা ধীর এবং বিভিন্ন উৎসের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করার মধ্যে কষ্টকর মনে হতে পারে। তবে মনোযোগ সহকারে পড়লে তেমনটা মনেই হবে না।
ড্রাকুলা হলো ভিক্টোরিয়ান নৈতিকতার বিপরীতে এক নিষিদ্ধ, আদিম এবং বলপূর্বক যৌনতার প্রতীক। লুসি বা মিনার ওপর ড্রাকুলার প্রভাবকে নারীদের দমন করা যৌন আকাঙ্ক্ষা বা বিশুদ্ধতা হারানোর ভয় হিসেবে দেখা যায়। ড্রাকুলার শিকার হওয়া নারীরা যেন সমাজের বেঁধে দেওয়া বিশুদ্ধতার ধারণা থেকে মুক্তি খুঁজছে।
কাউন্ট ড্রাকুলা প্রতিনিধিত্ব করে সামন্ততান্ত্রিক ইউরোপের প্রাচীন কুসংস্কারাচ্ছন্ন বর্বরতাকে। অন্যদিকে ভ্যান হেলসিং এবং তাঁর দল প্রতিনিধিত্ব করে যুক্তিবাদী, বিজ্ঞানভিত্তিক আধুনিক পশ্চিমা সভ্যতাকে। এই লড়াইটি মূলত বিজ্ঞান, যুক্তি ও আধ্যাত্মিক বিশ্বাস দিয়ে অন্ধকারের শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই।
উপন্যাসে ড্রাকুলা সচরাচর পর্দার আড়ালেই থাকে। তাঁকে সরাসরি খুব কমই দেখা যায়, যা তাঁর চারপাশে এক গভীর রহস্যের পরিবেশ তৈরি করে। তিনি এক শক্তিশালী, বুদ্ধিমান এবং কৌশলগত ভিলেন। তিনি শুধু রক্তচোষা এক প্রাণী নন, বরং একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব—যাঁর রয়েছে প্রাচীন জ্ঞান এবং এক রহস্যময় আকর্ষণ। উপন্যাসের শেষে তাঁর প্রতিহত হওয়া দেখায় যে সম্মিলিত মানবতা, বিশ্বাস এবং বৈজ্ঞানিক যুক্তি দিয়েও অন্ধকারের রাজত্বকে পরাজিত করা সম্ভব।
অনেক আধুনিক পাঠক ড্রাকুলার গল্পটি ইতিমধ্যেই হাজার হাজার চলচ্চিত্র ও অন্যান্য ভ্যাম্পায়ার ফিকশনের মাধ্যমে জেনে ফেলেছেন। ফলে মূল বইটি পড়ার সময় এর ভয় কিছুটা কমে যেতে পারে। আমি নিজেও ড্রাকুলা নিয়ে বেশ কিছু সিনেমা দেখেছি। ড্রাকুলার প্রতি আমার আলাদা একটা আগ্রহ, যার কারণে বইটি পড়ি।
উপন্যাসটি লেখকের সময়ের সামাজিক ও নৈতিক আলোচনার এক শক্তিশালী প্রতিফলন, যা সাহিত্যের ইতিহাসের দৃষ্টিকোণ থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
কাদের জন্য এই বইটি?
‘ড্রাকুলা’ তাদের জন্য অবশ্যপাঠ্য যারা ক্ল্যাসিক সাহিত্য, হরর বা ভ্যাম্পায়ার মিথের জন্মরহস্য জানতে আগ্রহী। আপনি যদি কেবল অ্যাকশন–নির্ভর হরর খুঁজছেন, তবে এই বইয়ের গতি আপনার কাছে ধীর মনে হতে পারে। কিন্তু যারা ধাপে ধাপে গড়ে ওঠা একটি ভয়ংকর, মনস্তাত্ত্বিক এবং সাহিত্যিক অভিজ্ঞতা চান, তাঁদের জন্য ব্রাম স্টোকারের ‘ড্রাকুলা’ এক অসাধারণ যাত্রা।
সভাপতি, নারায়ণগঞ্জ বন্ধুসভা