হুমায়ূন আহমেদ—বাংলা সাহিত্যের এক জাদুকরি নাম। জন্মেছিলেন ১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর, নেত্রকোনায় হেমন্তের আলোয়। সাহিত্য, নাটক, চলচ্চিত্র—সবখানেই তিনি রেখে গেছেন অমোঘ ছাপ। হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন আমার প্রথম পাঠ-অভিজ্ঞতার আবেগ, প্রথম ভালো লাগার রোমাঞ্চ। আমার পড়া প্রথম উপন্যাস ছিল তাঁর ‘অপেক্ষা’, সময়টা ২০১৭ সাল, তখন ক্লাস নাইনে পড়ি।
আমার চাচ্চুর প্রিয় লেখক ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। ছোটবেলা থেকেই তাঁর নাম শুনে বড় হয়েছি, কিন্তু হাতে তুলে পড়ার অভিজ্ঞতা এসেছিল ‘অপেক্ষা’ দিয়েই। সেই বই যেন আমার পাঠজীবনের এক নতুন দরজা খুলে দিয়েছিল।
‘অপেক্ষা’ উপন্যাসের গল্পের ভেতর প্রথমবার বুঝেছিলাম—সাহিত্য মানুষের ভেতরের অনুভব, হারিয়ে যাওয়া সম্পর্ক, অনুচ্চারিত কষ্টেরও এক আয়না। উপন্যাসটির প্রধান চরিত্র মিতু, ইমন, আর সুপ্রভা—তিনজনই এক অদ্ভুত আবেগের ভেতর দিয়ে চলেছে। কিন্তু আমার প্রিয় চরিত্র ছিল সুপ্রভা।
সুপ্রভা ছিল প্রাণবন্ত, হাসিখুশি, জীবনের প্রতি তীব্র ভালোবাসায় ভরা এক মেয়ে। ওর মোজো খাওয়ার নেশা, সরল হাসি, আর সহজভাবে পৃথিবীকে দেখা—এসব আমাকে গভীরভাবে ছুঁয়ে গিয়েছিল। মজার ব্যাপার হলো, ‘অপেক্ষা’ পড়ার পর থেকেই আমারও মোজো খাওয়ার নেশা লেগে যায়! মনে হতো, যেন সুপ্রভা আমার ভেতরে বেঁচে আছে, ওর মতো করে পৃথিবীকে দেখতে চাই।
কিন্তু হঠাৎই গল্পের এক জায়গায় সুপ্রভা হারিয়ে যায়, চিরতরে। ওর মৃত্যু এতটা অপ্রত্যাশিত আর নিঃশব্দ ছিল যে বই পড়ার সময় সত্যিই কেঁদে ফেলেছিলাম। তখন হয়তো বয়স কম ছিল, কিন্তু সেই কান্নাটা ছিল একেবারে নিখাদ, একজন পাঠকের হৃদয়ের ভেতর থেকে উঠে আসা কান্না।
হুমায়ূন আহমেদের গল্পে মৃত্যু কখনো ভয়ানক নয়—এটা যেন জীবনেরই একটা অংশ। অপেক্ষায়ও তেমনটাই। সুপ্রভার চলে যাওয়া গল্পটাকে শূন্য করে দেয়, কিন্তু সেই শূন্যতাই মিতু ও ইমনের মধ্যে একটা মানবিক আলো জ্বেলে দেয়।
উপন্যাসে মিতু ও ইমনের সম্পর্কের ভেতর দিয়ে হুমায়ূন আহমেদ দেখিয়েছেন অপেক্ষা, হারানো আর ভালোবাসার এক সূক্ষ্ম সংলগ্নতা। তাঁদের সম্পর্ক যেন নদীর দুই তীর—মিলিত হয় না, তবু একই স্রোতের ভেতর দিয়ে বয়ে চলে।
আর আছে সুপ্রভার মামা—একটি ছোট চরিত্র, কিন্তু প্রতীকীভাবে অনেক বড়। তিনি যেন সমাজের সেই মানুষ, যারা কষ্টে বেঁচে থেকেও অন্যের প্রতি যত্নশীল থেকে যায়। আর সুপ্রভার মা—যিনি স্বামীর অপেক্ষায় থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে পড়েন, তিনি উপন্যাসটির নামেরই প্রতিচ্ছবি। অপেক্ষা এখানে জীবনেরই সংজ্ঞা।
হুমায়ূন আহমেদের লেখার জাদু হলো, তিনি জীবনের সবচেয়ে সাধারণ মুহূর্তগুলোকে অসাধারণ করে তুলতে পারেন। অপেক্ষায় তিনি এমনভাবে প্রেম, শোক আর সময়ের প্রবাহকে মিশিয়ে দিয়েছেন, যেন প্রতিটি চরিত্র বাস্তবের কোনো মানুষ। পাঠকের মনে তাদের জায়গা হয় দীর্ঘদিনের জন্য।
‘অপেক্ষা’ উপন্যাস আমার কৈশোরের একটা অনুভূতি, এক বুক কান্না আর ভালোবাসার পাঠ। সুপ্রভা হয়তো গল্পে নেই, কিন্তু ওর হাসি, ওর গান, ওর সরলতা, ওর মোজো খাওয়ার সেই মুহূর্তগুলো এখনো আমার মনের ভেতর বেঁচে আছে।
প্রশিক্ষক, বাংলাদেশ তরুণ কলাম লেখক ফোরাম