নুহাশপল্লীতে স্মৃতিমুখর এক দিন

নুহাশপল্লীর মূল ফটক দিয়ে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ল হুমায়ূন আহমেদের ম্যুরালফাইল ছবি

বর্ষা ছিল মানুষটার ভীষণ পছন্দের। এতটাই পছন্দের যে যখন ক্লাস এইটে পড়েন, প্রিয় ঋতুর প্রশ্নে স্যারের সঙ্গে তর্কে জড়িয়েছিলেন। কী ঘটেছিল? বাংলা স্যার একদিন রচনা লেখার নির্দেশ দিলেন। বললেন, রচনা লিখে আনতে। বিষয় প্রিয় ঋতু। লেখার মধ্যে চার-পাঁচটা কোটেশন থাকতে হবে। বানান ভুল করলে আছে শাস্তি। প্রতিটা ভুল বানানের জন্য পাঁচবার কানে ধরে ওঠবস করতে হবে।

স্যারের নির্দেশমতো রচনা যদিও লিখলেন, কিন্তু রচনা পড়ে স্যার সন্তুষ্ট হলেন না, বরং রেগে গেলেন। বললেন, ‘কী লিখেছিস ছাগলের মতো! বর্ষা প্রিয় ঋতু? লিখবি ঋতুরাজ বসন্ত। তাহলে না নাম্বার পাবি। ফুলের সৌরভ, পাখির কূজন। বর্ষায় ফুল ফোটে না। পাখিও ডাকে না।’ জবাবে মানুষটা বলেন, ‘স্যার, বর্ষাই আমার প্রিয়। আপনার প্রিয় আপনার মধ্যে থাক। আমার নাম্বার বেশি পেতে হবে না।’

হুমায়ূন আহমেদের ম্যুরালের সঙ্গে লেখক।

প্রিয় ঋতু বর্ষা নিয়ে স্যারের সামনে সাহসের সঙ্গে নিজের বক্তব্য তুলে ধরা মানুষটা আর কেউ নন, নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। কেবল এ ঘটনাই নয়, বর্ষাপ্রেমী হুমায়ূনের বর্ষা উদ্‌যাপনের উজ্জ্বল সাক্ষী নুহাশপল্লীর ‘বৃষ্টিবিলাস’। ‘বনুর গল্প’ নাটকের শুটিংয়ে বাসে যাওয়ার সময় অভিনেতা ডা. এজাজুল ইসলামকে স্বপ্নের বাগানবাড়ির যে দায়িত্ব তিনি দিয়েছিলেন। আজ সেই স্বপ্নের বাস্তব রূপ নুহাশপল্লী, যা হুমায়ূন ভক্তদের কাছে স্বর্গপুরী।

হুমায়ূন পড়তে পছন্দ করি কিংবা হুমায়ূনপ্রেমী হওয়ার কারণে নয়, বরং বলা ভালো পড়াশোনার নৈমিত্তিক ব্যস্ততা থেকে ছুটি নিতেই বৃষ্টি উদ্‌যাপন করতে নুহাশপল্লীতে যাওয়া।

তখন কর্মব্যস্ত ঢাকার ভোরের নীরবতা মিলিয়ে যেতে শুরু করেছে। গাড়ি যাত্রা শুরু করল গাজীপুর সদর উপজেলার পিরুজালী গ্রামের উদ্দেশে। নিবিড় সবুজ গজারি বন, কলকারখানা, শিকদার বাজারের জনারণ্য পেরিয়ে লাল মাটির রাস্তা দিয়ে গাড়ি ছুটে গেল প্রকৃতির মাঝে।

নুহাশপল্লীর মূল ফটক দিয়ে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ল হুমায়ূন আহমেদের ম্যুরাল। প্রবেশদ্বারের ডান দিকে ‘মা ও শিশু’ ভাস্কর্য, নীলাভ স্বচ্ছ সুইমিংপুল। লাইলি-মজনু গাছের রূপ দেখে মুগ্ধ দৃষ্টিতে এগিয়ে গেলাম উত্তরের রাস্তায়। দৃষ্টিনন্দন ভাস্কর্য পেরিয়ে খেজুরবাগানের পাশেই শিশুদের কলকাকলিতে মুখরিত ‘বৃষ্টিবিলাস’। ‘নয় নম্বর বিপদ সংকেত’ সিনেমার অনন্য আকর্ষণীয় কটেজ ‘বৃষ্টিবিলাসে’ রয়েছে ‘আয়নাঘর’, ‘অচিনপুর’, ‘ফেরা’, ‘দুই দুয়ারী’র মতো হুমায়ূন আহমেদের লেখা বইয়ের নামসংবলিত ৭টি রুম। বাঁশের মাচা পেরিয়ে ডাইনোসরের অনুকীর্তি, রাক্ষস, ভূতবিলাস দর্শন শেষ করতেই নজর কাড়ল ‘লীলাবতী ঘাট’। যার মাঝামাঝি ফুটে উঠেছে, ‘নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে/ রয়েছ নয়নে নয়নে।’

ধবধবে শ্বেতপাথরের ঘাটে বসে স্বচ্ছ পানিতে মুখ দেখতে দেখতে কিংবা বাঁশঝাড়ের পাশে সারি সারি বাংলা ও ইংরেজিতে বৈজ্ঞানিক নাম লেখা ঔষধি গাছগুলো দেখতে দেখতে যেন এই স্বপ্নপুরীর স্বপ্নদ্রষ্টার কোমল পরশ পাচ্ছিলাম। প্রায় ৩০০ প্রজাতির বিভিন্ন গাছের বাগানটি হুমায়ূন আহমেদ রাশেদ হুমায়ূনকে উৎসর্গ করেছেন। পরিবার, বন্ধুবান্ধব, প্রিয়জনদের নিয়ে বা শুটিংয়ের কাজে প্রায়ই এখানে থাকতেন কথার জাদুকর। কোনো বিশেষ ব্যবস্থা করে বা মাটির দেয়ালে শত শত মোমবাতি জ্বালিয়ে প্রিয়জনদের চমকে দিতে পছন্দ করতেন তিনি। ঠিক পাশেই বিশাল পুকুরে রুই, কাতলা, কালবাউশ, চিতলের পোনাসহ বিভিন্ন মাছ ছেড়েছিলেন।

নুহাশপল্লী ঘুরে...
ছবি: লেখক

শুটিংয়ের মধ্যে বা অবসরে এখানে চলত আড্ডা। মাটির দোচালা ঘর, টিনের ঘর, দাবার বিশাল বোর্ড ও কাঠের খুঁটির কটেজ, গাছে গাছে নিশিযাপনের জন্য ট্রি হাউস দেখে হুমায়ূনের বিভিন্ন গল্প ও নাটক–সিনেমার দৃশ্যের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। পশ্চিম দিকে যেতেই ধবধবে শ্বেতপাথরের মাঝে দেখা পেলাম তাঁর, যাঁর জন্য মন কাঁদে, যাঁর টানে ছুটে আসেন সাহিত্যপ্রেমীরা।

সূর্য ডোবার আগে ফিরে তাকাতেই শিশুদের হাসিতে মুখর নুহাশপল্লীর ছবি বড় ভালো লাগল। মনে হলো যেন হুমায়ূন আহমেদের ‘কুসুম’ কিংবা ‘চন্দ্র’ ছুটে বেড়াচ্ছে। আর ম্যুরাল থেকে সুদূরে তাকিয়ে তিনি যেন অপেক্ষা করছেন চাঁদনী পসর রাতের। যে রাতে গান বেজে উঠবে, ‘চাঁদনি পসরে কে আমারে স্মরণ করে?/ কে আইসা দাঁড়াইসে গো আমার দুয়ারে?/ তাহারে চিনি না আমি, সে আমারে চেনে।’

শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়