প্রকৃতির রঙে গড়া আর. করিমের শিল্পভাষা

সাগরকন্যা মহেশখালীর সমুদ্রের পলিমাটি, কাঠ–কয়লা আর লতাপাতা দিয়েই শিল্পী আর. করিম গড়েছেন নিজস্ব শিল্পজগৎছবি: সংগৃহীত

আবহমান বাংলার লোকশিল্পের সঙ্গে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য এবং আধুনিক চিন্তার এক অপূর্ব মিশেল ঘটিয়েছেন শিল্পী আর. করিম। সাগরকন্যা মহেশখালীর সমুদ্রের পলিমাটি, কাঠ–কয়লা আর লতাপাতা দিয়েই গড়েছেন নিজস্ব শিল্পজগৎ। গতানুগতিক ক্যানভাসে আবদ্ধ না থেকে বরং প্রকৃতির কাছ থেকে উপাদান এবং শিক্ষা গ্রহণ করে শিল্পকে করেছেন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

কিংবদন্তি শিল্পী হাশেম খানের অলংকরণে অনুপ্রাণিত হওয়া এবং শৈশবের বইয়ের পাতায় প্রথম তুলির টান—সেই শুরু। এরপর আর থেমে থাকেননি তিনি। তাঁর কাজ কেবল ছবি আঁকা নয়, বরং জীবনকে ‘যাপন’ না করে ‘উদ্‌যাপন’ করা। শিল্পীর ক্ষণস্থায়ী কাজ, যা কেবল ক্যামেরাবন্দী হয় কিংবা কিংবদন্তি মান্না দের প্রতি গভীর শ্রদ্ধায় আঁকা দুই শতাধিক প্রতিকৃতি—সবই তাঁর মননশীলতার পরিচয় বহন করে।

শিল্পীর শৈশব, শিল্পচেতনার উন্মেষ, প্রাকৃতিক উপকরণ ব্যবহারের অনুপ্রেরণা, দর্শন এবং ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের ভাবনা নিয়ে আর করিমের সঙ্গে কথা বলেছেন বন্ধুসভার বন্ধু তানভীর হাসান।

কাঠ–কয়লা, চা, কফি, এমনকি পলিমাটির রংও ঠাঁই পেয়েছে আর. করিমের ক্যানভাসে।

বন্ধুসভা: কক্সবাজারের মহেশখালীর সমুদ্র, পলিমাটি আর প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য—এই পরিবেশে আপনার শৈশব কেমন ছিল? শৈশব আপনার শিল্পচেতনাকে কীভাবে প্রভাবিত করেছে?

আর. করিম: আমার পরম সৌভাগ্য যে সাগর-তনয়া মহেশখালীর বুকে আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। এখানকার সমুদ্র, পলিমাটি আর প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যই প্রথম পাঠশালা। শৈশব-কৈশোর—এই দুটি শব্দের আলাদা মানে থাকলেও আমি শব্দ দুটিকে আলাদা করতে চাই না। আমার কাছে অর্থ একটাই ‘ছোটবেলা’। এ আমার ব্যক্তিগত নস্টালজিয়া, যা এখনো আচ্ছন্ন করে রাখে। সত্যি বলতে, এখনো গ্রামেই থাকি এবং আমার উপলব্ধি হচ্ছে, শিল্প-সাধনার মূল ভিত্তি হলো গ্রাম।

শৈশবের দিনগুলো ছিল সবুজ-সরল রঙিন স্মৃতিমাখা এক নির্ভার জীবন। চৌকাঠে পা রাখলেই বিশাল আকাশ, কলকল করা নদী, পালতোলা নৌকা আর ফুল-পাখির গান। শিশিরের ফোঁটা কিংবা জ্যোৎস্নারাতে গাছের ডালপালা ভেদ করে চাঁদের উঁকি—এসব দৃশ্যের গভীরতা শহরে অনুভব করা সম্ভব নয়। শহরে প্রয়োজনের তাগিদে যেতে হয়, যাই। নগরীর মহাসড়কে দেখা চাঁদকে আমার কৃত্রিম মনে হয়। সেখানে শৈশব ছুঁয়ে দেখা যায় না।

এই প্রকৃতিই আমার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক। আমার শিল্পচেতনাকে প্রকৃতিই গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। সেই ছোটবেলা থেকেই প্রকৃতি আমাকে শিখিয়েছে সরলতা, রঙের বৈচিত্র্য আর জীবনের ছন্দ। মহেশখালীর অপার সৌন্দর্যকে সঙ্গী করেই আমার পথচলা। এই পথচলাতেই সত্যিকারের আনন্দ, যা আমার প্রতিটি ক্যানভাসে জীবন্ত হয়ে ওঠে।

আর. করিমের আঁকা চিত্রকর্ম।

বন্ধুসভা: ছোটবেলাতেই আঁকাআঁকির প্রতি আপনার আকর্ষণ জন্ম নিল কীভাবে? প্রথম তুলির টান, প্রথম স্কেচ বা প্রথম শিল্পকর্মের স্মৃতি কি আজও মনে আছে?

আর. করিম: পরিবারের বেশির ভাগ সদস্যই মাদ্রাসা শিক্ষাধারার সঙ্গে যুক্ত। ছয় ভাইবোনের মধ্যে আমি চতুর্থ। ছোটবেলায় মা আমাকে কেজি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। সেখানেই আমার হাতে এল এক জাদুকরি বই। সেটি ছিল ছবি আঁকা শেখার, যা আমার কাছে অন্য সব বইয়ের চেয়ে একেবারেই আলাদা। বইটির প্রতি জন্মানো তীব্র আকর্ষণ থেকেই মূলত আঁকিবুঁকির জগতে প্রবেশ।

এরপরই বইয়ে দেখতে পেলাম কিংবদন্তি শিল্পী হাশেম খান স্যারের অনবদ্য অলংকরণ। সেই অলংকরণগুলো আমার ভেতরে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে দিল। মনে হলো, এই আঁকাআঁকিই আমার পথ। সেই মুহূর্ত থেকেই ছবি আঁকা পুরোদমে শুরু।

জীবনের প্রথম তুলির টান বা প্রথম শিল্পকর্ম ঠিক কী ছিল, তা আজ আর স্পষ্ট মনে নেই। তবে নার্সারির সে বইটিতে আম, পেঁপে, ছাতা, ফুল—এ ধরনের সহজ বিষয়গুলো ছিল। আমি নিশ্চিত, সেই বইয়ের কোনো একটি ছাতা, আম কিংবা পেঁপে ছিল আমার আঁকা প্রথম ছবি।

নিজের আঁকা চিত্রকর্ম কথাসাহিত্যিক আনিসুল হককে উপহার দেন আর. করিম।

বন্ধুসভা: আপনি কেবল রংতুলিতে আবদ্ধ থাকেননি, লতাপাতা, কাঠ–কয়লা, চা, কফি—প্রকৃতির এই নানা উপাদান আপনার ক্যানভাসে জীবন্ত হয়ে ওঠে। এই অসাধারণ ভাবনা বা প্রাকৃতিক উপকরণ ব্যবহারের অনুপ্রেরণা কোথা থেকে পেয়েছেন?

আর. করিম: অনুপ্রেরণা আমার বাড়ির উঠান থেকেই পেয়েছি। বাড়ির উঠানে সব সময় ছিল নানা জাতের গাছগাছালি, যা আজও বিদ্যমান। প্রকৃতির এই নিবিড় সান্নিধ্যই ভাবতে শিখিয়েছে। মনে আছে, একদিন উঠানে ঝরে পড়া কাঁঠালপাতার দিকে চোখ পড়ল। পাতাগুলো পেকে এমন এক অসাধারণ রং ধারণ করেছিল, যা অনেকটা উজ্জ্বল কমলা রঙের কাছাকাছি। আমি মুগ্ধ হয়ে ভাবলাম, ‘এত সুন্দর, এত কালারফুল একটা ছবি কি শুধু এমনি নষ্ট হয়ে যাবে?’

এই সহজ, স্বতঃস্ফূর্ত ভাবনা থেকেই শুরু হলো পাতা দিয়ে ছবি বানানোর প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা।

পাতা দিয়ে যেটা শুরু হয়েছিল, সেটা আর পাতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। প্রকৃতির আরও নানা উপকরণ—কাঠ–কয়লা, চা, কফি, এমনকি পলিমাটির রংও ঠাঁই পেয়েছে আমার ক্যানভাসে। এ কাজগুলো করতে গিয়ে আমার উপলব্ধি হয়েছে, শিল্প কখনো কোনো সুনির্দিষ্ট মাধ্যমে আটকে থাকতে পারে না। শিল্প হলো ভাবের প্রকাশ, আর সেই প্রকাশের মাধ্যম হতে পারে প্রকৃতিতে সহজলভ্য যেকোনো কিছু। যখন আমি এসব উপকরণ ব্যবহার করি, তখন মনে হয়, সরাসরি প্রকৃতির ভাষা দিয়েই তার রূপকে জীবন্ত করে তুলছি।

আরও পড়ুন

বন্ধুসভা: আপনি ছয় হাজারের বেশি শিল্পকর্ম তৈরি করেছেন। এর মধ্যে কিছু কাজ সংরক্ষণের সুযোগ পাননি, যা হয়তো আপনার জন্য একধরনের সীমাবদ্ধতা। এই অপ্রাপ্তি আপনার ভেতরের সৃজনশীলতাকে কি কোনোভাবে নতুন পথে চালিত করেছে?

আর. করিম: আমার কাছে শিল্পকর্মের সংখ্যা কখনো মুখ্য নয়। কারণ, অজস্রতা তো আর শ্রেষ্ঠত্ব দিতে পারে না। ছয় হাজারের বেশি কাজ করেছি ঠিকই, তবে এই সংখ্যা হিসাব করে আঁকা হয়নি, বরং আঁকার পরে তা একটা সংখ্যায় এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র। আমি বিশ্বাস করি, ভেতর থেকে তীব্র তাগিদ অনুভব করলেই কেবল সত্যিকারের কাজ সৃষ্টি হয়। তবে হ্যাঁ, জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে কিছু ফরমায়েশি কাজ যে করিনি, তা নয়; কিন্তু মূল প্রেরণা আসে অন্তরের স্বতঃস্ফূর্ততা থেকে।

আমার আঁকা সব ছবিই যে সংরক্ষণের মতো হবে, এমনটা নয়। উদাহরণস্বরূপ, যখন ফ্লোরে পানি ঢেলে একটি মুহূর্তের ছবি আঁকি, সেটি তো আর স্থায়ীভাবে সংগ্রহ করা যায় না। সেটিকে কেবল ক্যামেরাবন্দী করেই রাখা সম্ভব। এমন আরও অনেক মাধ্যম আছে, যেখানে কাজটি ক্ষণস্থায়ী, কেবল দৃশ্যমান মুহূর্তটুকুই তার অস্তিত্ব। তবে এটিকে সীমাবদ্ধতা বা অপ্রাপ্তি হিসেবে দেখি না। এই ক্ষণস্থায়ী কাজগুলোই সৃজনশীলতাকে এক নতুন দর্শন দিয়েছে। এই ‘অসংরক্ষণীয়তা’ আমাকে শিখিয়েছে—শিল্প হলো মুহূর্তের উদ্‌যাপন, দীর্ঘস্থায়ী অস্তিত্ব নয়। হুটহাট আঁকিবুঁকি আমাকে ভেতর থেকে সজীব রাখে। এর ফলে মনন আরও মুক্ত ও পরীক্ষামূলক হয়েছে।

কবি নির্মলেন্দু গুণের সঙ্গে আর. করিম।

নিজেও জানি না, একটু পরে কী দেখে অনুপ্রাণিত হব, কোন উপকরণ আমাকে টানবে। যখন কোনো নতুন উপাদান দেখি, তখনই মনে হয়, এটা দিয়ে দারুণ কিছু করা যাবে। এভাবেই এঁকে চলেছি। আমি জীবনকে কেবল ‘যাপন’ নয়, বরং ‘উদ্‌যাপন’ করতে চাই। নিজেকে ভালো রাখতে, সৃজন মনকে সতেজ রাখতে, প্রচুর ছবি আঁকা প্রয়োজন। ক্যামেরাবন্দী করতে পারাটাও আমার কাছে কম প্রাপ্তি নয়, এটি শিল্পের ক্ষণস্থায়ী মুহূর্তকে ধারণ করার এক আধুনিক উপায়।

বন্ধুসভা: হাশেম খান, আনিসুল হকের মতো গুণীজনদের সংস্পর্শে আসার অভিজ্ঞতা আপনার শিল্পীজীবনকে কীভাবে অনুপ্রাণিত করেছে? তাঁদের সঙ্গে আপনার পরিচয় এবং তাঁদের মূল্যবান পরামর্শ আপনার শিল্পযাত্রায় কী ধরনের প্রভাব ফেলেছে?

আর. করিম: বরেণ্য শিল্পী হাশেম খান এবং লেখক আনিসুল হক স্যারের মতো গুণীজনদের সান্নিধ্যে আসতে পারাটা জীবনের এক পরম সৌভাগ্য। আমার নিরলস সাধনা ছবি আঁকা আর এ কাজ করতে গিয়েই বহু গুণীজনের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে, তাঁদের সান্নিধ্যে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। তাঁদের কাছ থেকে যে ভালোবাসা ও উৎসাহ পেয়েছি, তা আমাকে প্রতিনিয়ত আপ্লুত করে এবং নতুন করে ভাবতে শেখায়। এযাবৎকালে এত এত গুণী মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছি, সেই স্মৃতিগুলো নিয়ে লিখলে একাধিক বই লিখে ফেলা যাবে।

আমার স্বপ্নের ‘কুসংস্কারমুক্ত’ বাংলাদেশ হবে একটি প্রগতিশীল, মানবিক ও বিজ্ঞানমনস্ক দেশ। যেখানে মানুষকে ধর্ম, বর্ণ বা লিঙ্গের ভিত্তিতে নয়, বরং মানুষকে মানুষ হিসেবে বিচার করা হবে।
আর. করিম

বন্ধুসভা: শিল্পী মান্না দের প্রতিকৃতি আঁকা আপনার কাছে কেবল একটি কাজ ছিল নাকি এর পেছনে ছিল গভীর কোনো আবেগ বা শ্রদ্ধা?

আর. করিম: কিংবদন্তি শিল্পী মান্না দের প্রতিকৃতি আঁকার মূলে রয়েছে গভীরতম ভক্তি ও শ্রদ্ধা। তিনি আমার হৃদয়ের খুব গভীরে আসন করে আছেন। এযাবৎকালে মান্না দের দুই শতাধিক মুখাবয়ব এঁকেছি। হয়তো এই ছবিগুলোর সব কটিই শিল্পের বিচারের নিখুঁত মাপকাঠিতে মাপনযোগ্য হয়নি, কিন্তু আমার কাছে মুখ্য বিষয় হলো—আমি কী আঁকতে চেয়েছি। কেবল তাঁর ছবি আঁকিনি, আমি আমার তুলি ও মনন দিয়ে চেষ্টা করেছি মান্না দে-কেই আঁকতে। তাঁর ভেতরের সুর, তাঁর আবেগ, তাঁর সারা জীবনের মহত্ত্বকে ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলতে।

বন্ধুসভা: আপনি শিল্পকে পেশা হিসেবে না নিয়ে নেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। এই নেশা আপনার ব্যক্তিগত জীবন এবং জীবনের সামগ্রিক গতিপথের ওপর কেমন প্রভাব ফেলেছে?

আর. করিম: আসলে বেছে নিয়েছি বললে ভুল হবে, বরং এটি জীবনের গতিপথ নির্ধারণ করে দিয়েছে। আঁকতে আঁকতে এটা আমার হয়ে গেছে। ছবি আঁকা আমার প্রথমে নেশা, তারপর পেশা। পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করলেও, মূল অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে আমার এই নেশা।

গাছের পাতায় জীবনানন্দ দাশ
চিত্রকর: আর. করিম

ছবি আঁকার নেশা জীবনের সামগ্রিক গতিপথের ওপর এক অপরিবর্তনীয় প্রভাব ফেলেছে। প্রথমত, এখন মনে হয়, ছবি আঁকা ছাড়া আমাকে দিয়ে আর কোনো কাজ হবে না। আমার সত্তার সঙ্গে শিল্প এমনভাবে মিশে গেছে যে মাঝেমধ্যে মনে হয়, এটি আমার শ্বাসপ্রশ্বাসের মতোই স্বাভাবিক। এই নেশা আমাকে বাণিজ্যিক স্রোত থেকে দূরে থাকতে সাহায্য করে। বর্তমানে ছবি এঁকে অর্থ উপার্জনের জন্য অনেক কমার্শিয়াল দিক বা ফরমায়েশি কাজের সুযোগ তৈরি হয়েছে, কিন্তু সেগুলো আমাকে টানে না। আমার কাছে সেটাই গুরুত্বপূর্ণ, যে কাজটা আমার করতে ভালো লাগে। যদি সেই কাজ থেকে তুলনামূলক কম অর্থও আসে, তবু মানসিক তৃপ্তি অনেক বেশি।

বন্ধুসভা: বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মকে শিল্প ও সংস্কৃতির মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়ার জন্য কী বার্তা দিতে চান? কীভাবে তারা নিজেদের সৃজনশীলতা সমাজের কল্যাণে ব্যবহার করতে পারে?

আর. করিম: তরুণ প্রজন্মের প্রতি প্রথম বার্তা হলো—নিজেকে জানো। নিজের শিকড়, নিজের পরিচয় ও অস্তিত্বকে জানতে না চাওয়াটা একধরনের মূর্খতা। শিল্প ও সংস্কৃতি হলো নিজেদের অস্তিত্ব জানার শ্রেষ্ঠতম মাধ্যম। যে যত বেশি ইতিহাস জানবে, সে তত বেশি নিজেকে সমৃদ্ধ করতে পারবে এবং আত্মবিশ্বাসী হতে পারবে।

শুধু আনুষ্ঠানিক ডিগ্রি বা সার্টিফিকেটের পেছনে না ছুটে, নিজের উদ্যোগে জ্ঞান অর্জন করাও সম্ভব। শিক্ষিত হওয়া মানেই যথেষ্ট নয়; ভেতরের মানুষটিকে জাগিয়ে তুলতে সাংস্কৃতিক চেতনা অপরিহার্য। তরুণেরা তাদের সৃজনশীলতা দিয়ে সমাজের কল্যাণে অবদান রাখতে পারে—ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে জীবন্ত রাখতে, মানবিক মূল্যবোধ ও সহমর্মিতা ছড়িয়ে দিতে এবং প্রকৃতি ও পরিবেশ সচেতনতা বৃদ্ধি করতে। সংক্ষেপে বলতে গেলে, চাকরির পেছনে না ছুটে, শিল্প ও সংস্কৃতির আলোয় নিজের ভেতরের মানুষকে জাগিয়ে তোলা এবং সেই আলোয় সমাজকে আলোকিত করাই প্রকৃত শিক্ষা।

আর. করিমের রংতুলিতে সৈয়দ শামসুল হক।

বন্ধুসভা: আপনি কেমন বাংলাদেশ দেখতে চান এবং শিল্প কীভাবে সে লক্ষ্য অর্জনে ভূমিকা রাখতে পারে?

আর. করিম: আমার স্বপ্নের ‘কুসংস্কারমুক্ত’ বাংলাদেশ হবে একটি প্রগতিশীল, মানবিক ও বিজ্ঞানমনস্ক দেশ। যেখানে মানুষকে ধর্ম, বর্ণ বা লিঙ্গের ভিত্তিতে নয়, বরং মানুষকে মানুষ হিসেবে বিচার করা হবে। আমি বিশ্বাস করি, যার নিজের দেশের প্রতি টান নেই, সে অন্য কোনো দেশকে ভালোবাসতে পারে না। বাংলাদেশ হোক সবার।

শিল্প এখানে অপরিহার্য হাতিয়ার। আপনি দেখবেন, শিল্প মানুষকে প্রশ্ন করতে শেখায়, ভেতরের সংবেদনশীলতা ও যুক্তিবোধ জাগায় এবং আমাদের লোকশিল্প ও সংস্কৃতির মাধ্যমে বিভেদের ধারণাগুলো ভুল প্রমাণ করতে সাহায্য করে। সত্য ও সুন্দরের পক্ষে দাঁড়িয়ে, শিল্পই আমাদের কুসংস্কারের জঞ্জাল সরিয়ে একটি আলোকিত, মানবিক ও সুন্দর ভবিষ্যৎ তৈরি করতে সাহায্য করবে। যেমনটি একটি গানে বলেছি, ‘বাংলাদেশ আমার জন্মভূমি, তোমাকে সাজালে সাজবে আমার অনাগত আগামী।’

পানি দিয়ে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রতিকৃতি আঁকেন আর. করিম।

বন্ধুসভা: ভবিষ্যৎ লক্ষ্য যদি শুধু ছবি আঁকা হয়, তবে দীর্ঘ মেয়াদে নিজেকে কোন ধরনের শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চান? শিল্পকর্মের মধ্য দিয়ে আপনি কী বার্তা রেখে যেতে চান?

আর. করিম: ভবিষ্যৎ লক্ষ্য একটাই—এঁকে যাওয়া, এঁকে যাওয়া এবং শুধু এঁকেই যাওয়া। একসময় মনে করতাম, কেবল আঁকতে পারলেই শিল্পী হওয়া যায়। এখন বুঝি, শুধু আঁকতে পারলেই শিল্পী হওয়া যায় না; শিল্পী হতে হয়। এটা এক চলমান প্রক্রিয়া, যেখানে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা উভয়ই অপরিহার্য। নিজেকে সমৃদ্ধ করতে হলে জানতে হবে, পড়তে হবে এবং জীবনকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।

নিজেকে এমন একজন শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই, যে শিল্পী শিল্পের গতানুগতিক সংজ্ঞা অতিক্রম করে মাটি ও মানুষের শিল্পী হয়ে উঠতে পারে। আমি চাই আমার শিল্পকর্মের একটি নিজস্ব ভাষা বা স্টাইল তৈরি হোক। আমার মনে হয়, স্টাইল তৈরি করার চেষ্টা করাও ভুল। এটা কাজ করতে করতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে হয়ে যায়। এর জন্য প্রয়োজন চিন্তাভাবনার মধ্যে শুদ্ধতা এবং নিজের অস্তিত্ব ও শিল্পের প্রতি পরিষ্কার জ্ঞান রাখা। স্বামী বিবেকানন্দ যেমন বলেছেন, ‘চালাকির দ্বারা কোনো মহৎ কাজ হয় না’, তেমনি আন্তরিকতা ও শুদ্ধতা ছাড়া মহৎ শিল্প সৃষ্টি হয় না।