নদীতে বিনা মূল্যে সাঁতার শেখান নজরুল, করেছেন শতাধিকবার রক্তদান
মানুষ চাইলেই উড়তে পারে, পানিতে মাছের মতো ভাসতে পারে এবং জয় করতে পারে এভারেস্টের চূড়া। মানুষের কাছে অসাধ্য কিছু নেই। এর জ্বলন্ত উদাহরণ ভৈরবের সাঁতার প্রশিক্ষক নজরুল ইসলাম। তিনি এ পর্যন্ত ৪৮ বার রক্তদান ও ৯৭ বার প্ল্যাটিলেট দান করেছেন। পাশাপাশি অন্যান্য সামাজিক কার্যক্রমও করেছেন। ভৈরব পৌর শহরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে বৃহত্তম মেঘনা নদী। কয়েক বছর ধরে নদীতে বিনা মূল্যে সাঁতার শেখাচ্ছেন নজরুল ইসলাম। তিনি গড়ে তুলেছেন ভৈরব ফ্রি সুইমিং ক্লাব।
নজরুল ইসলামের সাঁতার শেখানোর শুরু ও অভিজ্ঞতার গল্প এই সাক্ষাৎকারে তুলে ধরেছেন ভৈরব বন্ধুসভার বন্ধু নাহিদ হোসাইন।
বন্ধুসভা: নিয়মিত রক্তদান করেন এবং সামাজিক কাজে যুক্ত থাকেন, এই অনুপ্রেরণা কোথা থেকে পেলেন?
নজরুল ইসলাম: আমাদের এই সংক্ষিপ্ত জীবনে মানুষের জন্য কাজ করতে পারার মধ্যেই সত্যিকারের আনন্দ খুঁজে পাই। এতে অর্থ না এলেও মানসিক তৃপ্তি পাই। এটাই আমার অনুপ্রেরণা।
বন্ধুসভা: বিনা মূল্যে সাঁতার শেখানোর এই উদ্যোগের পেছনে কোনো কারণ আছে কি?
নজরুল ইসলাম: শৈশবে সাঁতার ছিল আমাদের আনন্দের জায়গা। ২০২১ সালে ছোট ছেলেকে সাঁতার শেখানোর জন্য মেঘনার পাড়ে আসি, তখন মাথায় আসে অন্য শিশুদের শেখানোর কথা। তাহলে কিছু সময়ের জন্য তারা ডিজিটাল ডিভাইস থেকে বের হয়ে জীবন রক্ষার কৌশল শিখতে পারবে। তা ছাড়া আমার পরিচিত বেশ কয়েকজন পানিতে পড়ে মৃত্যুবরণ করার ঘটনাও বিনা মূল্যে সাঁতার শেখানোর আরেকটি কারণ।
বন্ধুসভা: সাঁতার শেখানো শুরু করার সময় কী ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন?
নজরুল ইসলাম: রক্তদান শুরু করার পর যেমন নিরুৎসাহিত করত কিছু মানুষ, তেমনি সাঁতার শেখানো শুরু করার পরও একই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হই। সবার একটাই প্রশ্ন, ফ্রিতে শিখিয়ে কী লাভ? এই নদীতে বর্তমান প্রজন্ম সাঁতার শিখতে আসবে না। দুর্ঘটনা ঘটলে বদনাম হবে ইত্যাদি। আমি সম্পূর্ণ নিরাপত্তা গ্রহণ করেই সাঁতার শেখাই। মজার ব্যাপার হলো, যারা নেগেটিভ মন্তব্য করত, আজ তারাই এগিয়ে আসছে।
বন্ধুসভা: সাঁতার শেখাতে গিয়ে কেমন অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন?
নজরুল ইসলাম: বাচ্চাদের পানির ভয় কাটানো নিয়ে বেশ কিছু অভিজ্ঞতা আছে। এক পরিবারের দুই যমজ ভাই এসেছে সাঁতার শিখতে। এক ভাই পানিতে নেমে গেলেও আরেক ভাই কিছুতেই নামতে চাচ্ছে না। ধীরে ধীরে তার ভয় কেটে যায়। আবার কেউ পানি খেয়ে ফেলছে, প্রতিনিয়ত এ রকম নানা ধরনের চ্যালেঞ্জিং অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছি।
বন্ধুসভা: আপনার শিক্ষার্থীদের প্রতিক্রিয়া কেমন?
নজরুল ইসলাম: ওরা তো এখন অনেক খুশি। বন্ধুদের সঙ্গে গর্ব করে বলতে পারে, ‘জানিস, আমি সাঁতার শিখে ফেলেছি’। এটা শুনে ওর বন্ধুও আগ্রহী হয়।
বন্ধুসভা: রক্তদান, অন্য সামাজিক কাজ কিংবা সাঁতার শেখানো—এগুলোর মধ্যে কোন কাজটিকে এগিয়ে রাখবেন?
নজরুল ইসলাম: এই কাজগুলো করে মনের আনন্দ পাই। আমার শুরুটা হয়েছিল রক্তদানের মাধ্যমে, এরপর অন্যান্য সামাজিক কাজে যুক্ত হই। সাঁতার শেখার পর ওদের চোখে–মুখের আনন্দের ঝলকানি আমাকে আনন্দ দেয়। এই আনন্দ হয়তো টাকা দিয়ে পেতাম না। আমি রক্তদানকে এগিয়ে রাখব। কারণ, এটাই আমার প্রথম কাজ।
বন্ধুসভা: ভৈরব ফ্রি সুইমিং ক্লাব থেকে এ পর্যন্ত কতজন সাঁতার শিখেছে?
নজরুল ইসলাম: এখন পর্যন্ত ৪৫ জন সাঁতার শিখেছে। দিন দিন এই সংখ্যা বাড়ছে।
বন্ধুসভা: আমাদের দেশে সাঁতার না জানার কারণে অনেক দুর্ঘটনা ঘটে। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?
নজরুল ইসলাম: বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ হলেও ডিজিটাল ডিভাইসের আসক্তি শিশুদের লাইফ সেভিং স্কিল থেকে বিমুখ করছে। পত্রিকা খুললেই পানিতে ডুবে মৃত্যুবরণের ঘটনা যখন দেখি, তখন খুবই কষ্ট পাই। কত মেধাবী তরুণ হারিয়ে গেলেন! প্রতিটি পরিবারের উচিত বাচ্চাদের সাঁতার শেখানো।
বন্ধুসভা: আপনি কি মনে করেন, সাঁতার শেখানো বাধ্যতামূলক শিক্ষার অংশ হওয়া উচিত?
নজরুল ইসলাম: বিশ্বের অনেক দেশেই সাঁতার শেখা বাধ্যতামূলক শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত। এই লাইফ স্কিলকে অবশ্যই বাধ্যতামূলক শিক্ষার অংশ করা উচিত। বিভিন্ন ভাষা শেখা যেমন স্মার্টনেস, সাঁতার শেখাও হোক জীবনের জন্য স্মার্টনেস।
বন্ধুসভা: ভবিষ্যতে এই উদ্যোগকে কীভাবে আরও বড় আকারে দেখতে চান?
নজরুল ইসলাম: একটা সুইমিংপুলের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি। অনেকেই বলে, সুইমিংপুল হলে সাঁতার শিখবে। সাঁতারের প্রতিযোগিতা করা হলে আরও অনেকে আগ্রহী হবে। এই উদ্যোগকে বড় করতে চাইলে অর্থের প্রয়োজন। উপজেলা প্রশাসন ও সরকার এগিয়ে এলে ভালো কিছু সম্ভব।
বন্ধুসভা: মানবিক এই কাজগুলো করে আপনার অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে কিছু বলুন।
নজরুল ইসলাম: মানবিক কাজগুলো শুরু করার পর নানা ধরনের মানুষের সঙ্গে পরিচয় হচ্ছে, নেটওয়ার্কিং বাড়ছে। যখন রক্ত নিয়ে কাজ শুরু করি, তখন কোনো সংগঠন ছিল না। এখন অসংখ্য সংগঠন, ফেসবুক গ্রুপ ও তরুণেরা রক্ত দিতে এগিয়ে আসছেন। আমাকে সবাই রক্তসৈনিক নজরুল ভাই বলে সম্বোধন করেন।
বন্ধুসভা: তরুণ সমাজকে কোনো বার্তা দিতে চান?
নজরুল ইসলাম: তরুণেরাই আগামী বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা। তরুণদের উচিত সামাজিক কাজগুলোয় এগিয়ে আসা। মানুষের জন্য কাজের মাধ্যমে আর্থিক কিছু পাওয়া না গেলেও মনের আনন্দ পাওয়া যাবে। এতে সমাজের যেমন উন্নতি হবে, তেমনি মাদকের আসক্তি কমবে। আমরা পাব তারুণ্যনির্ভর সুস্থ সমাজ। যে তরুণ সমাজ সাজাবে স্বপ্নের বাংলাদেশ।
বন্ধু, ভৈরব বন্ধুসভা