আমি চাই আমার শিল্প গণমানুষের কথা বলুক

বাংলাদেশের লোকশিল্পের ভুবনে এক অনন্য নাম পটুয়া নাজিরছবি: শিল্পীর সৌজন্যে

বাংলাদেশের লোকশিল্পের ভুবনে এক অনন্য নাম পটুয়া নাজির। দিনাজপুরের পার্বতীপুরের ছোট্ট গ্রাম থেকে শুরু করে ঢাকার ব্যস্ততম শাহবাগ পর্যন্ত তাঁর শিল্পযাত্রা যেন এক স্বপ্নগাথা। ফুটপাতকে করেছেন নিজের শিল্প আখড়া, যেখানে সাধারণ মানুষ-রিকশাচালক থেকে শুরু করে পথচারী, অবাক বিস্ময়ে থেমে দেখে তাঁর তুলির ছোঁয়ায় আঁকা বাঘ আর লাল-সবুজ পতাকার গল্প। সরলতা, দেশপ্রেম ও গণমানুষের জীবনের চিত্রই তাঁর শিল্পের মূল উপজীব্য।

দুই যুগ ধরে আঁকছেন বাঘ। যে বাঘ কখনো হাল চাষ করে, কখনো বাজায় দোতারা, আবার কখনো দাঁড়ায় আমাদের সাহসিকতার প্রতীক হয়ে। বিশ্ব দরবারেও ছড়িয়ে পড়েছে তাঁর শিল্পকর্ম; জাপান থেকে যুক্তরাষ্ট্র—বিদেশি দর্শকও মুগ্ধ হয়েছেন পটুয়ার শিল্পকর্মে। একই সঙ্গে বিনা পারিশ্রমিকে শিশুদের আঁকা শেখানো, ফুটপাতে বসে সাধারণ মানুষের কাছে শিল্পের আনন্দ ছড়িয়ে দেওয়া—এসবই তাঁর শিল্পচর্চার অবিচ্ছেদ্য অংশ।

লোকশিল্পের ভবিষ্যৎ, পটুয়ার শিল্পজীবনের স্বপ্ন ও সংগ্রামের কথা তুলে ধরেছেন বন্ধুসভার বন্ধু তানভীর হাসান

বন্ধুসভা: পার্বতীপুর থেকে ঢাকা; এই যাত্রা কেমন ছিল? শহরের ভিড়ে শিল্পী হয়ে ওঠার গল্পটা শেয়ার করবেন?

পটুয়া নাজির: গল্পটা একটু লম্বা! আমার জন্ম দিনাজপুরের পার্বতীপুরের ছোট্ট গাঁয়ে, ১৯৮২ সালে। ঢাকায় এলাম ১৯৯৬ সালে। স্থায়ী বসবাস ছিল না। এক বুক আশা আর মায়ের দেওয়া অল্প কিছু টাকা ছিল সম্বল। টাকা ফুরোলেই আবার গাঁয়ে ফিরতাম। ঢাকায় এলে সারা দিন চারুকলার আশপাশে ঘুরঘুর করতাম। জানতাম, এখানেই বড় শিল্পীরা থাকেন, সবাই শিল্প নিয়েই বাঁচেন। একবার সাহস করে নিজের আঁকা কিছু পটচিত্র দেখালাম শিক্ষক-ছাত্রদের, তাঁদের বাহবা পেয়ে আগ্রহটা আরও জেঁকে বসল। এতদিন যাঁদের ছবি শুধু পত্রিকায় দেখেছি, ঢাকায় এসে তাঁদের কাজ সরাসরি দেখলাম। ব্যস, তখনই ঠিক করে ফেললাম, পটচিত্র আঁকব ঢাকাতেই!

বন্ধুসভা: ছোটবেলা থেকে আঁকায় যে আগ্রহ জন্মেছে, সেটা কীভাবে পেশা ও শিল্পচর্চায় পরিণত হলো?

পটুয়া নাজির: তখন বয়স চার-পাঁচ হবে। চক বা মায়ের রান্না করা কাঠকয়লা দিয়েই আঁকিবুঁকি করতাম। কখনো মাটিতে, কখনো দেয়ালে। স্কুলে যখন ভর্তি হলাম, লেখার চেয়ে বইয়ের ভেতরের ছবিগুলোই বেশি টানত। পড়ার খাতায় রবীন্দ্র-নজরুলের ছবি আঁকতাম। দেখা যেত খাতার মধ্যে লেখার চেয়ে আঁকিবুঁকিই বেশি। আট ভাইবোনের সংসারে আঁকাআঁকি নিয়ে নিন্দাই বেশি শুনতে হতো। কিন্তু আমি মনের আনন্দেই এঁকে যেতাম, কারও বারণে দমে যাইনি। এরপর যখন ‘রঙধনু’ নামের একটা সাংস্কৃতিক সংগঠনে যোগ দিলাম, তখনই নিশ্চিত হই আঁকাআঁকিই হবে আমার জীবনের পাথেয়। বুঝতে পারলাম, এটাই আমার পেশা, ধ্যান, শিল্প।

পটুয়া নাজিরের পটচিত্রে সব সময় গ্রামবাংলার চিরায়ত গল্পগুলোই থাকে
ছবি: শিল্পীর সৌজন্যে

বন্ধুসভা: শাহবাগের ফুটপাতকে নিজের ‘শিল্প আখড়া’ বানানোর পেছনে কি কোনো গল্প আছে?

পটুয়া নাজির: ফুটপাতকে আখড়া বানানোর কারণ খুব সোজা। দেখেন, চারুকলা, শিল্পকলা বা জাদুঘরে সাধারণ আমজনতা কিন্তু সহজে ঢুকতে পারে না। একজন দিনমজুর ভাই কিংবা রিকশাওয়ালা ভাই চাইলেই যেতে পারে না শিল্পকলায় কিংবা শিল্প প্রদর্শনীতে। কিন্তু ফুটপাত হলো গণমানুষের জায়গা। এখানে একজন রিকশাচালক আসেন, বসেন আর আপন মনে ছবি দেখেন। একজন শ্রমজীবী মানুষ পটচিত্র দেখছে—এটাই আমার অর্জন! শিল্প গণমানুষের, আমি চাই আমার শিল্প গণমানুষের কথা বলুক। সেই যে ’৯৬ সালে এলাম, অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়েছি, কিন্তু শাহবাগ আমাকে ফেরায়নি, বরং গভীর মমতায় বরণ করে নিয়েছে। এখন এই পাবলিক লাইব্রেরির সামনের ফুটপাতই আমার আখড়া, আমার জগৎ।

বন্ধুসভা: গ্রামের মানুষ, নকশিকাঁথা, মাটির জিনিস—এসব আপনার চিত্রকর্মে কীভাবে ফুটেছে?

পটুয়া নাজির: মাটির ঘর, দেয়ালে মায়ের হাতে আঁকা নকশা, রাখালের গরু ছড়ানো কিংবা পশ্চিমের বন্দে গলা ছেড়ে গান ধরা কৃষকের সুর—এসবের সঙ্গে বেড়ে ওঠা। এগুলোই অনুপ্রেরণা! আমি আঁকি চারপাশের সাধারণ মানুষের ছবি; গ্রামের কৃষক, পাড়ার কামার, কুমোর, জেলে, তাঁতিদের গল্প। মা-বোনেদের হাতে আঁকা নকশিকাঁথার ছবি কিংবা মাটির তৈজসপত্রের চিত্র—এগুলোই আমার পটচিত্রের ভিত তৈরি করেছে। আমার পটচিত্রে সব সময় গ্রামবাংলার চিরায়ত গল্পগুলোই থাকে।

আরও পড়ুন

বন্ধুসভা: জয়নুল, সুলতান, যামিনী রায় কিংবা কামরুল হাসানের শিল্পকর্মের মধ্যে কার শিল্পের প্রভাব আপনার পটচিত্রে সবচেয়ে বেশি প্রতিফলিত হয়েছে এবং কেন?

পটুয়া নাজির: সব মহান শিল্পীর কাজই দেখি। তবে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট হয়েছিলাম পটুয়া শিল্পীদের আঁকা চিত্রগুলো দেখে। তাঁদের ছবির সঙ্গে আমার আত্মিক যোগ আছে। যখনই নিজের একটি স্বতন্ত্র স্টাইল গড়ে তোলার কথা ভাবি, তখনই মনে পড়ে যামিনী রায়ের ছবির কথা। তাঁর আঁকা ছবির দিকে তাকালেই বোঝা যায়, এটা নিঃসন্দেহে তাঁর সৃষ্টি। আমি চাই, আমারও এমন এক স্টাইল থাকুক, যা হবে আমার শিকড়ের সঙ্গে যুক্ত, আমার মাটির গন্ধে ভরা, আমার হাজার বছরের ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির রঙে রঙিন। এ জন্যই পটুয়া শিল্পীদের অঙ্কনশৈলী আমাকে বেশি টেনেছে, তাঁদের কাছ থেকে প্রেরণা পেয়েছি।

বন্ধুসভা: পটচিত্রের ঐতিহ্যগত উপকরণ যেমন ইটের গুঁড়া, সিঁদুর, আলতা—এসব কি এখনো আপনার তুলির ছোঁয়ায় দেখা যায় নাকি নতুন উপকরণে অভ্যস্ত হয়েছেন? যদি পরিবর্তন করেন, তবে পরিবর্তনের পেছনের গল্পটা কী?

পটুয়া নাজির: শৈশবে লতাপাতা আর নানা রঙের ফুল কুচি কুচি করে মেখে রং বানাতাম। সেই রং দিয়ে ছবি আঁকার আনন্দ ছিল অন্য রকম। পরে দেখেছি, দেশজ উপাদান দিয়েই তো আমাদের পটচিত্রের ঐতিহ্য তৈরি হয়েছে—ইটের গুঁড়া, কাঠকয়লা, সিঁদুর কিংবা লতাপাতা। এখনো আমার অঙ্কনের ধরন সহজ। জটিল প্রক্রিয়ায় যেতে ভালো লাগে না। কখনো পেনসিল, কখনো সাধারণ মানের রং। আমার বিশ্বাস, শিল্প যদি মানুষের জন্য হয়, তবে তা এমন হতে হবে যা সাধারণ মানুষ সহজে বুঝতে পারে। আমিও চেয়েছি আমার ছবিগুলো সহজবোধ্য হোক। প্রায়শই ফুটপাতে বসে আঁকি। হাতের কাছে যা পাওয়া যায়, তাই দিয়ে কাজ চালাই। এই অভ্যাসই আমাকে শিখিয়েছে, শিল্পের সৌন্দর্য উপকরণের বাহুল্যে নয়, বরং সরলতায় আর প্রকাশভঙ্গিতে।

মার্কিন চলচ্চিত্র নির্মাতা এলেক্সিস ক্রাসিলভস্কির (ডানে) সঙ্গে পটুয়া নাজির
ছবি: শিল্পীর সৌজন্যে

বন্ধুসভা: বাঘ কেন আপনার ‘আইকন’? মানুষের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে বাঘকে মেলানোর পেছনে কি কোনো বার্তা আছে?

পটুয়া নাজির: বাঘ হলো আমার নিজস্ব স্টাইল! দেখেন, বড় বড় শিল্পীর বা লোকশিল্পের পটুয়াদের সবারই একটা নিজস্ব স্টাইল থাকে। আমি ভাবলাম, আমারও এমন একটা আইকন হোক, যা হবে আমার একান্ত নিজস্ব, আবার গৌরবের প্রতীক। এভাবেই আমার ছবিতে বাঘ চলে এল।

মানুষের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে বাঘকে মেলানোর পেছনে আমার একটা বার্তা আছে। বাঘের ছবি দেখেই লোকে কৌতূহলী হয়! আমার ছবিতে বাঘ হাল চাষ করে, দোতারা বাজায়, মাস্টারি করে, ফসল বোনে। এটা আসলে আমার দেশের গল্প। বাংলাদেশ কীভাবে একটি দেশ হয়ে উঠল, সেই গল্পই বাঘের মাধ্যমে বলতে চাই। বাঘ আমাদের সাহসিকতার প্রতীকও তো বটে!

বন্ধুসভা: বাঘের সঙ্গে লাল-সবুজ পতাকা, এই সংমিশ্রণ দর্শকের কাছে কী বার্তা দেয় বলে মনে করেন?

পটুয়া নাজির: দেশপ্রেমের বার্তা। দুই যুগ ধরে মাথায় লাল-সবুজ পতাকা বেঁধে রেখেছি। শুধু বেঁধেই রাখি না, অন্তরেও ধারণ করার চেষ্টা করি। আমার ছবির নায়কেরা এমনকি বাঘের মাথাতেও জাতীয় পতাকা জড়ানো থাকে। আমার কাছে দেশ সবার আগে, দেশ থাকবে মাথায়! আমি চাই ছোট ছোট ছেলেমেয়ের মধ্যে যেন দেশপ্রেম বাড়ে, আর আমার ছবি দেখলে যেন তারা সেই বার্তা খুঁজে পায়। বাঘ আমাদের গর্ব, পতাকা আমাদের পরিচয়।

আমি আমার শিল্পের মাধ্যমে চেষ্টা করি কংক্রিটের শহরে গ্রামের চিরায়ত গল্পগুলো ফুটিয়ে তুলতে।

বন্ধুসভা: আমরা জানি আপনি শিশুদের বিনা পারিশ্রমিকে পটচিত্র আঁকা শেখান। ফুটপাতে পটচিত্র আঁকা শেখানোর মাধ্যমে আপনি তাদের মধ্যে কী বার্তা ছড়াতে চান? সাধারণ মানুষের চোখে শিল্পের সৌন্দর্য ও সংস্কৃতির আনন্দ কেমন ফুটে উঠবে বলে আপনি মনে করেন?

পটুয়া নাজির: আমি চাই এই শিল্পচেতনা সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ুক। বিনা মূল্যে পটচিত্র আঁকা শেখাই। শিশুদের শেখানোর মূল কারণ, তারা যেন এই ছবির মাধ্যমে দেশকে ভালোবাসতে শেখে। সাধারণ মানুষ যেন আমার পটচিত্র দেখে, সুন্দর জিনিস দেখে। আমি বিশ্বাস করি, পাবলিক প্লেসেই আর্ট প্রদর্শন করা উচিত। ফুটপাতে বসে একজন রিকশাচালক ছবি দেখছে, একজন সাধারণ পথচারী ছবি দেখছে—এটাই বড় অর্জন। আমার সহজ আঁকার পদ্ধতি দেখে সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে। এইভাবেই তাদের চোখে শিল্পের সৌন্দর্য ও সংস্কৃতির আনন্দ ফুটে ওঠে।

বন্ধুসভা: শহরের মানুষ আর গ্রামের মানুষ কি ভিন্নভাবে আপনার চিত্রকর্মকে অনুভব করে? এই ভিন্ন প্রতিক্রিয়া আপনার শিল্পচর্চায় কি নতুন দিক বা ভাবনার জন্ম দিয়েছে?

পটুয়া নাজির: আসলে আমি রুট লেভেলে কাজ করি, যাতে সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে। আমি আমার চারপাশে যা দেখি, সেই গ্রামবাংলার চিরায়ত গল্পগুলোই ফুটিয়ে তুলি। শহুরে দর্শক হয়তো পটচিত্রের ঐতিহ্য বোঝে, কিন্তু গ্রামের মানুষ ছবি দেখে নিজের জীবন, নিজের সংস্কৃতি খুঁজে পায়। আমি আমার শিল্পের মাধ্যমে চেষ্টা করি কংক্রিটের শহরে গ্রামের চিরায়ত গল্পগুলো ফুটিয়ে তুলতে।

কখনো পেনসিল, কখনো সাধারণ মানের রং দিয়ে চিত্র আঁকেন পটুয়া নাজির
ছবি: শিল্পীর সৌজন্যে

বন্ধুসভা: বাংলাদেশের পটচিত্র ও লোকশিল্পকে নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে আপনার চোখে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ কী?

পটুয়া নাজির: লোকশিল্পকে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় স্থান দিতে হবে। একটা স্বপ্ন দেখি, ঢাকা শহরের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় লোকশিল্পের বড় বড় স্থাপনা হবে। আমাদের সন্তানেরা হয়তো আর নকশিকাঁথা আঁকবে না, কিন্তু তারা যেন অন্তত সেই স্থাপনাগুলো দেখে আমাদের হাজার বছরের সংস্কৃতি খুঁজে পায়, জানতে পারে। আর দরকার পৃষ্ঠপোষকতা। শিল্পী যখন সঠিক মর্যাদা পাবে, তখন তরুণেরা এমনিতেই এই সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত হবে।

বন্ধুসভা: ডিজিটাল আর্কাইভ বা আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে কাজ করার অভিজ্ঞতা কেমন?

পটুয়া নাজির: ২০১৩ সালে জাপানে গিয়েছিলাম। বাঘের পটচিত্র সেখানে সবার নজর কেড়েছিল। আমার আঁকা বাঘের মাসকট জাপান-বাংলাদেশ গুডউইল অ্যাম্বাসাডর হিসেবে নির্বাচিত হয়। এর চেয়ে গর্বের আর কি হতে পারে!

আমার কাজে মুগ্ধ হয়ে মার্কিন চলচ্চিত্র নির্মাতা এলেক্সিস ক্রাসিলভস্কি ও বাংলাদেশি চলচ্চিত্র নির্মাতা শামীমা আকতার যৌথভাবে আমাকে নিয়ে ‘টুকি দ্য টাইগার’ নামে একটা বই লিখছেন। বইটা যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে বের হবে। তারা যখন আমার বাঘের ছবি দেখে এত মুগ্ধ হয়, তখন বুঝি যে আমি যা আঁকি, তা বিশ্বমানের। আমার শিল্পসাধনা যে বিশ্ব দরবারে স্বীকৃতি পাচ্ছে, এর চেয়ে বড় অর্জন আরকি!

স্বপ্ন বাস্তবায়নে বিনা মূল্যে ছবি আঁকা শেখানো চালিয়ে যাব এবং ফুটপাতে বসে সাধারণ মানুষের মধ্যে শিল্পের সৌন্দর্য ছড়িয়ে দেব।

বন্ধুসভা: বিদেশি দর্শক বা পাঠক যখন আপনার কাজ দেখে, কোন দিকটি তাদের সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করে?

পটুয়া নাজির: বিদেশি দর্শক বা পাঠককে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করে আমার বাঘ! এলেক্সিস ক্রাসিলভস্কি তো আমার ব্যাগে আঁকা বাঘের ছবি দেখেই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁরা কৌতূহলী হয় যে কেন একজন শিল্পী মানুষের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে বাঘকে মেলায়। আসলে, বাঘের ছবিতে তাঁরা বাংলাদেশের গল্প খুঁজে পায়। আমি দেখেছি, তাঁরা বিশ্বজুড়ে সেরাটা খুঁজে বেড়ায়। আমার শিল্পকর্মে যখন আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে একটি নিজস্ব স্টাইলে দেখতে পায়, তখন তাঁরা মুগ্ধ হয়ে ছবি সংগ্রহ করে।

বন্ধুসভা: আপনার সবচেয়ে প্রিয় কাজ বা সিরিজ কোনটি এবং কেন সেটি আপনার কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছে?

পটুয়া নাজির: সবচেয়ে প্রিয় হলো বাঘের পটচিত্র। এখন পর্যন্ত ৩০ হাজারের বেশি বাঘের ছবি এঁকেছি। বাঘ আমার কাছে শুধু একটি প্রাণী নয়, আমাদের সংস্কৃতি ও গৌরবের প্রতীক। এই বাঘের জন্যই লোকে আমাকে ‘পটুয়া টাইগার নাজির’ বলে চেনে। বাঘের মাধ্যমেই দেশের কথা বলি, আর এই বাঘের ছবি এঁকেই আমি বিশ্বরেকর্ড করতে চাই। বাঘ আমার শিল্পজীবন, আমার পরিচিতি।

বন্ধুসভা: দশ বছরের মধ্যে পটশিল্প ও লোকশিল্পকে কোথায় দেখতে চান? সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য আপনার পরিকল্পনা কী?

পটুয়া নাজির: দশ বছরের মধ্যে দেখতে চাই, লোকশিল্প ও লোকশিল্পী—দুটোই ক্ষমতাবানদের সুনজরে আসবে। আমাদের মতো পথের শিল্পীরা যেন সঠিক মর্যাদা পায়। ঢাকা শহরের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় লোকশিল্পের বড় বড় স্থাপনা হবে। আমাদের নতুন প্রজন্ম যেন এই হাজার বছরের সংস্কৃতিকে ক্রংক্রিটের শহরেও দেখতে পায়।

এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে বিনা মূল্যে ছবি আঁকা শেখানো চালিয়ে যাব এবং ফুটপাতে বসে সাধারণ মানুষের মধ্যে শিল্পের সৌন্দর্য ছড়িয়ে দেব। আশা করি, দেশের শিল্পরসিকগণও একদিন লোকশিল্পকে সেই মর্যাদায় নিয়ে যাবেন।