দ্রুত বদলে যাওয়া সমাজব্যবস্থায় শহুরে নিম্নমধ্যবিত্ত একটি পরিবারের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ের জলজ্যান্ত ছবি উঠে আসে ‘নিরন্তর’ চলচ্চিত্রে। এর নির্মাণশৈলী এমনই, দেখলে মনেই হয় না সামনে কেউ অভিনয় করেছেন, টুকরো টুকরো দৃশ্য ক্যামেরায় কেউ ধারণ করেছেন। চেনা পরিচিত জগৎ, প্রাত্যহিক জীবনটায় যেন চোখের সামনে দিয়ে বয়ে গেছে।
বড় লেখকদের সবচেয়ে বড় গুণ এখানেই, তাঁরা অত্যন্ত সহজ করে প্রতিদিনের অসংখ্য চেনা পরিচিত মানুষের যাপিত জীবনের কথা লিখে যেতে পারেন। আর বড় পরিচালক সেই জীবন পরিক্রমাকে সরলভাবে চিত্রায়িত করে যেতে পারেন।
কালজয়ী কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের ‘জনম জনম’ উপন্যাসকে চলচ্চিত্রায়িত করেছেন মননশীল পরিচালক আবু সাইয়ীদ। চিত্রনাট্য, সংলাপ রচনায় এই দক্ষ পরিচালককে সাহায্য করেছেন হুমায়ূন আহমেদ নিজে। ফলে একটি সার্থক সৃষ্টি মনের দোরগোড়ায় এসে কড়া নেড়েছে। অনবদ্য সাহিত্যের খুঁটিনাটি সৃজনশীলতা মননশীল দৃশ্যগ্রাহ্য হয়ে উঠেছে।
সমাজের দুস্থ–পীড়িত নারীদের পতিতাবৃত্তি একটি আদিম পেশা। সাধারণত এই পেশার নারীরা জোটবদ্ধ হয়ে একই সঙ্গে বাস করার চেষ্টা করে। পারিপার্শ্বিক আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য সংঘবদ্ধ একটি অঞ্চল গড়ে তোলে। কিন্তু হঠাৎ পরিবর্তনশীল শহুরে সমাজব্যবস্থায় আমরা দেখলাম, নিম্নবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে নিজের ঘরের মধ্যে সামাজিক জীবনে থেকেও এই অসামাজিক পেশায় যুক্ত হচ্ছে। খদ্দেরের সঙ্গে সহবাস করে এসে আবার পারিবারিক জীবনে মিশে যাচ্ছে। তাদেরকে এই পেশায় সাহায্য করছে যে ব্যক্তি, সে–ও কিন্তু সে অর্থে মধুচক্রের দালাল নয়। নিজের অভাবের তাড়নায় চিরাচরিত সংসার সমাজজীবনে থেকেই এ ধরনের অপেশাদার, অনৈতিক কাজ করে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে একদিকে সামাজিক জাত, কুল, মান, নীতিনৈতিকতা পুরোপুরি ত্যাগ করতে পারছে না, আবার পেটের তাগিদে শত অপমান সহ্য করেও কাজটা করে যেতে হচ্ছে। ফলে এই পতিতা এবং তাদের দালাল দুজনেই মানসিকভাবে একপ্রকার বিধ্বস্ত। নিরন্তর আত্মদহনে দগ্ধ।
এখানে দালাল নাসিমকে যেমন আমরা দেখি, অসুস্থ হয়ে হাসপাতালের বেডে দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসাধীন রয়েছে আর নিজের শরীরের অঙ্গে পচন ধরার জন্য দায়ী করছে নিজের পেশার পাপকে। এমনই আত্মগ্লানি প্রতিনিয়ত কুরে কুরে বেদনা জাগায়, সভ্য সমাজে তথাকথিত বেশ্যা হয়ে যাওয়া তিথির মনেও। নিজের মা তার শরীরে এসে স্নেহের হাত রাখতে চাইলেও তার ভালো লাগে না। মনে হয় যেন কোনো পুরুষ খদ্দের হাত দিচ্ছে। রাগের বশে ঘরে সে কারও সঙ্গে সুন্দর কথা বলে না। কারণ, যৌনলালসা–কাতর পুরুষ খদ্দেরের সঙ্গে মিষ্টি করে কথা বলাটা হয়ে উঠেছে তার পেশা।
অথচ সে এক সভ্য ভদ্র পরিবারের প্রাণবন্ত কিশোরী ছিল। পরিবারের অভাবের তাড়নায় বাবার চিঠি নিয়ে বাবার বন্ধুর কাছে টাকা ধার আনতে গেলে সেই স্বজন ব্যক্তির যৌনলালসার শিকার হতে হয়েছে। বান্ধবীর সঙ্গে খেলা করে বেড়ানোর সময় কামুক পুরুষ লুঙ্গি তুলে দেখিয়েছে। গোটা কামুক প্রবৃত্তির পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় এভাবেই পচন ধরে দিনের পর দিন, পেটের খিদের তাড়নায় সংসারের হাল ধরতে বাধ্য হয়ে সে যখন পতিতাবৃত্তি বেছে নেয়, সমাজের চোখে হয়ে ওঠে নষ্ট মেয়েমানুষ।
তিথি চরিত্রে শাবনূরকে মনে রাখতে হবে বহুদিন। ঘর এবং বাহির, নষ্ট পেশা এবং ঘরোয়া জীবন এই যে দ্বন্দ্ব, এই যে অন্তর্ঘাত, ভাঙচুর শাবনূরের অভিনয়ে সাবলীলভাবে উঠে এসেছে। একইভাবে দালাল নাসিম চরিত্রে জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়ও বড়মাপের অভিনেতার পরিচয় দিয়েছেন।
শুধু পতিতা এবং দালাল নয়, এই পতিতাদের নানা মানসিকতার খদ্দেরের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেও আমাদের সাহায্য করেন লেখক এবং পরিচালক। লাস্যময়ী তিথির সঙ্গে কোনো খদ্দের আগে নাচে, নাচে গানে মাদকের নেশা বেড়ে ওঠে। তথাকথিত শহুরে বাবুরা এই পাড়ায় গিয়ে নৃত্যগীতও উপভোগ করে, পতিতাদের সৃজনশীল হতে হয়—সেই বাবুর মাধ্যমে সংস্কৃতির বিবর্তিত সংস্করণ উঠে আসে। কোনো খুনি মাস্তান খদ্দের বেশিক্ষণ ধরে শুধু শরীরটায় ভোগ করতে চায়। আবার এমন খদ্দেরও সামনে চলে আসে, তিথি শরীরে ভোলাতে চাইলেও সে ভোলে না। ঘরে তার অসুস্থ স্ত্রী আছে। সেই স্ত্রীর কাছে সে একান্ত বিশ্বাসযোগ্য স্বামী। পতিতার কাছে হঠাৎ এসে গেছে শুধু একটু মানসিক শান্তি, অন্য রকম একটা সহায় বা ক্ষণিকের বন্ধুত্বের আশ্রয়ে।
আমরা কি কখনো ভাবতে পারি, একজন সজ্জন ব্যক্তির বরাবরের ঘরোয়া সজ্জন মরণাপন্ন স্ত্রী মৃত্যুর আগে নিজের জমানো অর্থ তথাকথিত একজন বেশ্যার জন্য রেখে যেতে পারে? কারণ, তিথির মধ্যেও সে এমন মানুষের সন্ধান পেয়েছে, বিনা পরিশ্রমে যে কোনো অর্থ নেয় না। আবার তিথির কথাবার্তা, ব্যক্তিত্বের মধ্যেও জীবনের অনেক অর্থ লুকিয়ে থাকে, যা অর্থ দিয়েও কেনা যায় না।
হুমায়ূন আহমেদের মতো লেখক এখানে আমাদের জন্যও ভাবনার খোরাক রেখে দিয়ে যান। মরণাপন্ন স্ত্রী কি এমনটাও ভাবতে পারে না যে তার মৃত্যুর পরে তিথি এসে এই ভেসে যাওয়া পরিবারের পাশে দাঁড়াবে! স্বামী ক্ষণিকের আশ্রয়ে যার কাছে গিয়েছিল, বেশ্যা হলেও সে–ও একজন মানুষ, সে–ও একজন বন্ধু। এমন বন্ধু পরিবারের গোটা জীবনের আশ্রয় হয়ে দাঁড়াবে!
দবীর উদ্দিনের স্ত্রীর দিয়ে যাওয়া অর্থে তিথির পরিবারের দারিদ্র্য ঘুচে যায়। বেকার ভাই যে কি না সংসারের কোনো কাজেই লাগেনি কোনো দিন, উল্টে অ্যানা নামের একটি মেয়ে বিয়ের আসর ছেড়ে পালিয়ে এসেছে বেকার ভাইয়ের সঙ্গে থাকতে। সেই বেকার ছেলেটি রেস্টুরেন্ট খুলে সফল মানুষে পরিণত হয়। কার ছেড়ে যাওয়া অস্তিত্বে কার যে কীভাবে প্রসার ঘটে, এ–ও যেন এক ম্যাজিক।
তিথির অন্ধ বাবাকে ভালো লাগে। অকর্মণ্য বৃদ্ধ বাবা মাঝেমধ্যে দার্শনিকের মতো কথা বলে। যেমন মানুষ হলো তিন রকম—আগুন মানুষ, মাটি মানুষ ও জল মানুষ। সারা জীবনের অর্জিত জ্ঞানে তার কথায় বিজ্ঞানচেতনা এবং যুক্তিবোধও থাকে। যেমন ঘুমন্ত সন্তানকে মারতে নেই, মস্তিষ্কে স্নায়ুতে গিয়ে আঘাত করে। যদিও এই অকেজো ব্যক্তির কথা সবার কাছে শুধুই বকবকানি মনে হয়। বাবা চরিত্রে আমিরুল হক চৌধুরীর সংলাপ বলার ধরন অসাধারণ। তিথির মায়ের চরিত্রে ডলি জহুর, পরিচালক জহুরীর চোখে জহর চেনার মতো। এই ধরনের চলচ্চিত্রে শিল্পী সত্তা মেলে ধরার সুযোগ থাকে সবচেয়ে বেশি। বর্ষীয়ান অভিনেত্রী নিজের দ্যুতি ছড়িয়েছেন। ইলিয়াস কাঞ্চনের মতো বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগের নায়ককে যে দবীর উদ্দিন চরিত্রে নিয়ে আসা যেতে পারে এই ভাবনাটা অসাধারণ। টানটান গতিশীল চলচ্চিত্রের অভিনেতারাও স্থির মন্থরগতির চলচ্চিত্রে এসে নিজেদের ভেতরেও ভিন্ন ভিন্ন মাত্রার সত্তাকে প্রকাশ করতে পারেন, একজন বড়মাপের শিল্পীর মধ্যে রংধনুর মতো রঙের বিচ্ছুরণ লুকিয়ে থাকে ইলিয়াস কাঞ্চন আরও একবার প্রমাণ করেছেন। দবীর উদ্দিনের সততা, শূন্যতা, একাকিত্ব এবং ভদ্র অমায়িক ব্যবহার কাঞ্চনের অভিনয়ে মন ছুঁয়ে গেছে।
হিরু চরিত্রে লিটু আনাম, অ্যানা চরিত্রে লিমাকেও ভালো লাগে। অতিথি শিল্পী তিথির খদ্দের হয়ে এসেছেন শহিদুল আলম সাচ্চু। এই চলচ্চিত্রের সুন্দর গান লিখেছেন কবির বকুল। সুরকার এস আই টুটুল। মজিবুল হক ভূঁইয়ার চিত্রগ্রহণ অনেক উচ্চমানের। প্রতিটি কারিগরি দক্ষতার গুণে আবু সাইয়ীদের শৈল্পিক এই চলচ্চিত্র ইতিহাসের একটি পালক হয়ে রইল। হুমায়ূনের সৃষ্টিধারা এভাবেই নিরন্তর বয়ে যায়।
হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত