বাসরঘরে রাতে দরজা বন্ধ করে স্ত্রীকে বুকে জড়িয়ে ধরে স্বামী কাঁদছে—এমনটা আমরা কখনো কল্পনাও করতে পেরেছি? ‘দুখাই’ চলচ্চিত্রে দুখু মিঞা তার স্ত্রী বুলিকে কাছে টেনে নিয়ে এভাবেই কেঁদেছে। দুখু একজন শত ভঙ্গুর মানুষ। এ ধরনের ছিন্নভিন্ন মানুষের জীবন–ছবি তুলে আনাই একজন সংবেদনশীল পরিচালকের কাজ। ১৯৭০ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের ইতিহাসের একটা গুরুত্বপূর্ণ সময়কে রীতিমতো ঐতিহাসিক দলিল করে রেখেছেন বিকল্প ধারার চলচ্চিত্রের মননশীল পরিচালক মোরশেদুল ইসলাম। নদীমাতৃক বঙ্গদেশে সাগরপারের মানুষের আজীবনের লড়াই–সংগ্রাম, ভাঙন, অস্তিত্বের সংকটের জলজ্যান্ত ছবি উঠে এসেছে এই চলচ্চিত্রে।
একেবারে শেষের দিকে এসে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, প্রবল ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসের যে চিত্রায়ণ তুলে আনা হয়েছে, এ রকম সংকটাপন্ন যমে-মানুষে টানাটানিতে ভেসে চলার দৃশ্য বাংলাদেশের উপকূলবর্তী মানুষের জীবনের বাস্তব দলিল; কিন্তু চলচ্চিত্রে এভাবে তুলে নিয়ে আসা বড়ই কঠিন। বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে স্থান পাওয়ার মতো এই দৃশ্য ‘টাইটানিক’ চলচ্চিত্রকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল। ভাবতেও অবাক লাগে, ঠিক একই সময়ে বসে আমাদের বাংলাদেশের মোরশেদুল ইসলাম সীমিত ক্ষমতায় ‘দুখাই’ নির্মাণ করেছেন। পরিচালকের দক্ষ চিত্রনাট্য, আঞ্চলিক সংলাপ, অসামান্য পরিচালনায় এই চলচ্চিত্র গোটা দীর্ঘ একটা ইতিহাসকে বিনা সুতার মালায় গেঁথে ফেলেছে।
এম এ মোবিনের মতো মানুষ যখন চিত্রকল্প, দৃশ্যকল্পগুলো ধারণ করেন, সাইদুল ইসলাম টুটুলের মতো কিংবদন্তি পরিচালক সম্পাদনা করেন, মহিউদ্দিন ফারুক শিল্প নির্দেশক হন, পুলক গুপ্ত আবহসংগীত পরিচালনা করেন, তখন এই ছবিকে সফল হতে হবেই এবং হয়েছেও। দুখু মিঞার চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেছেন আজীবনের লড়াকু অভিনেতা রাইসুল ইসলাম আসাদ। স্ত্রী বুলির চরিত্রে সংবেদনশীল অভিনয় করেছেন কিংবদন্তি লড়াকু অভিনেত্রী রোকেয়া প্রাচী। দুখাই আর বুলির একমাত্র বেঁচে থাকা কন্যাসন্তান সুখাইয়ের চরিত্রে অভিনয়ে চমক ছড়িয়েছেন চাঁদনী। কিংবদন্তি অভিনেতা আবুল খায়েরকে এখানে আমরা পেয়েছি গ্রামের এক বৃদ্ধ ভবঘুরে ভবপাড়ের সন্তানরূপে। শেষ দৃশ্যে বিজয় সরকারের গান ব্যবহার করা হয়েছে কিরণ চন্দ্র রায়ের কণ্ঠে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ঠিক এক বছর আগে ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর যে ভয়ংকর শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়ে, ৫ থেকে ১০ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। অথচ পাকিস্তান সরকার এত মানুষের মৃত্যুতেও বাঙালিদের ওপরে শোষণ–পীড়ন বন্ধ করেনি। এই প্রবল প্রাণঘাতী ঝড়ে সাগরপারের সন্তান দুখু তার মা, বাবা, প্রাণপ্রিয় বোন, ভাই সবাইকে হারিয়ে ফেলে। জীবনের শত আঘাত, মৃত্যু, ভাঙনের মধ্যেও বহতা স্রোতের মতো লড়াই জারি রাখাই সাগরপারের মানুষের যাপনের ধর্ম।
একলা দুখু বুকে অতল শোক নিয়েও আবার বেদনার ঘর বাঁধে। বিয়ে করে বউ আনে। দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। শেখ মুজিবের ভাষণের পর্ব থেকে মুক্তিযুদ্ধকালীন পরিস্থিতি কিছু দৃশ্য নির্মাণ করে, কিছু বাস্তব ছবি ব্যবহার করে, গ্রামীণ মানুষের জীবনে তার প্রভাব পরিচালক ধাপে ধাপে তুলে আনেন। এই পরিস্থিতির মধ্যেই দুখুর ঘর আলো করে কন্যাসন্তান আসে। গ্রামীণ সহজ–সরল মানুষের সাধারণ জীবন–ছবি এই চলচ্চিত্রের অমূল্য সম্পদ। গ্রামীণ আঁতুড়ঘরে ধাইমা যেভাবে যে সামান্য ব্যবস্থাপনার মধ্যে সন্তান প্রসব করান, তা হুবহু উঠে আসে।
আবার দুখু যখন বিয়ে করতে গিয়েছিল, কনেবাড়ির ছোট ছেলেমেয়েরা বিয়ের গেটে ফিতা ধরে বরপক্ষের কাছে টাকা চাইছে; বিয়ের শেষে বাপের বাড়ি ছেড়ে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সময় কনে কাঁদছে—এই চিরাচরিত দৃশ্যে গ্রামবাংলার হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের বিয়ের রীতি উঠে আসে। পরবর্তী সময়ে দুখু যখন শ্বশুরবাড়িতে যায়, ছোট্ট শ্যালিকা এসে দুলাভাইকে ডাবের পানি খেতে দেয়। দাওয়ায় বসে শ্বশুর গড় গড় করে হুঁকা টানে—এগুলোই তো বাস্তবোচিত শিল্প। এই চলচ্চিত্রের প্রতিটি সেট নির্মাণের প্রশংসা না করে পারা যায় না।
৩০ লাখ মানুষের রক্ত, মা–বোনের সম্ভ্রম হারানো এবং লাখ লাখ উদ্বাস্তুর দেশছাড়ার যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হয়। স্বাধীন দেশে বড় হতে থাকে দুখুর কন্যা। দুখুর হারানো বোনের মতোই এই কন্যা চঞ্চলা, চপলা, সুন্দরী, গ্রাম্য কিশোরী। এক পরিবারের দুই প্রজন্মের দুই কন্যাকে এত সুন্দর করে তুলে নিয়ে আসা, চলচ্চিত্রব্রতী মানুষের সৌন্দর্য সাধনার ফসল। সুখাইয়ের বিয়ে ঠিক হয়ে যায়। দুখু কন্যার জন্য রংবেরঙের শাড়ি কেনে, টাকা ধার করে স্বর্ণালংকার নিয়ে আসে।
১৯৮৫ সালের ২৪ মে আবার দানবীয় ঘূর্ণিঝড় এসে প্রাকৃতিক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে ছিনিয়ে নিয়ে যায় জীবন। তিলে তিলে গড়ে ওঠা দুখুর সব স্বপ্ন ভেঙে তছনছ হয়ে যায়। স্ত্রী–সন্তান দুজনই মারা যায়। এ এক দুঃখের নির্মম কাহিনি। ঝড়ঝঞ্ঝা, যুদ্ধ, দুর্যোগ—সবকিছুর কাছেই মানুষ যে বড় অসহায়। মোরশেদুল ইসলাম সেই অসহায় জীবনের হৃদয় বিগলিত শৈল্পিক ছবি তুলে এনেছেন ‘দুখাই’ চলচ্চিত্রে। প্রত্যেক শিল্পীর অনবদ্য অভিনয় এবং কলাকুশলীদের কারুকার্যে প্রাণ পেয়েছে এই ছবি। যা আবহমান কালের বেদনার ক্ষত, দলিল হয়ে রইল।
হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত