পিচ্ছিল পথ মাড়িয়ে চন্দ্রনাথের চূড়ায়

চন্দ্রনাথ পাহাড়ের চূড়ায় আমরা

চন্দ্রনাথ পাহাড়ের উচ্চতা কত? কোথাও আছে ১ হাজার ২০০ ফুট, কেউ বলে ১ হাজার ১৫২ ফুট, আবার কোথাও উল্লেখ আছে ১ হাজার ২০ ফুট। পাহাড়ের সর্বোচ্চ চূড়ায় চন্দ্রনাথ মন্দির অবস্থিত। এটি হিন্দুধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান। পাহাড়ে ওঠার শুরুর দিকে অনেকটা উঁচু পর্যন্ত ইট-সিমেন্টের ঢালাই করা রাস্তা। এর আশপাশে হিন্দুদের বেশ কয়েকটি ধর্মীয় স্থাপনা রয়েছে। ঢালাই পথ পাড়ি দেওয়ার পর ছোট একটি ঝরনা দেখা যায়। মূলত এই ঝরনার কাছ থেকেই পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার আসল পথ শুরু। এখান থেকে দুটি পথ সিঁড়ি আকারে দুই দিকে চলে গেছে। বাঁ দিকের পথ দিয়ে চূড়ায় ওঠা তুলনামূলক সহজ। সবাই এই পথ দিয়েই ওপরে ওঠেন। অন্যদিকে ডান দিকের পথ দিয়ে চূড়া থেকে নিচে নেমে আসেন সবাই।

একে তো বর্ষাকাল, তার ওপরে ওই দিন ভোরে বৃষ্টি হয়েছিল। এ কারণে ট্র্যাকিংয়ের সম্পূর্ণ পথটি কাদা ও পিচ্ছিল হয়ে আছে। প্রথমবার যাঁরা যান, তাঁদের সাধারণত ট্র্যাকিংয়ের পথের দূরত্ব নিয়ে তেমন ধারণা থাকে না। আমার ক্ষেত্রে যেমনটা হয়েছিল; ঝরনা পর্যন্ত গিয়ে মনে হলো হয়তো চূড়ার কাছাকাছি চলে এসেছি! এই ভেবে সেখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিচ্ছিলাম, তখন এক লোক বললেন, মাত্র ১০ শতাংশ ওপরে উঠেছেন! চূড়া পর্যন্ত যেতে আরও ৯০ শতাংশ পথ বাকি।
এদিকে আমার ভ্রমণসঙ্গীরা সবাই পেছনে পড়ে যায়। নিচে যত দূর চোখ যায়, কাউকেই দেখা যাচ্ছিল না। মনে মনে বললাম, অপেক্ষা না করে ওপরে উঠতে থাকি। কিছুটা ওপরে ওঠার পর আবারও বিশ্রামের জন্য বসলাম। ভাবলাম, অন্যদের জন্যও অপেক্ষা করি। দেখি কেউ আসে কি না।

ট্র্যাকিং শুরু করার সময় ইচ্ছা ছিল সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে চন্দ্রনাথ জয় করব। কিছুটা পথ হাঁটার পর সেই ইচ্ছা জলাঞ্জলি দিতে হলো। অন্যদের হাঁটার গতি অনেক ধীর এবং কিছুক্ষণ পরপর তারা ছবি তোলার জন্য দাঁড়াচ্ছিল, যা আমার মোটেই পছন্দ নয়। তাই কারও জন্য অপেক্ষা না করে নিজের স্বাভাবিক গতিতেই হাঁটা শুরু করি। এ নিয়ে পরে অবশ্য সবাই বলছিল আমি নাকি স্বার্থপর!

যাহোক, প্রায় ২০ মিনিটের মতো একটি স্থানে বিশ্রাম নিই, সেই সঙ্গে অন্যদের জন্য অপেক্ষা করা। এরই মধ্যে জাহিদ ফেরদৌস ও আরিফ আদনানকে দেখতে পাই। জিজ্ঞাসা করলাম, অন্যরা কই? জানাল, আরও অনেক পেছনে। তাদের সঙ্গে আবার ট্র্যাকিং শুরু করি। পথ যেন শেষই হচ্ছিল না। এদিকে পায়ের অবস্থা খারাপ, চলতে চাচ্ছে না। কাঁধের ব্যাগে যে পানি ছিল, সেটাও শেষ হয়ে আসে। কিছুটা ওপরে ওঠার পর আবারও বিশ্রাম। সেখানে ছোট টংদোকান রয়েছে। আরিফ এক বোতল পানি কিনে নেয়। পুনরায় শুরু হলো যাত্রা। বেশিক্ষণ বিশ্রাম নিলে তখন আবার চলতে কষ্ট হবে। পা দুটি বলছিল, ‘আর না, এবার থামতে হবে।’ মন বলছিল, ‘থামা যাবে না। যত উঁচুতেই হোক, চূড়ায় উঠতেই হবে।’

চন্দ্রনাথ মন্দিরের সামনে

জাহিদ ও আরিফের হাঁটার গতি এত দ্রুত ছিল যে তারা আমাকে পেছনে রেখে অনেক আগে চলে যায়। চন্দ্রনাথে মোট দুটি মন্দির। চূড়ায় ওঠার পথে প্রথমে একটি মন্দির, সবাই এটিকে ছোট মন্দির বলে। সর্বোচ্চ চূড়ায় বড় মন্দির। ছোট মন্দির পর্যন্ত উঠে আবারও বিশ্রাম নিলাম। সেখানে আমার মতো আরও অনেকেই বিশ্রাম নিচ্ছে। কিছুক্ষণ বসার পর দেখা পেলাম নাঈমা সুলতানা ও তার ভাই মিলনের। তারাও বিশ্রাম নিল কিছুক্ষণ। টংদোকান ছিল, সেখান থেকে কলা খেলাম ও পানি পান করলাম। এরপর আবার ট্র্যাকিং শুরু। পা দুটি এবার মোটেই সাড়া দিচ্ছিল না। তবে থামা যাবে না। কিছুটা ওপরে উঠে, কিছু সময় বিশ্রাম নিয়ে আবারও ট্র্যাকিং। এভাবে করতে করতে একটা সময় সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছে যাই। সেখানে দেখা পেলাম আরিফ ও জাহিদের।

প্রথমবার চন্দ্রনাথ জয়। ছবি তুলে সেই স্মৃতি সংরক্ষণ করে রাখলাম। চূড়া থেকে চারপাশের প্রকৃতি ও পরিবেশ এতটাই মনোমুগ্ধকর ছিল যে তা বর্ণনা করলে ঠিক অনুভব করা যাবে না। সেখানে গিয়ে স্বচক্ষে দেখে অনুভব করতে হবে। এক পাশে যত দূর চোখ যায়, পাহাড় আর পাহাড়; অন্য পাশে সমুদ্র। পুরো পরিবেশটা সবুজ বেষ্টনীর সৌন্দর্যে ঘেরা। প্রায় ২০ মিনিটের মতো চূড়ায় সৌন্দর্য উপভোগ করি।

তিন.
এবার নেমে আসার পালা। তার আগে গ্রুপের অন্যদের কল দেওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু কারও মুঠোফোনে সংযোগ হচ্ছিল না। অনেক বেশি পর্যটকের কারণে নেটওয়ার্কে সমস্যা হচ্ছিল। আরিফ ও জাহিদ চূড়াতে থেকে যায়। তাদের রেখে আমি, মিলন ও নাঈমা নিচে নেমে আসি।

নেমে আসার পথ যতটা সহজ ভেবেছিলাম, ততটা সহজ ছিল না। প্রতিটি মুহূর্ত ভয়ংকর ছিল। বৃষ্টির কারণে সিঁড়িগুলো অনেক পিচ্ছিল ও কর্দমাক্ত হয়ে যায়। মনোযোগ একটু বিঘ্নিত হলেই বিপদ হওয়ার আশঙ্কা। পথও যেন শেষ হতে চাইছিল না। কিছুটা নিচে নামার পর মনে হয়, এই বুঝি পিচ্ছিল পথটা শেষ হলো! কিন্তু না, দেখা গেল পথের আরও অনেকটা বাকি। আবার একটু বিশ্রাম নেব, সেই সুযোগও ছিল না। নামার পথে যেন পর্যটকদের মিছিল লেগেছে! ভয়ংকর পথ মাড়িয়ে অবশেষে সুস্থভাবে নেমে আসতে সক্ষম হই।

আরও পড়ুন

সমতল ভূমিতে যখন নেমে আসি, ঘড়ির কাঁটায় তখন বেলা প্রায় দুইটা। খায়রুন্নাহার খেয়া আপু ও শাহরিয়ার সাদিকে সেখানে দেখতে পাই। খেয়া আপু পাহাড়ে ওঠেননি। সাদি জানাল, সে অনেকটা উঁচুতে উঠেছিল, তারপর একই পথ দিয়ে নেমে আসে। দলের অন্যরা তখনো এসে পৌঁছায়নি। আরও আধঘণ্টা পর তারা নিচে নেমে আসে। এই দলে ছিল আশিকুর রহমান, সাফিন উজ জামান, জাহিদ ফেরদৌস, আরিফ আদনান, অনিক সরকার, মেঘা খেতান, সানজিদ ত্বোহা, শারমিন আরা তৃষা, ওয়াসিমা তাসনিম ও তানজিব সরোয়ার।

সাধারণত চন্দ্রনাথ পাহাড় সম্পূর্ণ ট্র্যাকিং করতে দুই ঘণ্টার মতো সময় লাগে। পিচ্ছিল পথের কারণে আমাদের ক্ষেত্রে সে সময়টা অনেক বেশি লেগে যায়। ভ্রমণের পরিকল্পনায় ছিল তিনটি স্পটে যাওয়া—চন্দ্রনাথ পাহাড়, কমলদহ ঝরনা ও গুলিয়াখালী সি বিচ। চন্দ্রনাথ পাহাড়ে সময় বেশি লাগায় সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হলো। কমলদহ ঝরনায় গেলে সময় আর কাভার করা যাবে না। সিদ্ধান্ত হলো ইকোপার্ক দিয়ে সুপ্তধারা ঝরনায় যাওয়া হবে। যদি সময় থাকে, তারপর সেখান থেকে গুলিয়াখালী সি বিচ।

এদিকে সবাই ক্লান্ত। ক্ষুধাও লেগেছে। তিনটি সিএনজি নিয়ে আমরা চলে যাই সীতাকুণ্ড ইকোপার্ক গেটে। সেখানে একটি রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার খেয়ে নিই। সিএনজি ভাড়া ২৭০ টাকা করে।

চলবে…