তূর্ণায় করে পাহাড় ও ঝরনায়

তূর্ণা এক্সপ্রেসে ভ্রমণসঙ্গীরা

অফিস থেকে বের হই রাত সাড়ে ৯টার কিছু আগে। পরিকল্পনা মেট্রোরেলে করে মতিঝিল যাওয়া এবং সেখান থেকে রিকশায় কমলাপুর। মেট্রোরেলের কারওয়ান বাজার স্টেশন অফিসের পাশেই। যখন সিঁড়ি দিয়ে স্টেশনে উঠতে যাব, দেখলাম, মাত্রই একটি ট্রেন মতিঝিলের উদ্দেশে চলে গেছে। ভাবলাম, পরের ট্রেনটাই ধরতে পারব। ওপরে ওঠে জানতে পারি, ট্রেন আর নেই। মতিঝিলগামী শেষ কোচটি এরই মধ্যে চলে গেছে। কী আর করার! জরিমানা পরিশোধ করে নিচে নামতে হলো।

সার্ক ফোয়ারা মোড় থেকে একটি মোটরবাইক নিলাম। ভাগ্য ভালো, রাস্তায় জ্যামের কবলে পড়তে হয়নি। মাত্র ১৫ মিনিটে কমলাপুর রেলস্টেশন পৌঁছে গেলাম।
ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি, ৯টা ৫০ মিনিট। ট্রেন ছাড়ার কথা ১১টা ১৫ মিনিটে; অর্থাৎ হাতে আরও দেড় ঘণ্টা সময়। স্টেশনে না ঢুকে চলে গেলাম রাতের খাবার কিনতে। অল্প কিছু খাবার কিনে স্টেশনে ঢুকে যাই। এবার অপেক্ষা করার পালা। আমরা ১৫ জন। গন্তব্য চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড, তূর্ণা এক্সপ্রেসে করে। তবে ট্রেন দিয়ে যাব ফেনী জংশন পর্যন্ত, বাকিটা বাসযাত্রা। স্টেশনে সবার আগে আমি এসেছি। বাকিরা পথে। কিছুক্ষণের মধ্যে তারাও চলে আসে। পাঁচজন উঠবে বিমানবন্দর স্টেশন থেকে।

ভ্রমণের শিরোনামটা গ্রুপের সবাই মিলে ঠিক করে আগেই। এ নামে প্রত্যেকের জন্য টি-শার্টও তৈরি করা হয়।

ট্রেন ছাড়তে ছাড়তে রাত ১২টা বেজে যায়। এদিকে আরেক ঝামেলা! আমাদের ১০ জনের সিট এক বগিতে, বাকিদের অন্য আরও দুটি বগিতে। কিন্তু সবার একসঙ্গে যাওয়ার ইচ্ছে। যাত্রাপথের আনন্দটা মিস দেওয়া যাবে না যে! এদিকে আমাদের ভ্রমণ সমন্বয়ক অনিক সরকার চেষ্টা করে যাচ্ছে সবাইকে একই বগিতে পাশাপাশি সিটে নিয়ে আসার। এ জন্য সে অন্য যাত্রীদের সঙ্গে সিট এক্সচেঞ্জ করার চেষ্টা করছে। কেউ রাজি হয়, কেউ রাজি হয় না; আবার কেউ রাজি হলেও আবদার করে জানালার পাশে সিট হতে হবে! অদ্ভুত এক সমস্যা। শেষ পর্যন্ত ১৪ জনের সিট একসঙ্গে করা সম্ভব হয়। শুরু হলো আমাদের আনন্দযাত্রা, ‘ভ্রমণ এবার তূর্ণায়, সীতাকুণ্ডের ঝরনায়’।

ভ্রমণের শিরোনামটা গ্রুপের সবাই মিলে ঠিক করে আগেই। এ নামে প্রত্যেকের জন্য টি-শার্টও তৈরি করা হয়। ট্রেন ছাড়তেই সবাইকে টি-শার্ট বুঝিয়ে দেয় আরেক সমন্বয়ক মেঘা খেতান। সঙ্গে একটি গিটারও নেওয়া হয়। এদিকে নাঈমা সুলতানা নতুন একটি সাউন্ড বক্স কিনে আনে, যাত্রাপথে গান শোনার জন্য। কিন্তু অন্য যাত্রীদের অসুবিধা হবে ভেবে সাউন্ড বক্স আর বাজানো হয়নি। এ নিয়ে তার আক্ষেপ, শুধু শুধুই তাড়াহুড়ো করে কেনা হলো! সাউন্ড বক্স বাজানো যায়নি তো কী হয়েছে, ছোট্ট গিটারে সুর তোলে অনিক। তার সঙ্গে কণ্ঠ মেলায় বাকিরা। এই আনন্দও বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। অন্য যাত্রীরা আপত্তি জানান, তাঁদের ঘুমাতে অসুবিধা হচ্ছে। কী আর করার! গানবাজনা বন্ধ করতে হলো। ট্রেন ততক্ষণে নরসিংদী রেলস্টেশন পার হয়ে যায়। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ ঘুমানোর চেষ্টা করছে। আবার কারও কানে ইয়ারফোন। আমি দুই দলেই ছিলাম। কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা। যদিও ঘুম আর হয়নি, কিছুক্ষণের জন্য চোখ লেগে এসেছিল।

ফেনী জংশনে সবাই
ছবি: বিজয় নাথ

১২ জুলাই ভোর চারটায় ফেনী জংশনে নেমে যাই। চারদিকে অন্ধকার। জংশনেও তেমন লোক নেই। গুটিকয় মানুষ ছিলেন, তাঁরা ঘুমাচ্ছেন। একটি দোকান খোলা ছিল। আমি ছাড়া বাকি সবাই সেখানে হালকা চা-নাশতা সেরে নেন। ধীরে ধীরে চারপাশ আলোকিত হতে থাকে, আর চলতে থাকে আমাদের আড্ডা। কারও মধ্যেই ভ্রমণক্লান্তি নেই; যেন যাত্রা কেবল শুরু হলো। চারপাশ আরও একটু আলোকিত হলে আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসেন ফেনী বন্ধুসভার সভাপতি বিজয় নাথ দাদা। সবাই তাঁর সঙ্গে পরিচিত হয়ে নেয়। ঘড়ির কাঁটায় ভোর ৬টা। তিনটি অটোরিকশা নিয়ে তিনিসহ আমরা চলে যাই মহিপাল বাসস্ট্যান্ডে। সেখান থেকে বিজয় নাথ দাদা বিদায় নেন, আর আমরা চট্টগ্রামগামী একটি বাসে উঠে যাই। জনপ্রতি ভাড়া ৭০ টাকা। আগেই দরদাম করে নিতে হয়। নয়তো আরও বেশি ভাড়া নিতে পারে। সীতাকুণ্ডে পৌঁছাতে এক ঘণ্টার যাত্রাপথ। এই সময়টুকুতে কেউ কেউ বাসে ঘুমিয়ে নেয়।

দুই.
সীতাকুণ্ডে পৌঁছাতে সকাল সাড়ে সাতটার মতো বেজে যায়। সারা দিন ট্র্যাকিং করতে হবে, তাই সবাই একটু ফ্রেশ হয়ে নিতে চাইছিল। পরিকল্পনায় হোটেল ভাড়া নেওয়ার কথা ছিল না। সবার আগ্রহে পৌর শহরেই একটি হোটেলের একটা রুম ভাড়া নেওয়া হয়। সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত। ভাড়া ৮০০ টাকা।

চন্দ্রনাথ পাহাড়ে ওঠার প্রস্তুতি

শুরুতেই মেয়েরা ফ্রেশ হয়ে নেয় এবং ট্র্যাকিংয়ের জন্য তৈরি হয়। ছেলেরা তখন বাইরে অপেক্ষা করে। তারপর পালাক্রমে ছেলেরাও ফ্রেশ হয়ে তৈরি হয়। পরে হোটেলের নিচেই একটি রেস্টুরেন্টে সকালের নাশতা করি সবাই।

সাধারণত ট্র্যাকিং আরও ভোরে শুরু করলে সারা দিনে অন্তত তিনটি স্পট ঘুরে আসা যায়; কিন্তু আমাদের এরই মধ্যে দেরি হয়ে গেছে। নাশতা সেরে চন্দ্রনাথ পাহাড়ের কাছাকাছি পৌঁছাতে প্রায় নয়টা বেজে যায়। আগেই সবার জন্য অ্যাংলেট কেনা হয়। সবাই সেটা পরে নেয়। অ্যাংলেট পরে পাহাড়ে উঠতে কিছুটা সহজ হয়। এবার প্রত্যেকে একটি করে লাঠি কিনে নেয়। বাঁশের লাঠি, দাম ৩০-৪০ টাকা করে। এখানেও দরদাম করে নিতে হয়। পাহাড় ট্র্যাকিংয়ের ক্ষেত্রে লাঠি সঙ্গে থাকলে কিছুটা কষ্ট কম হয়। শুক্রবার হওয়ায় এদিন প্রচুর পর্যটক ছিলেন। প্রায় সবার হাতেই বাঁশের লাঠি। তবে আমি কোনো লাঠি নিইনি। নিজের ওপর বিশ্বাস ছিল, লাঠির সহায়তা ছাড়াই পাহাড়ে উঠতে পারব।

চলবে…