রবীন্দ্রনাথের কবিতায় ঘুরেফিরে বারবার এসেছে জন্মদিন প্রসঙ্গ। কারও জন্মদিনে উপহার দিতেও পছন্দ করতেন কবি। এই পরিপ্রেক্ষিতে ‘জন্মতিথির উপহার’ শিরোনামের কবিতাটি উল্লেখযোগ্য। যেখানে ভ্রাতুষ্পুত্রী ‘শ্রীমতী ইন্দিরা প্রাণাধিকাসু’কে ‘একটি কাঠের বাক্স’ উপহার দেওয়ার কথা জানা যায়। এই কবিতায় রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘স্নেহ যদি কাছে রেখে দেওয়া যেত/ চোখে যদি দেখা যেত রে,/ বাজারে-জিনিস কিনে নিয়ে এসে/ বল্ দেখি দিত কে তোরে!’
‘জন্মদিন’ নিয়ে গুরুদেব যে আহ্লাদিত ছিলেন তাঁর কাব্যগ্রন্থ থেকে এই পাঠ খুঁজে নিতে বেগ পেতে হবে না। তবে সময় সৃষ্টিশীল মানুষের ভাবনায় রেখাপাত করে। ‘জন্মদিন’ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রেও এটা ঘটেছে। কালের শিলালিপিতে তাঁর ভাবনাও এগিয়েছে অনন্তের পথে। তাই তো ‘সেঁজুতি’(১৯৩৮) কাব্যগ্রন্থে ‘জন্মদিনের মুখর তিথি যারা ভুলেই থাকে,/ দোহাই ওগো, তাদের দলে লও এ মানুষটাকে--/সজনে পাতার মতো যাদের হালকা পরিচয়,/ দুলুক খসুক শব্দ নাহি হয়।’ এই আহ্বান জানিয়ে ‘জন্মদিনে’ (১৯৪১) কাব্যগ্রন্থে কবি বলেছেন, ‘আবার ফিরে এল উৎসবের দিন।/ বসন্তের অজস্র সম্মান/ ভরি দিল তরুশাখা কবির প্রাঙ্গণে/ নব জন্মদিনের ডালিতে।’ আবার ‘স্ফুলিঙ্গ’ (১৯৪৫) কাব্যগ্রন্থে গেয়ে উঠলেন নতুন আলোর মতো নব চেতনার গান। বললেন, ‘জন্মদিন আসে বারে বারে/ মনে করাবারে—/ এ জীবন নিত্যই নূতন/ প্রতি প্রাতে আলোকিত/ পুলকিত /দিনের মতন।’
জন্মদিন প্রসঙ্গে ‘স্ফুলিঙ্গ’ কাব্যগ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ কথাগুলো বললেও তাঁর এই বক্তব্যের মতো তিনি নিজেও ততখানি সত্য, ভাস্বর ও দীপ্তিমান। প্রতিদিনই নতুন নতুন ভাবে পাঠকের সামনে উপস্থিত হন। তাঁর রচনার বহুমাত্রিকতার জন্যই এটা সম্ভব হয়েছে। পাশাপাশি এ কথাও সত্য যে একই কারণে পাঠক তাঁর এক রচনা থেকে নানা অনুভূতি লাভ করে থাকেন। ‘তোমারেই করিয়াছি জীবনেরও ধ্রুবতারা’ গানটিকে উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করা যাক। গানটি বালক, তরুণ, যুবক ও বৃদ্ধের কাছে কিংবা একই ব্যক্তির কাছে জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে ভিন্ন ভিন্ন অনুভূতি ও ভাবনার উদ্রেক করে। রবীন্দ্রনাথের অনেক লেখা থেকেই এমন দৃষ্টান্ত মেলে। জীবনকে ভীষণভাবে রবীন্দ্রনাথ যে উপভোগ করেছেন সন্দেহ নেই। তাঁর কাছে দুঃখ যতটা দুঃসহ, আনন্দও ততটাই যত্ন পেয়েছে। কোনো অনুভূতিকেই কম মূল্য দেননি তিনি, তুল্যমূল্য ভাবেননি।
গল্প, কবিতা, উপন্যাস, নাটকের মতো রবীন্দ্রনাথের জীবনবোধের প্রগাঢ়তার প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর গানেও। রবীন্দ্রসাহিত্য পাঠের উপলব্ধি থেকে এই প্রতীতি জন্মেছে যে, গানেই জীবনের সব শাশ্বত সত্য বলতে চেয়েছেন তিনি। সফলভাবে বলেছেনও। কারণ, যা কিছু গতিশীল সেখানে ভাবনার মিছিল সংগোপন সংকল্পের মতো কিছুটা গোপনেই থেকে যায়। অনায়াসে বলতে চাওয়ার সব সত্য, সব জিজ্ঞাসা কবিতা, গল্প, উপন্যাসে বলে ফেলা যায় না। যদিও ‘শেষের কবিতা’ একটি উদাহরণ; কিন্তু কেবল একটি উদাহরণের নিরিখে রবীন্দ্রনাথকে উপলব্ধি করলে চলে না। রবীন্দ্রনাথ নিজেই সে কথা লিখেছেন ‘খাপছাড়া’ কাব্যগ্রন্থে। ‘সহজ কথায় লিখতে আমায় কহ যে,/ সহজ কথা যায় না লেখা সহজে।’
বোধ করি এ কারণেই জীবনের সব কঠিন সত্য বলতে গানকেই বেছে নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কোনো রাখঢাক না রেখেই কাজটা করেছেন। বেদনা, প্রেম, বিরহ থেকে শুরু করে জীবনের সঙ্গে যুক্ত প্রতিটি অনুভূতির কথা নির্দ্বিধায় বলেছেন। তাই তো ‘আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে’ গানটা শুনে হৃদয় কেমন করে ওঠে। ‘তুমি রবে নীরবে মম’ গানটি শুনতেই প্রিয়জনের ছবি ভেসে ওঠে চোখে।
রবীন্দ্রসংগীতের মাধুর্য, অকৃত্রিমতা এই কারণেই যে রবীন্দ্রনাথ বলবার কথাটি সহজ করেই গানে বলতে পেরেছেন। বলছেন নির্দ্বিধায় দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে। কোনো রাখঢাক রাখেননি। পাশাপাশি রবীন্দ্রসংগীতের প্রবল জনপ্রিয়তাও নিহিত আছে রবীন্দ্রনাথের বলার ধরন ও বিবরণে। তা ছাড়া জীবনদর্শন, জীবানুভূতির যে প্রবল সূর্যরশ্মির বিচরণ রয়েছে, তাঁর গানে তা–ও চিরস্মরণীয়। তাই তো ‘আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে দেখতে আমি পাই নি। তোমায় দেখতে আমি পাই নি।’ কিংবা ‘আমি তোমার প্রেমে হব সবার কলঙ্কভাগী।/ আমি সকল দাগে হব দাগি॥’ গান শুনে আমরা আহ্লাদিত হই।
রবীন্দ্রসংগীত জীবনের প্রতিটি অনুভবে পরশ দিয়ে যায়। প্রেমে, অপ্রেমে, আনন্দ–বেদনা প্রতিটি অনুভবে রবীন্দ্রসংগীত আপন হয়ে ওঠে। একইভাবে আপন হয়ে ওঠেন রবীন্দ্রনাথ। গানে গানেই হৃদয়ে হৃদয়ে ধ্বনিত হয় তাঁর কথা, তাঁর ছবি। ‘গুহার আঁধারে’ ‘রবির কর’ পৌঁছে যাওয়ার মতো হৃদয়ের গভীরে পৌঁছে যান তিনি। প্রিয় কণ্ঠস্বরে বলে ওঠেন, ‘মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক,/ আমি তোমাদেরই লোক/ আর কিছু নয়, এই হোক শেষ পরিচয়।
কার্যনির্বাহী সদস্য, বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদ