রিনার সংসার

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
রিনা প্রথমে ভয় পেলেও ধীরে ধীরে শিখে নেয়। মাথায় ডালা নিয়ে ধান আনা, গরুর গাড়িতে ধান তোলা—সবকিছুতেই এখন সে অভ্যস্ত।

নেত্রকোনার হাওরপারের এক অজপাড়া গ্রাম। চারদিকে বিস্তৃত ধানখেত, কচুরিপানায় ভরা ডোবা, আর কাঁচা রাস্তার দুই ধারজুড়ে তালগাছ ও শিমুলগাছ। গ্রামটা ছোট হলেও মানুষজন একে অপরের সঙ্গে হাসি, কান্না, আনন্দ, দুঃখ—সবকিছু মিলেমিশে ভাগ করে নেয়।

গ্রামের একটি যৌথ পরিবারে ছয় ভাই, তিন বোন। তাদের সংসার যেন এক বিশাল মেলা। সকাল শুরু হয় ঢেঁকিতে ধান ভানার শব্দে, দুপুরে ধোঁয়া ওঠা ভাতের গন্ধে, আর রাতে একসঙ্গে বসে ভাত খাওয়ার আনন্দে। বড় ভাইয়েরা সবাই কৃষিকাজ করে, বউরা সংসার সামলায়। এখনো দুই ভাই অবিবাহিত। পঞ্চম ভাইয়ের বিয়ের কথা হচ্ছে। এ নিয়ে সবার মাঝে উচ্ছ্বাস।

পার্শ্ববর্তী গ্রামের আরেক যৌথ পরিবারের আদরের ছোট মেয়ে রিনা। চোখেমুখে সরলতা, কণ্ঠে একধরনের মায়া। পঞ্চম ভাইয়ের সঙ্গে তাঁর বিয়ের প্রস্তাব এলে দুই পরিবারই খুশি। কিছুদিনের মধ্যে বিয়েও হয়ে গেল।

বিয়ের দিনটা ছিল শীতের শেষ ভাগ। কুয়াশায় ভেজা সকাল, আর ঢাকঢোলের শব্দে মুখর উঠান। গ্রামের মেয়ের মতোই রিনাকে সাজানো হয়েছে। তার চোখে ছিল স্বপ্নময় আলো, নতুন সংসার তাকে কেমন করে গ্রহণ করবে!

কিন্তু সংসারে ঢুকতেই রিনার জীবনটা যেন অন্য রূপ নিল। যৌথ সংসারে একজন নতুন বউ মানেই যেন এক নতুন দায়িত্ব। শ্বশুর-শাশুড়ি, ভাশুর-ভাবি, ননদ—সবাই মিলেমিশে এক সংসার। সেখানে মানিয়ে নেওয়া এত সহজ নয়।

রিনার সকাল শুরু হয় ফজরের নামাজের পর থেকেই। উঠান ঝাড়ু দেওয়া, গোয়ালঘরে খড় দেওয়া, ঢেঁকিতে ধান ভানা—এসব যেন নিত্যকার নিয়ম। তিন বেলা খাবার রান্না, শ্বশুরের খাওয়া আগে, তারপর স্বামী-ভাশুরদের জন্য ভাত বেড়ে দেওয়া। সবশেষে যখন নিজের মুখে ভাত ওঠে, তখন প্রায় বিকেল গড়িয়ে যায়।

ভাশুরদের মধ্যে কেউ কেউ ভালোবাসে, আবার কেউ–বা কথার খোঁচা দেয়। শাশুড়ি কখনো বলে, ‘এই রিনা, তোর হাতের ভাত কেমন জানি শক্ত হইছে, ঢেঁকির চাল ঠিকমতো ভাঙছস না নাকি?’
রিনা চুপচাপ শোনে, কিছু বলে না। শুধু মনের ভেতরটা কেমন জানি হাহাকার করে ওঠে।
রিনা হাল ছাড়ে না। কাজের ফাঁকে মাঝেমধ্যে আকাশের দিকে তাকিয়ে গভীর নিশ্বাস ফেলে। ভাবে—এই জীবনই কি তবে নিয়তি?

আরও পড়ুন

কৃষিপ্রধান পরিবার হওয়ায় রিনাকে কৃষিকাজেও সহযোগিতা করতে হয়। ধান কাটা মৌসুমে পুরুষেরা সকাল থেকে মাঠে যায়। সেই সময় বউরা শুধু ঘরের কাজই করে না, মাঠের কাজেও হাত লাগায়।

রিনা প্রথমে ভয় পেলেও ধীরে ধীরে শিখে নেয়। মাথায় ডালা নিয়ে ধান আনা, গরুর গাড়িতে ধান তোলা—সবকিছুতেই এখন সে অভ্যস্ত। যদিও কাজের ভার তাকে প্রতিদিনই ক্লান্ত করে তোলে, তবু যখন দেখে তার হাতের পরিশ্রমে ভরা গোলাঘর, তখন বুকের ভেতর অদ্ভুত এক তৃপ্তি জমে।

গ্রামের একটি বৈশিষ্ট্য হলো, প্রতিবেশী আর আত্মীয়রা সব সময় কৌতূহলী। কে কেমন রান্না করল, কে কখন ঝগড়া করল, সবকিছু নিয়েই আলোচনা চলে। রিনার শ্বশুরবাড়িতেও ব্যতিক্রম নেই।
কখনো কারও মুখ থেকে শোনে—‘রিনা বেশ খাটে, মায়াও আছে মেয়ের।’
আবার কারও ঠোঁটে আসে—‘নতুন বউ, শুরুতে তো সবাই খাটে। পরে দেখি কেমন টিকে।’
এসব শুনে রিনার বুক ভার হয়ে যায়। তবু সে নিজেকে শক্ত রাখে।

সংসারের ভিড়ের মধ্যেই রিনা মাঝেমধ্যে নিজেকে একা মনে করে। স্বামী কৃষিকাজে ব্যস্ত থাকে, রাত গভীর হলে তবেই বাড়ি ফেরে। ভাশুর-ননদদের সংসার, তাদের আলাদা ঝামেলা। শাশুড়ির কঠোরতা, শ্বশুরের নীরবতা—এসব মিলিয়ে তার মনের ভেতর হাহাকার জমতে থাকে।

একদিন রাতে চাঁদের আলোয় উঠানে বসে সে নিজের মনের সঙ্গে কথা বলে— ‘আমি তো কারও শত্রু নই। শুধু একটু মায়া চাই, একটু আদর চাই।’
চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। সেই জল কেউ না দেখলেও, আকাশের তারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারে মনের কষ্ট।

রিনা ভেঙে পড়ার মেয়ে নয়। ধীরে ধীরে সংসারের খুঁটিনাটি বুঝতে শেখে। ভাশুর-ননদদের সঙ্গে ঝগড়া না করে হাসিমুখে কথা বলে। শাশুড়ির রাগ শুনে চুপ করে থাকে, পরে আবার কাজে মনোযোগ দেয়। তার মায়াবী স্বভাব ধীরে ধীরে সবার মন জিতে নেয়। একসময় যাদের চোখে সে ছিল শুধু এক শ্রমশক্তি, তাদের চোখেই সে হয়ে ওঠে সংসারের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

এভাবেই সময় কেটে যায়। ধানের মৌসুম আসে যায়, বন্যার পানি উঠান ভাসায় আবার নেমে যায়। রিনা ধীরে ধীরে সংসারের সঙ্গে মিশে যায়। তবে নিজের ভেতরের কষ্টকে একেবারেই মুছে ফেলতে পারে না। কখনো একা বসে ভাবে—জীবন বোধ হয় এই, সংগ্রামের ভেতরেই আনন্দ খুঁজে নিতে হয়।
তার ঠোঁটে তখন হালকা হাসি খেলে যায়। যেন সবকিছুর মধ্যেই সে টিকে থাকার শক্তি খুঁজে পেয়েছে।

উপদেষ্টা, ময়মনসিংহ বন্ধুসভা