ভুল শ্রাবণের ফুল

অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান

শ্রাবণ মাস। ঝুম বৃষ্টি পড়ছে। কয়েকজন দৌড়ে এসে বসেছে পুরোনো ভবনের বারান্দায়। শাওন গিয়েছিল টিউশনিতে। বাবার ছায়া মাথার ওপর না থাকলে পৃথিবীটা আর দশজনের মতো ফুলেল হয় না। বাবা যখন মারা গেলেন, শাওন তখন দশম শ্রেণিতে। সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষের প্রয়াণে দিশাহারা পরিবার। শাওনরা দুই ভাইবোন। বাবার স্বপ্ন ছিল ছেলেমেয়ে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হবে। বাবার স্বপ্ন মিথ্যে হতে দেয়নি শাওন। কলেজজীবন থেকেই টিউশনি শুরু করে । বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পরও অপেক্ষা করতে হয়নি। কয়েক দিনের মধ্যে টিউশনি পেয়ে যায়। ঢাকা শহরে টিউশনির বাজার ভালো। কিন্তু সামনের মাস থেকে একটা টিউশনি থাকছে না। আরেকটা টিউশনি না পাওয়া পর্যন্ত টানাপোড়েন যাবে। বৃষ্টি দেখতে দেখতে ভাবছিল শাওন।

হঠাৎ সামনের নতুন ভবনের বারান্দায় চোখ ছুটে যায়। মেয়েটা কদম ফুলের মতো সুন্দর। পরনে লাল রঙের সালোয়ার–কামিজ। চোখ দুটো তিরের ফলার মতো টানা টানা। মেয়েটার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল হেনা। হেনা আর শাওন একই এলাকার, যশোরের। শাওন স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বৃষ্টি কমতে শুরু করেছে। শাওনের সঙ্গে ইশারায় হাই-হ্যালো করে উচ্চ স্বরে হেনা বলে, ‘ঐন্দ্রিলা চল যাই, লাইব্রেরিতে গিয়ে অ্যাসাইনমেন্টের কাজটা শেষ করি।’

দুজনের আর যোগাযোগ হয়নি। ছয় মাস কম সময় নয়। শাওন নিজেকে সামলে নিয়েছে।

শাওনের মুঠোফোন বন্ধ হয়ে গেছে। শাওন দৌড়ে রুমে গিয়ে ফোন চার্জে দিয়ে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় পা দুলিয়ে বসে। ঐন্দ্রিলার মুখটা ভেসে ওঠে চোখে। মুঠোফোন অন করে ফেসবুকে ঢুকে হেনার প্রোফাইল পিকচারের রিঅ্যাক্ট তালিকা থেকে ঐন্দ্রিলার আইডি খুঁজতে থাকে। পেয়েও যায়।

ঐন্দ্রিলা ইংরেজি বিভাগে পড়ে। আর শাওন পড়ে সাংবাদিকতায়। একই ব্যাচ। শাওন রিকোয়েস্ট পাঠায় । সন্ধ্যার পর নোটিফিকেশন আসে। রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করেছে। ঐন্দ্রিলাকে নিয়ে স্বপ্নে ভাসতে থাকে সে। কিন্তু স্বপ্ন বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। মুঠোফোন বেজে ওঠে। মা কল করেছেন, ‘টাকাটা আজ পাঠাতে পারবি বাবা, তিথির (শাওনের ছোট বোন) অনেক জ্বর।’ প্রতি মাসে টিউশনির অর্ধেক টাকা মাকে পাঠায়। এ মাসেরটা এখনো পাঠানো হয়নি।

মাকে টাকা পাঠিয়ে রুমে ফিরে নিজেকে বোঝাতে শুরু করে। ‘তোর ওপর অনেক দায়িত্ব। তা ছাড়া ঐন্দ্রিলা রাজি হলেও তুই কি ওকে ভালো রাখতে পারবি? ও সুন্দর জীবন ডিজার্ভ করে। বাড়িতে কাজের লোক থাকবে। দেশ-বিদেশে ঘুরতে যাবে। দামি শাড়ি পরবে, গয়না পরবে। তুই এসবের কিছু ওকে দিতে পারবি?’ মেসেঞ্জারে নোটিফিকেশনের শব্দ। ‘ভ্যাবলার মতো অমন করে তাকিয়ে ছিলেন কেন?’ লিখেছে ঐন্দ্রিলা। শাওন কী বলবে ভেবে পায় না। ‘থাক বলতে হবে না, আমি বুঝে নিয়েছি।’ কিছুক্ষণ পরে লেখে ঐন্দ্রিলা।

আরও পড়ুন

মেসেঞ্জারে কথা চালাচালি, ক্যাম্পাসে দেখা হলে চোখ ভরে দেখা, এভাবেই চলছিল। কিন্তু করোনা মহামারি সব এলোমেলো করে দেয়। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাড়ি চলে যেতে হয়। টাকার প্রয়োজনে শাওন অ্যান্ড্রয়েড ফোনটা বিক্রি করে দেওয়ায় যোগাযোগে ভাটা পড়ে। টিউশনি বন্ধ, শাওন দূরসম্পর্কের এক আত্মীয়ের মুদিদোকানে কাজ শুরু করে।

ভাগ্য বড় রহস্যময়। কয়েক দিনের মধ্যে অনার্সের রেজাল্ট হওয়ার কথা। শাওন পড়ালেখায় ভালো। চাকরি পেতে বেগ হবে না। কিন্তু করোনার জন্য সব ভেস্তে গেল। অন্যদিকে ঐন্দ্রিলা বাড়ি ফেরার পর বাবা উঠেপড়ে লেগেছেন বিয়ে দেওয়ার জন্য। শাওনকে বিষয়টা জানাতে ইচ্ছা করে। ‘কিন্তু শাওন তো কোনো কথা দেয়নি? ভালো লাগার কথাও বলেনি। কেবল ধারণার বশবর্তী হয়ে শাওনকে বলা কি উচিত হবে।’ ইত্যাদি ভেবে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে না।

৩১ মে ২০২০, রোববার। গোধূলিলগ্নে ঐন্দ্রিলার বিয়ে। করোনার জন্য লোকসমাগম নিষিদ্ধ। শাওনকে টেক্সট করে ঐন্দ্রিলা। ‘ভ্যাবলা ছেলে, তোমার ঐন্দ্রিলার আজ বিয়ে। ভালো থেকো, যত্ন নিয়ো নিজের।’ ফিচার ফোনটা শাওনের হাতেই ছিল। টেক্সটা পড়তেই বুকে বজ্রপাতের মতো ব্যথা চেপে বসে। চোখ থেকে অশ্রু বেয়ে পড়ে।

দুজনের আর যোগাযোগ হয়নি। ছয় মাস কম সময় নয়। শাওন নিজেকে সামলে নিয়েছে। আজ নভেম্বরের ২৫ তারিখ। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিশেষ ব্যবস্থায় অনার্সের ফলাফল প্রকাশ করেছে। শাওন ডিপার্টমেন্টে তৃতীয় হয়েছে। অ্যাপিয়ার্ড সার্টিফিকেট দিয়ে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ভাইভা দিয়েছিল করোনার আগে। সেটারও অফার লেটার এসেছে। এক দিনে দুটো ভালো খবর।

শাওন এক বন্ধুর কাছ থেকে ফোন নিয়ে ফেসবুকে লগইন করে। গতকাল ছিল ঐন্দ্রিলার জন্মদিন। শাড়ি পরা একটা ছবি পোস্ট করে নিজেকে নিয়ে লিখেছে ক্যাপশনে। শাওন পোস্টের লিংকটা ঐন্দ্রিলার ইনবক্সে পাঠিয়ে লেখে, ‘শুভ জন্মদিন। সুন্দর বললে বর কি রাগ করবে?’ মুহূর্তেই জবাব আসে, ‘বর তো নেই, আমার ডিভোর্স হয়ে যাচ্ছে!’

শাওন জবাব দেয় না। ঐন্দ্রিলার ডিভোর্সের খবরে তার দুঃখিত হওয়া উচিত। দুঃখ পাচ্ছেও, আবার মনে গানও বেজে যাচ্ছে। ‘তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা,/ এ সমুদ্রে আর কভু হব নাকো পথহারা।’