দেশ ছাড়ার আগে

প্রতীকীছবি: বিমান বাংলাদেশের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে

সন্ধ্যা সাতটা, রাস্তায় একা দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ কেউ একজন আমার হাত মুঠ করে ধরলেন, চমকে গেলাম। মোবাইলের আলো জ্বেলে দেখলাম ধীরেন জ্যাঠা। কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে বললাম, ‘কেমন আছো?’ তিনি অনেকটা নিচু গলায় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘হ্যাঁ, ভালো। তুই কখন এলি? ভেবেছিলাম তোর সঙ্গে হয়তো আর দেখা হবে না।’
‘জ্যাঠা, আমি আজ দুপুরে এসেছি। দেখা হবে না, কেন বলছ? কী হয়েছে?’
‘কাল আমি একেবারে দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছি। ভেবেছিলাম শেষ বয়সে আর দেশ ছেড়ে কোথাও যাব না। কিন্তু ছেলে কিছুতেই শুনল না।’

উনি আমার হাত ধরে আছেন, আর আমি ওনার মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে আছি। কখন যেন হারিয়ে যাই শৈশবে জ্যাঠার সঙ্গে কাটানো স্মৃতির মাঝে। একপর্যায়ে জ্যাঠা হাত ছাড়লে আমি স্বাভাবিক হই। ওনার চোখের জলে আমার হাত ভিজে গেছে। কী বলব ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। বললাম, ‘না গেলে তো পারতে। থেকে যাও না বাকিটা জীবন।’
‘থাকব বলেই তো এই দশটা বছর দেশের মাটিকে আঁকড়ে পড়ে আছি। তোর ভাই তো গেছে সেই দশ বছর আগে। এখন বয়স হয়েছে। দিন দিন শরীর খারাপ হচ্ছে, অসুস্থ হলে কে দেখবে! তাই সব ভেবে রাজি হয়ে গেলাম।’
‘তা যাও জ্যাঠা!’

আরও পড়ুন

তখন উনি আমাকে জড়িয়ে ধরে অবুঝ শিশুর মতো চোখের জল ফেলতে লাগলেন। বলেন, ‘যদি আমার ব্যবহারে কোনো কষ্ট পেয়ে থাকিস, মনে রাখিসনে বাবা।’
আমি চোখের জল ধরে রাখতে পারলাম না। ঝরনার মতো দুচোখ গড়িয়ে জল ঝরতে লাগল।
চোখের জল মুছে বললাম, ‘জ্যাঠা, আমি যদি কোনো ভুল করে থাকি, আমার কথায় যদি কোনো কষ্ট পেয়ে থাকো, ক্ষমা করে দিও।’
তারপর জ্যাঠা আমার কাছ থেকে বিদায় নিলেন। আর বলে গেলেন, ‘কাল খুব সকাল আমি চলে যাব।’

রাস্তা থেকে ঘরে এলাম। মনের ভেতর যেন এক অজানা কষ্ট স্তব্ধ করে রেখেছে। সারা রাত চোখে ঘুম এল না। প্রতিটা মহূর্তে একটা কথা ভেবেছি, ‘স্বদেশ তুমি কতটা আপন, কতটা ভালোবাসার; যে নিজ সন্তানকে ভিন্ন দেশে দশ বছর রেখেও শুধু দেশের মাটিকে আঁকড়ে ধরে থাকা যায়।’

প্রায় নির্ঘুম রাত পার হয়ে গেল। সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ালাম জ্যাঠাকে একটিবার দেখব বলে। কিন্তু আমার যাওয়াটা হয়তো দেরি হয়ে গেল। জ্যাঠা এরই মধ্যে পেরিয়ে গেলেন গ্রামের সীমানা। একদৃষ্টিতে তাঁর চলার পথের দিকে চেয়ে রইলাম। একসময় জ্যাঠা চোখের আড়ালে চলে গেলেন, আর আমি নির্বাক দাঁড়িয়ে রইলাম।

কয়রা, খুলনা