শরতের সকাল। অন্তরের ঘুম ভাঙল কাকের ডাক শুনে। দরজার কাছে এসে দুটো কাক এমনভাবে চিৎকার করতে লাগল যে আর ঘুমিয়ে থাকা সম্ভব হলো না।
দরজা খুলতেই কাক দুটো উড়ে গিয়ে রেলিংয়ে বসল। পুরোপুরি সকাল হয়নি। হালকা কুয়াশা পড়ছে। ছাদের উত্তরদিকের শিউলি ফুলের গাছটাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন আকাশের সাদা মেঘের স্তর নিচে নেমে এসেছে। নিষ্পাপ, কোমল, সুশ্রী শিশুর মতো এই সকাল। এ সময় রাস্তায় হাঁটাহাঁটিতেও আনন্দ আছে।
কেউ ঘুম থেকে ওঠেনি তখনো। বাড়ির প্রধান ফটকে তালা ঝুলছে। অবশ্য একটা চাবি ওর কাছে আছে।
অন্তর দুর্জয় মোড়ে এসে আর দৌড়াতে পারছিল না। ভীষণ হাঁপিয়ে উঠেছে। দুর্জয় মিনারের নিচে সিঁড়িতে বসে সে বিশ্রাম নিতে লাগল। রাস্তায় দুয়েকটা গাড়ি চলাচল করছে। যানজট না থাকলে জায়গাটা দেখতে অসাধারণ লাগে।
ইতিমধ্যে কুয়াশা ভাবটা কেটে গেছে। আকাশে সূর্যের দেখা পাওয়া যাচ্ছে। শরতে রোদ, বৃষ্টি, কুয়াশা সবই থাকে। সকালে কুয়াশা, হঠাৎ করেই বৃষ্টি, আবার বৃষ্টি শেষে রোদ—চমৎকার চক্র।
অন্তর উঠে দাঁড়াল। এবার হেঁটে হেঁটে বাসায় ফেরা যাক। একটু সামনে এগোতেই আদ্রিতাকে রিকশা থেকে নামতে দেখা গেল। এ সময় ওর এখানে আসার কী হেতু থাকতে পারে, তা অন্তর বুঝতে পারল না। আদ্রিতা বলল, ‘অন্তর ভাই, কেমন আছেন?’
‘ভালো। আপনি এখানে কী জন্য?’
‘আমি তো প্রতিদিনই আসি।’
‘প্রতিদিন?’
‘হ্যাঁ। আমার কলেজ এদিকে।’
‘ও আচ্ছা। কিন্তু এত সকালে?’
‘এত সকালে এসেছি আপনার পিছু পিছু।’
অন্তর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘হঠাৎ আমার পিছু পিছু কেন?’
‘বাসায় তো আপনার সঙ্গে কথাই বলতে পারি না। ছাদে গেলেই এমন একটা ভাব করেন, মনে হয় কেউ দেখে ফেললে আপনার ফাঁসি হয়ে যাবে!’
‘ফাঁসি হলেই বরং বাঁচতাম। কিন্তু এই গুরুদণ্ড দেবে কে আমায়?’
আদ্রিতা ভেংচি কেটে বলল, ‘উঁ, গুরুদণ্ড দেবে কে আমায়! আদালতগুলো বেকার পড়ে আছে কিনা!’ বলেই সে খিলখিল করে হাসতে লাগল।
অন্তর বুঝল, এই মেয়ের কাছে সব উপমাই কুপোকাত। তা ছাড়া আদ্রিতার জীবনসম্পর্কিত যত ভাবনা, যত ধারণা, সেসব নিতান্তই সুখের। তাই কারও কণ্ঠে শ্লেষ থাকলেও তা সর্বদাই সরল বাক্য বলে মনে হয়। এই সহজ সত্য জীবন বহু আকাঙ্ক্ষার হলেও তা অল্প লোকের ভাগ্যেই জোটে।
হাসি থামিয়ে আদ্রিতা বলল, ‘আজ বাসায় পত্রিকা দিয়ে যায়নি। তাই পত্রিকা কিনতে এলাম। খুব সকালে না এলে এখানে পত্রিকা পাওয়া যায় না। আপনি কেন এসেছেন?’
‘সকালটা বেশ ভালো লাগছিল। তাই হাঁটতে বের হলাম।’ মনে মনে বলল, ‘মেয়েদের ছলনার শেষ নেই দেখছি!’
পত্রিকা কিনে আদ্রিতা দাঁড়িয়ে রইল। বাড়িতে ফেরার জন্য এই মুহূর্তে একটাও খালি রিকশা পাওয়া যাচ্ছে না। চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ওর স্বভাবে নেই। তাই নিয়মিত পত্রিকা পাঠের নানা উপকারিতা বর্ণনা করতে লাগল।
কোনোরকমে একটা রিকশায় আদ্রিতাকে তুলে দিয়ে হেঁটে বাড়িতে ফিরবে বলে ভাবছিল অন্তর। কিন্তু আদ্রিতার কথা ফেলতে পারল না। অনিচ্ছাসত্ত্বেও একই রিকশায় উঠতে হলো তাকে। চলন্ত রিকশায় তীব্র হাওয়া এসে যখন আদ্রিতার চুল এলোমেলো করে দিচ্ছিল, তখন সেদিকে তাকিয়ে অন্তরের চোখ স্থির হয়ে রইল। তারপর দ্রুতই সাহস হারাল। চোখ সরিয়ে অন্যত্র তাকিয়ে জড়সড় হয়ে বসে থেকে বাকি পথটা অতিক্রম করল। সে জানে, মুহূর্তটা আর কখনো হয়তো ফিরে আসবে না। কিন্তু কী একটা শঙ্কা, কী একটা ভাবনা ওকে তাড়িয়ে বেড়ায়। কখনো নিজের ব্যক্তিত্ব ধরে রাখতে, কখনো–বা অপরের প্রতি সম্মান বজায় রাখতে গিয়ে অন্য এক মানুষে পরিণত হতে হয়।
চিলেকোঠায় একাকী বসবাস যেন পৃথিবী থেকে দূরে কোথাও অবস্থান করার মতোই। তাই হঠাৎ হঠাৎ আদ্রিতার সংস্পর্শ যেন ওকে জাগিয়ে তোলে।
অন্তর সেদিন কোনো কাজেই পুরোপুরি মনোযোগ দিতে পারেনি। একটা চিন্তা ক্রমশ সংকুচিত করে রাখল ওকে। এটাও বুঝতে পারল যে মানুষের সংস্পর্শে থাকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ! কলেজে ওর সহপাঠীর সংখ্যাও নিতান্তই অল্প। তা ছাড়া চিলেকোঠায় একাকী বসবাস যেন পৃথিবী থেকে দূরে কোথাও অবস্থান করার মতোই। তাই হঠাৎ হঠাৎ আদ্রিতার সংস্পর্শ যেন ওকে জাগিয়ে তোলে।
বিকেলে রাফি পড়ার এক ফাঁকে বলল, ‘স্যার, আজ একটা গল্প শুনতে চাই।’
অন্তর বলল, ‘কিন্তু এখন তো আমার গল্প বলতে ইচ্ছে করছে না। তুমি বরং গণিত বইটা বের করো। অনুশীলনী থেকে কিছু প্রশ্ন করি।’
রাফি বই বন্ধ করে বিষণ্ন মনে বসে রইল। অভিমানমিশ্রিত কণ্ঠে বলল, একটা গল্প বললে কী এমন ক্ষতি!
অন্তর বলতে শুরু করল, আঠারো শতকে এক রাজা ছিলেন। তিনি যেমন শৌখিন, তেমনই নিষ্ঠুরও ছিলেন। তাই অনেকে বলত, ও ঠিক মানুষ নয়, মানুষের চেয়ে এক ধাপ নিচে। সেই রাজা তার প্রজাদের সীমাহীন নির্যাতন করতেন। দ্বিগুণ খাজনা আদায় করতেন। কখনো রাতের আঁধারে প্রজাদের বাড়ি লুণ্ঠনের জন্য লোক পাঠাতেন। তারপর সেই সম্পদ ব্যবহার করা হতো বিশাল রাজবাড়ির নির্মাণ কাজে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নামীদামি পাথর আনা হতো। সেই পাথর বসানো হতো রাজবাড়ির দেয়ালে। অত্যাচারের ভয়ে কেউ মুখ খুলত না। কিন্তু যিনি এই মহাবিশ্বের স্রষ্টা, তিনি চুপ থাকলেন না। একদিন রাতের বেলা সামান্য একটি প্রদীপের আগুন থেকে পুরো রাজবাড়ি ঝলসে গেল। পরদিন সকালে রাজ্যের সব মানুষ এসে দেখল, আগুনে পুড়ে যাওয়া রাজবাড়িটি বিবর্ণ অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। কোথায় রাজা, কোথায় তার রানি আর কোথায়ই বা তার রাজকর্মচারী! কেউই আর বেঁচে নেই। তারপর কত সময় কেটে গেল, কেউই আর রাজবাড়িতে থাকতে আসেনি। আঠারো শতকে নির্মিত রাজবাড়িটি জঙ্গলের ভেতর নির্জন পরিবেশে অবহেলায় পড়ে আছে এখনো। বেশ কিছু অংশ ভেঙে পড়েছে। চারপাশে লতাপাতা আর উঁচু উঁচু গাছ জন্মে জঙ্গলে পূর্ণ হয়ে আছে।
গল্প শেষ হতেই রাফি বলল, ‘স্যার, কোথায় আছে সেই রাজবাড়ি? আমাকে একদিন দেখাতে নিয়ে যাবেন?’
‘হ্যাঁ, নিশ্চয়ই নিয়ে যাব। এখন দুটো অঙ্ক শেষ করতে হবে তোমাকে।’
রাফি আনন্দিত হয়ে অঙ্ক কষতে লাগল।
শরতের সুন্দর দিনগুলো এক–এক করে কেটে গেল। এখন আর বৃষ্টি হয় না। দরজা খুললেই উত্তরের হিমেল হাওয়া এসে ঘরকে নির্জীব করে তোলে। রোদের তীব্রতার কারণে একসময় ছাদটাকে মরুভূমি মনে হতো। ঋতুর পরিক্রমায় তা আজ বরফের রাজ্যে পরিণত হয়েছে যেন! মাঝেমধ্যে রোদ ওঠে। তখন কী যে ভালো লাগে!
ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। হাতে কিছু সময় পাওয়ায় অন্তর গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার কথা ভাবল। কিন্তু পরদিন কলেজ থেকে নতুন নোটিশ দিয়েছে। আগামী সপ্তাহে ইনকোর্স পরীক্ষা শুরু হবে। আপাতত কোথাও যাওয়া হচ্ছে না।
চলবে...
বন্ধু, ভৈরব বন্ধুসভা