একতলা বাড়ি। তিনটি আলাদা ঘর। হাছান আর অমিতাভ দুটো ঘর দখলে রেখেছে দুই বছর যাবত। অন্যটিতে থাকত মাস্টার্স শেষ করে চাকরির আশায় থাকা মিনহাজ নামের একজন। গত মাসে মিনহাজ সিলেটে একটি প্রাইভেট ব্যাংকে নিয়োগ পেয়েছে। সেখানে চলে যাওয়ায় তার ঘরটি খালি পড়ে ছিল। সেই ঘরখানা এখন অন্তরের নতুন ঠিকানা।
পড়ার টেবিল, বই আর আসবাব গোছাতে গোটা এক দিন কেটে গেছে। তারপরও দুয়েকটা কাপড় এলোমেলো হয়ে পড়ে রইল। ফ্লোরে মোটা তোষকের ওপর চাদর বিছিয়ে বিছানার আয়োজন করা হয়েছে। বইয়ের তাকে ন্যাপথলিন রাখায় ঘরময় তীব্র গন্ধ। জানালায় ঝুলছে রঙিন পর্দা। বন, পাহাড় আর সমুদ্রের ছবি কতক দেয়ালে শোভা পাচ্ছে। অমিতাভ প্রশংসা করে বলল, ‘তুমি তো বেশ শৌখিন। নিজের ঘরখানা বেশ গুছিয়ে নিলে। আমার ঘরটা দেখো, একদম গোয়ালের মতো।’
পাশে দাঁড়িয়ে হাছান বলল, ‘গোয়ালের মতো তো হবেই। তুই একটা গরু কিনা!’
অমিতাভ গলা খাঁকারি দিয়ে হেসে বলল, ‘তুই আর আমি তো একই।’
ওদের খুনসুটি দেখে অন্তর না হেসে পারল না। বন্ধু হিসেবে ওরা কতখানি ঘনিষ্ঠ, তা–ও সে বুঝতে পারল। এক দিনের পরিচয়, তবু তারা কত সহজেই মিশে যেতে থাকল। ওদের নিয়ে একসঙ্গে একই ছাদের নিচে দিনগুলো অনায়াসই কেটে যাবে হয়তো।
রান্নার চিন্তা নেই। বুয়া সময়মতো এসে রান্না করে দিয়ে যায়। তাতে ওদের অনেকটা সময় বেঁচে যায়। সপ্তাহে এক দিন বাজার করতে হয়। এর বাইরে অন্য কোনো ঝামেলা না থাকায় পড়াশোনায় কোনো প্রকার বিঘ্ন ঘটে না। একা থাকার প্রচণ্ড ক্লান্তি এবার ঘুচে যেতে থাকল। সুযোগ পেলেই তিনজন একত্র হয়ে রাজ্যের আলাপ জুড়ে দেয়। অন্তরের ঘরখানায় বেশির ভাগ আড্ডা জমে। সমবয়সী বন্ধু হলে এই একটা সুবিধা, নির্ভাবনায় কথা বলা যায়। ছোটবেলার কথা, কলেজে ঘটে যাওয়া নানা কাহিনি আর কখনো কখনো নিজেদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা; সবকিছুর উপস্থাপন চলে ক্লান্তিহীন। অমিতাভ প্রায়ই বলে, ‘মিনহাজ ভাই অনেক ডেডিকেটেড ছিল। রাত জেগে শব্দ করে পড়ত। বিসিএস ক্যাডার হওয়া ছিল উদ্দেশ্য। আমারও ইচ্ছা তা–ই হওয়া।’
মিনহাজের পড়াশোনার প্রতি ঝোঁক আর অক্লান্ত পরিশ্রমী হওয়ার ব্যাপারখানা অন্তরকে বেশ অনুপ্রাণিত করে। নিজের ভেতরে থাকা বোবা অথচ স্বচ্ছ স্বপ্নগুলো আরও জাগ্রত হতে চায়। যে কথা কাউকেই বলা হয়নি আগে, তা সে একদিন অকপট বলল, ‘আমি পেশা হিসেবে শিক্ষকতা বেছে নিতে চাই। মাদকাসক্তির প্রভাবে নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের বেশির ভাগ ছেলেই বিপথগামী হয়ে পড়ছে। তাদের নিয়ে কাজ করাও আমার অন্যতম লক্ষ্য।’
অমিতাভ বেশ কৌতূহল প্রকাশ করল। হাসানের নজর তখন ফোনের স্ক্রিনে সীমাবদ্ধ। ফোনটা একপাশে রেখে হাই তুলতে তুলতে বলল, ‘মানুষের ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষাগুলো শুনতে ভালোই লাগে। আমার অবশ্য তেমন কিছুতে মনোযোগ নেই। বাবার ব্যবসা আছে। ব্যবসায় হাল ধরতে পারলেই বাবা অনেক খুশি হবে।’
ওর কথাগুলো শুনে অবিশ্বাস্য মনে হলো। যেন ওটা কিছুতেই ওর মনের কথা নয়। কারণ, ও পড়াশোনায় ভালো। ইংরেজিতে বেশ দক্ষতা আছে। প্রতিদিন নতুন নতুন শব্দ খুঁজে বের করে মুখস্ত করতে থাকে। ওর টেবিলে, ফ্লোরে কিংবা বিছানার নিচে; সর্বত্র ইংরেজি খবরের কাগজ আর ম্যাগাজিন পড়ে থাকে। কিছু কিছু ম্যাগাজিনের পৃষ্ঠায় উদ্ভট ছবি আঁকা। সেসব কাউকে দেখায় না।
একদিন বিকেলে শফিক স্যারকে মেসে আসতে দেখে অন্তর বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইল। স্যার বললেন, ‘তোমাকে কলেজে দেখেছি মনে হয়।’
অন্তর বলল, ‘জি, ব্যবস্থাপনা বিভাগে পড়ি। এবার তৃতীয় বর্ষে আছি। দ্বিতীয় বর্ষে আপনার ইংরেজি ক্লাস করতাম।’
‘ও, আচ্ছা। এখানে থাকো এখন? কবে এসেছ?’
‘এ মাসেই এসেছি, স্যার।’
শফিক স্যার ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক। দ্বিতীয় বর্ষে আবশ্যিক বিষয় ইংরেজি। অনার্সে পড়ুয়া সব বিভাগের শিক্ষার্থীকে একটি ক্লাসে জড়ো করে তিনি লেকচার দেন। অমিতাভ আর হাছান দুজনই তাঁর প্রিয় ছাত্র। কেননা, ইংরেজি বিভাগে এই দুজনকেই বেশির ভাগ সময় ঘুর ঘুর করতে দেখা যায়। অন্য শিক্ষার্থীরা আসে কেবল ইনকোর্স পরীক্ষা দেওয়ার জন্য। ক্লাসে আসে অল্পস্বল্প।
প্রথম বর্ষ থেকেই শফিক স্যারের সান্নিধ্যে হাছান আর অমিতাভ পড়ালেখায় সর্বোচ্চ মনোযোগ ধরে রেখেছে। তাই স্যারকে ‘গুরু’ বলে সম্বোধন করে আনন্দ পায়। গুরু মাঝেমধ্যেই মেসে চলে আসেন। কখনো সাজেশন নিয়ে, কখনো মনের ইচ্ছায়। আজ এসেছেন জরুরি কাজে। জানুয়ারিতে কলেজের বকেয়া বেতন পরিশোধ করার জন্য দুবার নোটিশ দেওয়া হয়েছে। অনেকেই বেতন পরিশোধ করেনি। হাছান তাদেরই একজন।
প্লাস্টিকের চেয়ারটায় বসতে বসতে গুরু বললেন, ‘তোমাদের পড়ালেখা কেমন চলছে?’
অমিতাভ অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলল, ‘ভালো। গুরু, চা বানাই?’
সম্মতির অপেক্ষা না করেই হাছান বলল, ‘আজ অন্তর আমাদের চা বানিয়ে খাওয়াক। দেখি কেমন পারে।’
গুরু তাঁর কথায় আঞ্চলিকতা বজায় রেখে বললেন, ‘আচ্ছা বানাক। তুমি কলেজের বেতন দাও নাই কেন? বিভাগীয় প্রধান স্যার খালি আমারে ঠেলে। তোমরারে লইয়া কই যাইতাম!’
হাছান বলল, ‘গুরু, ওই দিন বেতন দিতে গেছি অফিসে। গিয়া দেখি কেরানি সাহাবুদ্দিন সবার সঙ্গে রাগারাগি করতেছে। রাগের মাথায় আমার হিসাবে প্যাঁচ লাগাইছে এগারো শ টাকা। কোনোরকমে হিসাব মিলানোর পরে বলতেছে, তাকে নাকি বকশিশ দিতাম দেড় শ টাকা। শুনে আমার তো মাথা গরম! পরে বেতনের টাকায় হকার্স মার্কেট থেকে একটা শার্ট আর ফকির মার্কেট থেকে এক জোড়া জুতা কিনছি। বেতন আর দিই নাই। এই হইল ইতিহাস।’
গুরু হাসি থামিয়ে বললেন, ‘এই সাহাবুদ্দিন কোনো দিন ভালা অইত না। যাহোক, বেতন পরিশোধ করে দিয়ো। কয়দিন পর কলেজ সরকারি অইলে আর বেতন দেওন লাগত না তোমরার।’
অমিতাভ দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে হেসে বলল, ‘কলেজ সরকারি হতে হতে অনার্সজীবন শেষ!’
‘একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যাওয়া লাগে। বুঝো না মিয়া। সরকারি কাজ তাড়াহুড়া করে হয় না। তবে এ বছরের শেষ দিকে কার্যক্রম চালু হওয়ার আশা করা যায়। তোমরা সরকারি কলেজের সার্টিফিকেট পাইবা।’
গুরুর কথা শুনে সবাই পুলকিত হয়। সরকারি কলেজের সার্টিফিকেট! এ কি কম কথা!
সেই পদ্মিনী পথ ভুলে সিংহলেই ফিরে গেছে আবার। রেখে গেছে লাল–নীল হলুদাভ চিরকুট। লিখে যাওয়া প্রতিটি অক্ষর কালরাত হয়ে চোখের পাতায় বসে থাকে।
পাতিলে চা রান্না হচ্ছে। গরম পানিতে চা-পাতা ঢালতেই সুঘ্রাণ বেরোল। চা বানাতে বানাতে অন্তর ভাবছিল, একজন শিক্ষক কীভাবে তার ছাত্রদের সঙ্গে এত বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করতে পারেন? প্রয়োজনবোধে প্রমিত বাংলা, কখনো-বা আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার চলছে পুরোদমে। সমীহ, শ্রদ্ধা, শাসন, স্নেহ কোনো কিছুতেই সামান্য কমতি নেই। ছাত্র-শিক্ষকের এমন চমৎকার মুহূর্ত সে এর আগে কখনো দেখেনি। সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটল, আলেকজান্ডার—তাঁরাও কি এভাবে একে অপরের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন?
চা বানানো শেষ হলে অন্তর চায়ের কাপ এগিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘গুরু, আপনার চা।’
নতুন আরও একজনের ‘গুরু’ হতে পারায় স্যার বেশ সন্তুষ্ট হলেন। হাসিমুখে বললেন, ‘আমি একাই চা পান করব? তোমরাও নিয়া আসো।’
চায়ের কাপের সংকট থাকায় একজন স্টিলের মগে চা নিয়েছে। ছোট প্লাস্টিকের বোতল মাঝখানে কেটে আলাদা করে আরও দুটো কাপ বানানো হলো। তারপর চারজনের হাসিখুশি চায়ের আড্ডা জমল দীর্ঘ সময়। শেষে বৃষ্টির আভাস পেয়ে গুরু বেরিয়ে পড়লেন।
ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নেমে আসে। দিনের আলো নিভে গেলে বৈদ্যুতিক বাতির কৃত্রিম আলোয় বইয়ের মলাটগুলো চমকাতে থাকে। অদূরে অবস্থিত মসজিদ থেকে মুয়াজ্জিনের আজানের ধ্বনি ঘরময় প্রতিধ্বনি খেলে। এরই মধ্যে বেড়ে ওঠা তরুণের স্বপ্নবাজ চোখ বইয়ের কালো অক্ষরের দিকে অপলক চেয়ে থাকে। মস্তিষ্কে জমা হয় পৃথিবীর নানা প্রান্তের বিপুল তথ্য।
যেদিন আকাশে চাঁদ ওঠে আর সেই চাঁদের আলো জানালা ভেদ করে ঘরে ঢোকে, সেদিন তিনজন একত্রে বসে অর্থহীন কত কী শব্দ উচ্চারণ করতে থাকে! কখনো বেসুরো গলায় সুর তোলার চেষ্টা চলে। তারপর ক্লান্ত হয়ে যে যার ঘরে ঘুমাতে চলে যায়। অন্তর জেগে থাকে দীর্ঘক্ষণ। জানালার বাইরে ধূসর আকাশের দিকে তাকিয়ে চিলেকোঠার রোমাঞ্চকর রাতের স্মৃতি মনে হতে থাকে। এমনই এক রাতে মোহময় চাঁদের আলোয় সিংহল পেরিয়ে আসা কোনো এক মানবীর ছায়া পড়েছিল বিবর্ণ দেয়ালের ওপর। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে হাওয়ায় উড়তে থাকা ঘন কালো চুলে সেই পদ্মিনী একসময় আতিথেয়তা গ্রহণ করে নিঃশব্দে। তারপর চুম্বনে সিক্ত বাহুদ্বয় মহাকালের অনন্ত মায়ায় ঘুমিয়ে পড়েছিল ভোরের দোয়েল ডেকে ওঠা পর্যন্ত। এরপর কত যে অপেক্ষা, কত যে আকাঙ্ক্ষা পুড়ে পুড়ে ছাই হলো! সেই পদ্মিনী পথ ভুলে সিংহলেই ফিরে গেছে আবার। রেখে গেছে লাল–নীল হলুদাভ চিরকুট। লিখে যাওয়া প্রতিটি অক্ষর কালরাত হয়ে চোখের পাতায় বসে থাকে। ইদানীং অপূর্ব জ্যোৎস্নারাত নিদ্রাহীনতার কারণ হয়েছে।
চলবে...
বন্ধু, ভৈরব বন্ধুসভা