চিরকুট (ষষ্ঠ পর্ব)

প্রতীকীছবি: আশরাফুল আলম

পৃথিবীতে যখন নতুন আলো আসে, তখন পুরোনো দিনের আলো কে মনে রাখে! তাই আমাদের চিন্তা কেবল ভবিষ্যতের দিকে। অন্তর খুব দ্রুত সেই ভবিষ্যতের দিকে এগোতে থাকল। জানুয়ারির শুরুতে দুটো টিউশন হারাল। তাতেও ঠিক সামলে নেবে ভেবেছিল। কিন্তু আকস্মিক একটি সংবাদ তাকে আরও চিন্তিত করল। রাফি ঢাকার একটি স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে। স্কুলের হোস্টেলে সিট পেয়েছে।

অন্তর বুঝল, চিলেকোঠার দিন ফুরিয়েছে। এখন বই-পত্র, ব্যাগ নতুন ঠিকানার অপেক্ষায় আছে। সে ভেবেছিল, এ ব্যাপারে মামাকে কিছু জানাবে না। কিন্তু সেদিন মামা নিজেই এসে দেখা করলেন। বললেন, ‘আতিক সাব অনেক ভালো লোক। আমার কাছে তোর ব্যাপারে বলছে। অনেক প্রশংসাও করছে। নিজের ছেলেটারে আর ননীর পুতুল করে রাখতে চান না বলেই ঢাকায় ভর্তি করছে।’
অন্তর বলল, ‘হ্যাঁ, মামা। আমাকে সবই বলেছে। তবে একটা বিষয় ভেবে বেশ আনন্দিত হই। রাফি সিঁড়িতে একা চলাচল করত না, অথচ এখন থেকে স্কুলের হোস্টেলে থাকবে। আমার চোখে ও এখন অনেক বড়।’
‘মানুষ চিরকাল শিশু থাকে না তো।’
‘ঠিকই বলেছ, মামা। আমিও একসময় শিশু ছিলাম। এখন হয়েছি সৈনিক।’

আরও পড়ুন

মামা অন্তরকে আবার নিজের বাড়িতে নিয়ে যেতে সাধাসাধি করলেন। কিন্তু সে কিছুতেই রাজি হলো না। বলল, ‘আমি মেসে থাকব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কিন্তু তেমন চেনা-জানা নাই। কী করা যায় ভাবছি।’
‘মেসে থাকবি? ঠিক আছে। আমি তোর জন্য ভালো একটা মেসের ব্যবস্থা করতে পারি কি না দেখি।’

পরদিন মামা বেশ কয়েকটা মেসের তথ্য নিয়ে হাজির হলেন। অন্তর সেসব দেখে একটুও ভরসা করতে পারল না। নিজে গিয়ে যাচাই-বাছাই করল। খুঁজে খুঁজে একই কলেজের আলাদা বিভাগে পড়ুয়া দুজনকে পেয়ে গেল। তারা সমবয়সী, কিন্তু সমমনা হবে কি না, তা ভাবার সময় কোথায়? পরের মাসে সেখানেই উঠবে বলে সিদ্ধান্ত নিল অন্তর। আপাতত নিজেকে প্রস্তত করে নেওয়া দরকার।

চিলেকোঠায় শেষের দিনগুলো যখন এক-এক করে কেটে যাচ্ছিল, তখন অন্তরের ভাবনার জগতে বেশ পরিবর্তন দেখা গেল। একাকী বসবাস করাটা একসময় কতই না মনোবেদনার কারণ ছিল। টবে রাখা ফুলের গাছগুলোয় নিয়ম করে রোজ ফুল ফুটত। সেসব শুকিয়ে ঝরে গেলেও তা দেখার ইচ্ছা হতো না। বইগুলো একবার পড়েই ফেলে রাখত এখানে-সেখানে। তারপর ধুলো জমে বইয়ের মলাট বিবর্ণ হয়ে পড়ে থাকত। হঠাৎ একদিন তাড়াহুড়ো করে সেসব ঝেড়েঝুড়ে পরিষ্কার করত। তখন দিনগুলো বড্ড একঘেয়ে ছিল। সেই সব দিনের ইতি টানতে টানতে একদিন মনে হলো, চিলেকোঠার বারান্দায় জমা জল আর জানালায় মৃদু বাতাস ওর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ আর মধুর ছিল। কাকডাকা ভোর আর অন্ধকার নীরব রাত্রি কতই না আপন ছিল! স্বপ্নের পথে চলতে গিয়ে এতকাল সেসব দেখার সুযোগই হয়নি। ফেলে আসা সেসব দিনের কথা এত দিন পর হঠাৎ চোখের সামনে ভাসতে লাগল। নদীর লক্ষ্য থাকে সমুদ্রে পতিত হওয়ার, কিন্তু সময় মানুষকে নিয়ে যায় অজানার উদ্দেশে, যা আমরা কখনো ভাবতেও পারি না। তাই হয়তো প্রস্তুত হওয়ার একটু সুযোগ মেলে না শেষে।

অন্তর এই প্রথম চিরকুট লিখেছে। শূন্য চিলেকোঠার মেঝেতে রেখে আসা চিরকুটখানি কখনো আদ্রিতার হাতে পৌঁছাবে কি না, সে জানে না।

শহরের অলিগলিতে অজস্র জীবনের গল্প পড়ে আছে। সেসব গল্পে মধ্যবিত্ত জীবনের যত হাসি-কান্নাই থাকুক, দিন শেষে তা আড়ালেই থেকে যায়। হাজারটা পথ পাড়ি দিয়ে সংসার-সমরে টিকে থাকা কম কথা নয়। অন্তর জানে, এই দীর্ঘ পথে তাকে একাই সংগ্রাম করতে হবে এবং সব শেষে অবশ্যই জয়ী হতে হবে। পরিবারের একমাত্র অবলম্বন সে। মা-বাবার মনে কত স্বপ্ন বাসা বেঁধে আছে! একদিন সেসব বাস্তব রূপ লাভ করবে। তত দিন পর্যন্ত পেছনে ফেরা বারণ।

যেদিন চিলেকোঠা ছেড়ে মেসে উঠবে, সেদিন বাড়ির সামনের রাস্তায় দুটো বইভর্তি বস্তা, কিছু আসবাব আর কাপড়ের গাঁটরি নিয়ে ভ্যানের জন্য অপেক্ষা করছিল অন্তর। এ সময় প্রতিবেশী কয়েক জোড়া কৌতূহলী চোখ ওর চলে যাওয়ার দৃশ্য দেখে কী যেন বলাবলি করছিল। সেদিকে নজর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করল না সে। হঠাৎ ছোট একটি ট্রাক দ্রুতগতিতে সামনে দিয়ে চলে যাওয়ায় ধুলায় চারপাশ ঘোলাটে দেখাল। পরিষ্কার কাপড়ের ওপর সেসব ধুলা উড়ে এসে জমতে থাকায় ব্যাপারটা বেশ বিশ্রী আকার ধারণ করল। বিরক্ত হয়ে সে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল।

এমন সময় ভ্যানওয়ালাকে আসতে দেখে অন্তর স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। ভ্যানওয়ালা তার ভ্যানগাড়ি থামিয়ে পান খাওয়া লালচে দাঁত বের করে একটু হেসে নিল। তারপর বলল, ‘দেরি অইয়া গেছে। কিছু মনে কইরেন না।’

বস্তা দুটো তুলতে গিয়ে লোকটা এমন ভাব করল, যেন সে এর আগে এত ভারী বস্তা কখনো দেখেনি। শেষে অন্তর নিজেও হাত লাগাল দেখে খুশি হয়ে লোকটা বলল, ‘বইয়ের ওজন বেশি না অইলে জ্ঞানের ওজন বেশি অইব ক্যামনে! এত্তগুলা বই কিনতে টেকাও লাগে অনেক?’
‘তা লাগে অবশ্য।’
‘দোয়া কইরেন। আমার একটা ছেলে আছে। ক্লাশ টুয়ে পড়ে।’

অন্তর মুচকি হাসল। সে ছোট থেকেই দেখে আসছে, সন্তান যেন পড়ালেখায় ভালো করতে পারে, সে জন্য অন্য লোকের দোয়া কামনা করে গরিব মানুষেরা। ঠিক যেমন ঈশ্বরী পাটনী দেবীর কাছে বর প্রার্থনা করে, তার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে।

ভ্যানের একপাশে উঠে বসতেই সেটি চলতে শুরু করল। প্রথমে ধীরে। তারপর ক্রমেই গতি বাড়তে থাকল। গলির শেষ মাথায় আসার আগে অন্তর একবার পেছনে তাকিয়ে দেখল, দোতলার বারান্দায় এক জোড়া চোখ এখনো অপলক তাকিয়ে আছে। বলতে না পারা কতশত সংলাপ আর প্রাণের আকুতি সেই চোখে জমা। আজ চাইলেও মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ নেই। ভ্যানের চাকায় দূরত্ব বাড়ছে।

অন্তর এই প্রথম চিরকুট লিখেছে। শূন্য চিলেকোঠার মেঝেতে রেখে আসা চিরকুটখানি কখনো আদ্রিতার হাতে পৌঁছাবে কি না, সে জানে না। অন্য কারও হাতে পড়লে ভয়ানক ব্যাপার হয়ে যেতে পারে। কিন্তু আজ ভয় নেই। যে এতকাল অজস্র কথা লিখে পাঠিয়েছে, তার উদ্দেশে দুটো কথা লিখে আসতে এখন আর ভাবনা কী!
চলবে...

বন্ধু, ভৈরব বন্ধুসভা