জীবিত কবি, মৃত কবি: প্রসঙ্গ ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘সব চরিত্র কাল্পনিক’
ব্যক্তিজীবনে তিনি রবীন্দ্রনাথ ও সত্যজিৎ রায়ের অনুসারী। তবে চলচ্চিত্রের বয়ানের ঢঙে মানিক বাবুকে (সত্যজিৎ রায়) ঋতুপর্ণ ছাড়িয়ে গেছেন কি না, তা চলচ্চিত্রবোদ্ধারা যাচাই করবেন!
ঋতুপূর্ণ ঘোষ প্রায় প্রতিটি চলচ্চিত্রে চরিত্রের মনোজাগতিক সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম এলাকায় যাতায়াত করেছেন। সম্পর্কের সঙ্গে সম্পর্কের গভীরতা, ক্ষেত্রবিশেষে অধিকারের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েনের স্বরূপ বিশ্লেষণে শৈল্পিক প্রকাশের দ্বারস্থ হয়েছেন। ব্যক্তিজীবনে তিনি রবীন্দ্রনাথ ও সত্যজিৎ রায়ের অনুসারী। তবে চলচ্চিত্রের বয়ানের ঢঙে মানিক বাবুকে (সত্যজিৎ রায়) ঋতুপর্ণ ছাড়িয়ে গেছেন কি না, তা চলচ্চিত্রবোদ্ধারা যাচাই করবেন! তিনি নিজেকে শারীরিকভাবে যেমন ভেঙেছেন, তেমনি ভেঙেছেন শিল্পসত্তাকেও! অ্যাড ফার্মের ক্রিয়েটিভ কনটেন্ট রাইটার থেকে চলচ্চিত্র; মাঝখানে সিরিয়াল অথবা অবসরে লিরিক লেখা। এসব নিজেকে বাজিয়ে দেখা হলেও হতে পারে; হতে পারে ঋতুপর্ণের স্বভাবজাত। তবে বাংলা আর্টফিল্মের প্রকাশভঙ্গিতে তিনি অনন্য! বিশেষত নারীর মনোজাগতিক চিন্তাকে দৃশ্যায়ন ও বিভিন্ন পরিচর্যাসমেত উপস্থাপনে বাঙালি অন্য যেকোনো চলচ্চিত্রকারের চেয়ে ঋতুপর্ণ ঘোষ ভিন্ন, স্বতন্ত্র ও স্বতঃস্ফূর্ত।
প্রসঙ্গ: সব চরিত্র কাল্পনিক
চলচ্চিত্রে কবিতার ব্যবহার হরহামেশাই হয়ে থাকে। চেতনে-সচেতনে চিত্রনাট্যকার চলচ্চিত্রের নট-নটীদের কণ্ঠে কবিতা সেঁটে দেন; অর্থাৎ কবিতা চলচ্চিত্রে আসে, কিন্তু অজানা থেকে যায় কবির জীবনযাত্রা। তেমনি এক কবি ও তাঁর স্ত্রীর সম্পর্কের এপার-ওপারের মঞ্চায়ন হয়েছে এই সিনেমায়।
নীল একজন কবি, যিনি শুধু কবিতাই বোঝেন! কবিতা তাঁর সাধনা কিংবা কবিতার পঙ্ক্তিতে তাঁর আত্মনিবেদন। কবিতার ছত্রে, ছন্দে, স্তবকে কিংবা শব্দের সঙ্গে তাঁর নৈমিত্তিক বোঝাপড়া, লেনাদেনা। যে মৃত্যুকে হয়তো অনায়াস ভাবেননি, অকালে সেই মরণ এসে কবির সঙ্গে সন্ধি করল।
একজন জীবন্ত কবি, যিনি জীবনকালে তাঁর আত্মভোলা প্রকারান্তরে কবিতা বাদে সর্বভোলা স্বভাবহেতু স্ত্রীর ভালোবাসা পাননি। তবে শরীরে মৃত; কবিতায় জীবিত কবি সেই স্ত্রীর শ্রদ্ধা-ভক্তি-ভালোবাসা নিজের করে নিয়েছেন। মৃত কবির কবিতা জীবন্ত করে তুলেছে কবি নীলকে (ইন্দ্রনীল মিত্র)।
জীবদ্দশায় কবিকে কিংবা তাঁর কবিতাকে চিনতে-জানতে পারেননি স্ত্রী রাধা; এ কারণে অবজ্ঞার কমতি ছিল না। সেই স্ত্রী স্বামীর প্রয়াণের পর তাঁর স্মরণসভামঞ্চে বসে স্বামীর কাব্যস্তুতি শুনে পুলকিত, একই সঙ্গে বিব্রত হন! কবিতার চরণে চরণে তাঁর প্রতি নীলের মোহাবিষ্টতার প্রকাশ বাচিকশিল্পীদের কণ্ঠে শুনে কিছুটা আত্মশ্লাঘা ও আত্মগ্লানিতেও ভোগেন।
অর্থের প্রতি অনেকটা সচেতন বিমুখতা আর বাঁধা চাকরির প্রতি অনীহা বড় কবিমাত্রেরই স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্ট্যের ব্যতিক্রম নয়, সমান্তরালে ছিলেন কবি ইন্দ্রনীল মিত্র। সংসারজীবন তাঁর ছিল, কিন্তু সাংসারিক বোঝাপড়া, অর্থ উপার্জনের ইচ্ছা কিংবা দৈনন্দিন হিসাব-নিকাশ হতো না। এ জন্য পত্নীর গালমন্দ হজম করতে হতো প্রায়ই। গালমন্দতে তাঁর বিন্দুমাত্র খেদ বা ক্ষোভ কোনোটাই হতো না।
কবি নীল আত্মভোলা। কবিতা বাদে আর কিছুই বোঝেন না! নিজের স্ত্রীর প্রতি শরীরের টান আছে, তবে তা কবিতার চেয়ে বেশি নয়। পেশায় প্রকৌশলী হলেও তা পেশা হিসেবে কখনোই নিতে পারেননি। কর্মস্থলে অনুপস্থিতি, নিয়ম মেনে দেরি করা তাঁর সাধারণ ব্যাপার। ভালো লাগার পারদ কমলেই তিনি চাকরিকে বিদায় দেন। নতুন পত্নীকে গাড়িতে রেখে কবিতায় মুখর হয়ে থাকেন; সেই মুখরতার মাত্রা এতটাই বেশি যে ট্যাক্সিতে রেখে আসা স্ত্রীর কথা ভুলে ট্যাক্সিটা বিদায় করে দেন। অসুস্থ পত্নীর শয্যাপাশে বসে টেলিফোনে বন্ধুর সঙ্গে গল্পে মাতেন, কিন্তু চিকিৎসককে কল করতে ভুলে যান! তবু অসুস্থ স্ত্রীর প্রসঙ্গ কবিতায় আনতে ভুল হয় না! বাসায় বাজার করেন না, কিন্তু পুরস্কারপ্রাপ্তি উপলক্ষে বন্ধুদের নিমন্ত্রণ করে পার্টি করেন! অথচ বাসা থেকে বের হওয়ার সময় কাজের লোকটি বাজারের কথা বললে ‘বাইরে খেয়ে নেব’ সুরে বিদায় নেন! একবারের জন্য ভাবেন না, কাজের লোকটি কী খাবেন!
কাজরী রায় নীলের কাব্যরমণী। রাধার (নীলের স্ত্রী) প্রশ্ন ‘কাজরী কে?’ উত্তর আসে ‘তুমি নও!’ কিন্তু স্মরণসভায় আবিষ্কৃত হয়, সে-ই (রাধা) নীলের কাজরী রায়!
কবিমাত্রই আর্থিক ঔদাসীন্যের সমান্তরালে আর্থিক সংকট কিংবা পাবলিশার্সের ওপর নির্ভরতা; ব্যতিক্রমহীন কবি নীলও। কবির চিন্তা বা কল্পনা যদি তাঁর উদ্দীপক হয়; তবে শব্দ তাঁর উদ্দীপনার প্রধানতম উপাদান। যেখানে প্রতিটি শব্দই তাঁর কাছে পবিত্র।
কবিপত্নী রাধা স্কুল বয়সেই কবিতা লিখতেন ক্রিয়েটিভ রাইটিংয়ের ক্লাসে। পরবর্তীকালে আলস্যের কারণে বাংলা কবিতা অনুবাদের সুবাদে কলকাতার বাঙালি কবির সঙ্গে তাঁর পরিণয় ও মোহাবিষ্টতা। সেই মোহ বিরক্তিকর হয়েছে দিনে দিনে। নীলের সহকর্মী ফটোগ্রাফার শেখরের সঙ্গে সম্পর্কে থেকেছেন অনায়াসই। শেখর চরিত্রটিতে যীশু সেনগুপ্ত দারুণভাবে টেনে দিয়েছেন চলচ্চিত্রের প্লটখানি। শেখর ফটোগ্রাফির শিল্পী, তাই শিল্প ও শিল্পীর কদর বুঝেছিলেন। ইন্দ্রনীলের ইংরেজি না জানা নিয়ে রাধার আক্ষেপ ছিল, কিন্তু শেখরের ছিল না। নীলের প্রতি তাঁর ভক্তিরূপের বহিঃপ্রকাশ আছে! নীলের জীবিতাবস্থায় শেখর ও রাধার সম্পর্ক সংশয়হীন ছিল, কিন্তু মৃত্যর পর রাধা নীলকে কাছে এনেছে, দূরে সরিয়ে দিয়েছে শেখরকে!
নন্দর মা (প্রিয়বালা দাস/ দুলারি) চরিত্রটি অপ্রধান চরিত্র হলেও ভূমিকা অপ্রধান নয়। বিশ্বস্ততা, ভালোবাসা ও ভক্তির দরুন রাধা ও নীলের সুখ-দুঃখের সহচর হয়েছেন। হয়েছেন নীলের কবিতার অনুষঙ্গ। পূর্ব বাংলা থেকে দেশভাগের নির্মমতায় বাবার দুলারি, ঠাকুমা-ঠাকুরদার প্রিয়বালা দাস নীল-রাধার কাছে নন্দর মা।
ইন্দ্রনীল মিত্র: প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়
রাধিকা মিত্র: বিপাশা বসু
শেখর: যীশু সেনগুপ্ত
নন্দর মা: সোহাগ সেন
কাজরী রায়: পাওলি দাম
লেখক: প্রভাষক, বাংলা বিভাগ, সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজ, যশোর।