কিন্তু বাবার অন্তর্ধানের পর তার পোষা কবুতরগুলোকে যখন আধার না খেয়ে একে একে মরতে দেখেছি, প্রকৃতি তখন আমাকে প্রবলভাবে আস্তিক করে তোলে।
‘পাখি সব করে রব, রাতি পোহাইল...’
ভেজা কপাটে আমার মৃদু স্পর্শেই ঘরের ভেতর থেকে মায়ের কণ্ঠস্বর
আঁর সুজা নি রে!
হুঁ
মুহূর্তেই খুলে গেল কপাট। মক্তবপড়ুয়া শিশু যেন আমি; মা আমাকে বুকে জড়িয়ে নিল। প্রথম উড়তে শেখা পাখির ছানার মতো মায়ের বাহুবন্ধনী ছাড়িয়ে নিলাম।
আমনে রাইতে ঘুমান ন?
হুঁ
মায়ের চোখ জলে টলমল করছে। পৃথিবীর তাবৎ জিজ্ঞাসা নিয়ে মনে হচ্ছে, মা আমার বোবা প্রকৃতি; তার ঠোঁট যেন বোবা বৃক্ষের মতো ঝড়ের কবলে কাঁপছে। এখন কি তাকে ব্যাখ্যা দেওয়া উচিত, কেন অসুস্থতার কথা শুনেও আমার আসতে দেরি হলো? বলা উচিত, আমার মোবাইল ও মানিব্যাগ ছিনতাই হলো? বসিরহাট থেকে নয়াবাজার অবধি সম্পূর্ণ পথ হেঁটে আসতে হলো—এসব কথা? কিছুই বললাম না। মা আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে খাটিয়ার ওপর বিছানো জায়নামাজে দাঁড়িয়ে গেলেন। নড়বড়ে খাটিয়া ক্যাঁক ক্যাঁক শব্দে যেন মায়ের নিঃসঙ্গতা আর হাহাকারকে জানান দিল। আমার আগমনের আনন্দে মা শুকরানা নামাজ পড়ছে। সারা রাতের ক্লান্তি শরীরের ভাঁজে নিয়ে বিছানায় লুটিয়ে পড়ি। মাথার ভেতরটা হক ব্রাদার্স স্টোরের নড়বড়ে নামফলকের মতো ঝিমঝিম করছে। সারা রাতের ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি এতক্ষণে অপেক্ষার বাঁধ ভেঙে ঝুম বৃষ্টিতে নিমজ্জিত হলো।
খবর পেলাম, প্রতিবেশী রাষ্ট্র টপ্পা বাঁধ খুলে দিয়েছে। এ কারণে উজির নগরের নিম্নভূমি প্লাবিত হচ্ছে। খুলে দেওয়া বাঁধের মৌসুমি পানির ঢল আর কয়েক দিনের টানা বর্ষণে মুহুরীপাড়া ইতিমধ্যে বন্যায় ডুবে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের গ্রাম ডুবতে আর বেশিক্ষণ লাগবে না। প্রকৃত রাষ্ট্রযন্ত্র দ্বারা মানুষ পরিচালিত হলে সাম্য বিরাজ নিশ্চিত। কিন্তু তার উল্টো হলে মানুষযন্ত্রই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিহিংসায় লিপ্ত হয়, যা কখনো শুভকর নয়।
কদু নেতা! ওরা টপ্পা বাঁধ খুলে দিয়ে আমাদের দেশ ডুবিয়ে দিচ্ছে। জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে আপনাদের এখন কী করা উচিত?
উচিত! খোলাখুলি অনেক কিছুই করা উচিত। আপনেরা নেত্রীর ওপর ভরসা রাইখেন। গুজবে কান দিয়েন না।
বন্যা নিয়ন্ত্রণে আপনাদের ব্যর্থতা কেন?
এসব বিরোধী দলের ষড়যন্ত্র।
আঁঙ্গো খেতখামার ব্যাজ্ঞেন ডুবি গেছে। হোলাহাইন লই অঙ্গা আমরা থাকুম কন্দায়? কিয়া খামু?
ইয়ে অ্যাঁ অ্যাঁ...
দমকা হাওয়ায় ছেঁড়া বৃষ্টি বাইরে চৌকাঠের অদূরে কবুতরের খোপের ওপর পড়ছে। কবুতর জোড়া ডানা ঝাপটে ডাকছে। আশ্রয় যখন অরক্ষিত হয়ে যায়, পাখিরা তখন ডানা ঝাপটে আকুতি করে। কিন্তু আশ্রয় ছেড়ে যায় না। মানুষের ডানা নেই; কণ্ঠস্বরই তার ডানা। তা কখনো উঁচু, কখনো নিচু হয়। মানুষও আশ্রয় ছেড়ে যেতে পারে না। প্রকৃতি যেন সব প্রাণীকে একই মায়ার গিঁটে বেঁধেছে। এখানে এই কবুতরের খোপে—আমার দাদা যখন বেঁচে ছিলেন—১৬ জোড়া কবুতর ছিল। অতি যত্নের তাঁর শখের কবুতরকে আধার দিতে দিতে তিনি আমার বাবাকে বলতেন, ‘আঁঈ ন থাইকলে আঁর কইতরও থাইকত নয়, দেইস!’
সত্যি সত্যি তিনি যে রাতে মারা গেলেন, কবুতরগুলোও সারা রাত মানুষের মতো আহাজারি করল। পরদিন সকালে তারা কোথায় উড়াল দিল, আর ফিরে এল না। দাদির মুখে শোনা এই গল্পের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে কিঞ্চিত সন্দেহ ছিল। কিন্তু বাবার অন্তর্ধানের পর তার পোষা কবুতরগুলোকে যখন আধার না খেয়ে একে একে মরতে দেখেছি, প্রকৃতি তখন আমাকে প্রবলভাবে আস্তিক করে তোলে। রহস্য ও মায়া কখনো সমান্তরালে চলতে পারে না। এদিকে আমার মা, বাবার শোকে দিনে দিনে আধমরা হয়ে যাচ্ছে। সে না পারছে আশ্রয় ছেড়ে উড়াল দিতে, না পারছে সংসারের খড়কুটো আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকতে।
সুজা রে! বাবা সুজা!
মায়ের ডাকাডাকিতে বেলা করে ঘুম ভাঙল। চোখ খুলতেই তার উৎকণ্ঠিত চোখেমুখে ভয়ার্ত কণ্ঠস্বর।
সব্বনাশ অই গেছে রে! সব্বনাশ!
কী, কী অইছে, আম্মা?
কী দেখলাম আঁঈ! কী দেখলাম!
আরে, কিয়া অইছে, হিয়ান কন আগে?
রেণু আছে না?
কোন রেণু?
আরে, নুরুর মাইয়া।
হুঁ।
দইন বাইর গো আমগাছের লগে গলায় ফাঁস দিছে।
মায়ের মুখে এই সংবাদ শুনে বিছানা ছেড়ে দক্ষিণ বাড়ির দিকে ছুট লাগাই। তিন-চার মিনিটের পথ। রাস্তায় এক হাঁটু পানি। সেখানে যেতে দ্বিগুণ সময় লাগল। ভারী বর্ষণের ঢল উপেক্ষা করে শত শত মানুষ রেণুর ঝুলন্ত লাশ দেখার জন্য ভিড় করেছে। যতই প্রতিকূল পরিবেশ হোক না কেন, গ্রামের মানুষের কানে এসব খবর বাতাসের চেয়ে বেশি গতিতে পৌঁছায়। আমিও উৎসুক জনতার মধ্যে শামিল হলাম। মাটি থেকে ১০-১২ ফুট উঁচুতে আমগাছের ডালে ওড়না পেঁচানো একটি ১৭-১৮ বছরের তরুণীর লাশ ঝুলছে। তার চোখ ও জিব ভয়ংকর। সাত-আট মাসের গর্ভবতী, পেটের স্ফীতি দৃশ্যমান। দেখেই বুকের ভেতরটা ধক করে ওঠে। শরীরের সব ইন্দ্রিয় যেন মস্তিষ্কে ভর করে। চোখের চারপাশটায় ঝাপসা দেখি। বৃদ্ধ নুরু আমগাছটির নিচে হেলান দিয়ে বাক্রুদ্ধ হয়ে শূন্যে তাকিয়ে আছে। দূরে মেয়েলি কান্নার কোরাস শোনা যাচ্ছে।
জামাই হারামজাদা হিডি খ্যাদাই দিছে।
মাইডার কপালে সুখ সইল না। হ্যাতে আরেজ্ঞা বিয়া কইচ্ছে।
আমান মেম্বার লাশ উদ্ধারের জন্য জনা পাঁচেক পুলিশ সদস্য নিয়ে আসে। তারা গাছ থেকে রেণুর লাশ নামিয়ে তাকে কলাগাছের ভেলায় ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ক্রমে কৌতূহলী জনতার ভিড় বাড়তে থাকে। কিছুক্ষণের জন্য সময় যেন থেমে যায়।
এ ঘটনার আকস্মিকতায় তিন-চার দিন জ্বরাক্রান্ত হয়ে বিছানায় পড়ে থাকি। ঘোরের মধ্যে চোখের সামনে বারবার রেণুমূর্তি ভেসে ওঠে। মা সারা রাত জেগে মাথায় জলপট্টি দিয়ে সেবা করে যায়।