কামারশালা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

রাত প্রায় তিনটা। হাতে ঘড়ি নেই। সময় দেখার জন্য বিকল্প যা, সেই মুঠোফোনও নেই। তবু আমার অনুমান বলে, এই মুহূর্তে রাত কাঁটায় কাঁটায় তিনটা। বড় চৌরাস্তা পাড়ি দিয়ে এখন আমি নয়াবাজারের মোড়ে। একটা মাত্র বৈদ্যুতিক বাতি ক্ষীণ আলো দিয়ে হক ব্রাদার্স স্টোরের মাথায় জ্বলছে। বসিরহাট থেকে নয়াবাজার কম দূরত্ব নয়। প্রায় ঘণ্টাখানেক হেঁটে ক্লান্ত আমি এবার থামলাম। বাজারে সব মিলে ৫০টার মতো দোকান হবে। একে তো গ্রামের বাজার, তার ওপর শেষ রাত; মানুষের মতো দোকানগুলোও যেন সাটার টেনে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। বর্ষার মৌসুম। কোলাব্যাঙের ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ শব্দ পরিবেশকে আরও মোহাচ্ছন্ন; কিঞ্চিৎ ভীতিকরও করে তুলছে। হক ব্রাদার্স দোকানের সিঁড়িতে গিয়ে বসলাম। দোকানের নড়বড়ে নামফলকটা কোনোরকমে নিজের বার্ধক্যকে তাচ্ছিল্য করে হাওয়ার সঙ্গে লড়ে যাচ্ছে। বছর পনেরো আগের কথা। আমি নয়া কৈশোরে বাড়ন্ত। হক ব্রাদার্সের মালিক হক মিয়া কেবল দোকানটি দিয়েছেন। এক রাতে অসুস্থ দাদির যায়-যায় অবস্থা। আমাকে পাঠানো হলো বাপ-চাচাকে ডেকে আনার জন্য। নয়াবাজারে এসে দেখি দোকানপাট সব বন্ধ। চারদিকে নীরব, অন্ধকার। ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে সেই রাতে এই সিঁড়িতে আশ্রয় নিলাম। অগত্যা ঘুমিয়ে পড়লাম। ফজরের সময় মসজিদের মাইকে দাদির মৃত্যুসংবাদ শুনে আমার ঘুম ভাঙে। কোনো দিন সেই দুঃস্মৃতির কথা ভুলতে পারব না।

চৌকিদারের বাঁশির শব্দে সংবিৎ ফিরে এল। বুড়ো চৌকিদার নুরু চাচা সামনে এসে তার চোখকে আমার নাক পর্যন্ত এগিয়ে দেয়ার পর আমাকে চিনতে পারল।
—সুজানি ও! তুঁই অ্যাত রাইতে কন্তুন আইছ?
—আর কইয়েন না, কাগা-আম্মার অসুখের কথা হুনি ঢাকার তুন হথ ধইচ্ছি। মছিবত, আঁর ছিনতাই অইছে! মোবাইল, ট্যায়া, ঘড়ি-ব্যাক লই গেছে।

নুরু চাচার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। খুক্কুর খুক্কুর করে সে এমনভাবে কাশল যেন যেকোনো সময় কাশির সঙ্গে তার নাড়িভুঁড়িও বেরিয়ে পড়বে। দেশি বিড়ির বান থেকে একটা বিড়ি ধরাতে ধরাতে আমার দিকে মায়ার চোখে তাকাল।
—আহারে বা–জি, তুঁই কিয়া ক! তুঁই ক্যামনে আইছ? কিচ্ছু খাইছোনি?
ক্ষুধায়, তৃষ্ণায় কাতর আমি তার দিকে ক্লান্ত চোখ নিয়ে তাকালাম। কিছুই বললাম না। হয়তো এই মুহূর্তে বলার শক্তিটুকুও নেই। অথবা তার সঙ্গে কথায় পেরে উঠতে পারব না, এই সংশয়। নুরু চাচা একজন পোড় খাওয়া মানুষ। শুনেছি, যৌবনকালে সে যাত্রাপালায় বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করত। তার বিয়ে নিয়ে একেকজনের একেক মত। কেউ বলে সাতটা, কেউ বলে নয়টা। কিন্তু পাঁচের নিচে কেউ বলে না। ভারি রাগী মানুষ। পান থেকে চুন খসলেই স্ত্রী-বিতাড়ন তার সহজাত স্বভাব ছিল। নিঃসঙ্গ নুরু এই বুড়ো বয়সে বাজারের পাশে সরকারি জায়গায় একটা শনের ঘরে বাস করে; একা। ঘরের জন্য একবান টিন পেতে গত নির্বাচনে সে আমান মেম্বরের মিছিলে গলা ফাটিয়ে স্লোগান দিয়েছিল। কথা ছিল, নির্বাচনে জিতলে আমান টিনের ঘর তুলে দেবে। আমান এখন মেম্বর। কিন্তু নুরু চাচাকে সেই ভাঙা শনের ঘরেই থাকতে হয়। চৌকিদারি করে যা পায়, তাতে খাইখরচও কুলায় না। নুরু তার এই দুর্দশার জন্য সবাইকে দোষারোপ করে; মানে সবকিছুকেই। রাজনীতি, সমাজ, ধর্ম, সংস্কৃতি এমনকি এই যে আমি তার সঙ্গে বসে আছি, টুকটাক কথা বলছি, কিছুক্ষণ পর অন্য কাউকে পেলে তাকে আলবৎ বলবে, এই পোলার জন্যই আমার এই অবস্থা। তাই তফাৎ–দূরত্বে চুপ থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছি। সে কিন্তু কথা বলেই যাচ্ছে। প্রসঙ্গ এখন দেশের রাজনীতি।
—হালার কদু ন্যাতায় ইয়ান কোনো কাম কইচ্ছেনি! আঁই নিজে আঁর দশ আঙুল দি দইশ গা ভোট হ্যাতারে দিছি। হারি নও হার আঙুল দিও ভোট দিতে। হের পরেই না হ্যাতে জিচ্ছে। অঙ্গা হ্যাতে ব ন্যাতা অইছে। অঙ্গা হ্যাতে আঙ্গো রে চিনে না। তুঁই কিয়া ক, হ্যাতে কি এলাকায় এক্কানা উন্নয়ন কইত্তে হারে না?
আমি নিরুত্তাপ জবাব দিলাম, হুঁ।
—আরে হুঁ কিয়া! এই চ-আঙ্গো রাস্তা ইগা-কাঁচা, ভাঙ্গাচুরা, একগিরা লোদ। হ্যাতারে এই লই তিনবার ভোট দি জিতাইছি। হতিবারই হ্যাতে রাস্তা ইগা পাকা কইরবার ওয়াদা কইচ্ছে। বেঈমান হালার হুত হালা! সামনেরবার ভোটের লাই আইলে জুতা দি হিডুম।

নুরু চাচা এভাবে বিরতিহীন কথা বলে যাচ্ছে। আমি শুধু কিছুক্ষণ পরপর হুঁ হুঁ জবাব দিয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ তার কথা থেমে গেল। মুখ বিকৃত করে সে এমনভাবে গলার কফ ফেলল, দেখে আমার ঘেন্না ধরে গেল। এরই মধ্যে সে আরেকটা বিড়ি ধরাল। তার সঙ্গে রাখা পুঁটলি থেকে একটা বোতল বের করে কী যেন ঠকঠক করে গিলল। বিশ্রী একটা গন্ধ নাকে এল। বুঝলাম, এটা দেশি মদ। পুরো বোতল সে একনিমেষে শেষ করে টাল হয়ে অনেকক্ষণ চুপ মেরে বসে রইল। তারপর হঠাৎ হাউমাউ করে প্রকাণ্ড চিৎকারে সে কেঁদে উঠল।
—ও আঁর রেণু মা রে! রেণু মা!

নিঃসঙ্গ নুরুর জীবনে শত কাঠিন্যেও কেউ তাকে কখনো কাঁদতে দেখেনি। আজ হঠাৎ কোথাকার কোন রেণুর নাম ধরে তার এই কান্না আমাকে অবাক করল।
—রেণুটা কে? কৌতূহলে জিজ্ঞেস করলাম।
—আঁর মাইয়া রে, ভাই! জামাই হারামজাদা হিঠি খ্যাদাই দিছে। পোয়াতি মাইয়া আঁর। কন্দাই আছে কেউ কইতা হারে না। তিন দিন ধরি হেতির কোনো খবর নাই।

নুরু চাচাকে নেশায় পুরোপুরি ধরেছে। তার কথার পিঠে কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। অনবরত কাঁদছে। নেশায় সে পুরোপুরি বুঁদ। আমাকে বা’জি (ভাতিজা) না বলে ভাই বলছে। তার যে একটা কন্যাসন্তান আছে, আমার জানা ছিল না। একদিন যে নুরু নিজের মেজাজ-মর্জিতে ইচ্ছা হলে বিয়ে করেছে, ইচ্ছে হলে নিপীড়ন করে ছেড়ে দিয়েছে, কখনো তাকে কেউ এ নিয়ে অনুতপ্ত হতে দেখেনি। আজ নিজের মেয়ের একই হাল। তাতেই তার পিতৃহৃদয় বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। এটা কি প্রকৃতির বিচার? আমার মা প্রায়ই বাবাকে শুনিয়ে বলতেন, পুরুষ মাইনষের কামারের মন। আগুন নিয়া খেলা করে, লোহার কারিগর। নুরু কি তার কামারশালায় জলের অভাব বোধ করছে এই নিঃসঙ্গ শেষবেলায়? হয়তো তা–ই। এরই মধ্যে রাতের আঁধার কেটে সুবহে সাদিকের আলোয় চারদিক ফরসা হলো। বৃদ্ধ নুরুকে একা রেখে আমি বাড়ির পথে পা বাড়ালাম। রাস্তা বর্ষার কাদাজলে একাকার। উদ্বিগ্ন আমার মা হয়তো সারা রাত না ঘুমিয়ে পথ চেয়ে বসে আছেন।