হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্যাকাশে ‘পোকা’ এক ভিন্ন ধরনের কাহিনি নিয়ে লেখা উপন্যাস। এক পরাবাস্তব মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা, যেখানে লেখক তাঁর চিরায়ত সরল গদ্যের আড়ালে লুকিয়ে রেখেছেন মানবমনের জিজ্ঞাসাগুলো। উপন্যাসটি কোনো গতানুগতিক রহস্য বা প্রেমকাহিনি নয়; এটি হলো একজন সাধারণ ব্যাংক ক্যাশিয়ার, আলতাফ হোসেনের, অসাধারণ মানসিক বিভ্রম বা সত্য উপলব্ধির আখ্যান।
প্রায় ১৩ বছর আগে বইটির নাম দেখে প্রথমবারের মতো হুমায়ূন আহমেদের লেখা বই পড়ি। বইটি আমাকে বুঝতে শেখায় কেন হুমায়ূন আহমেদ সেরা। ছোটবেলা থেকে প্রেম ও গোয়েন্দা বই পড়ে অভ্যস্ত। বইটি পড়ার পর মনের মধ্যে শুধু একটা বিষয় ভাবাত—যদি সত্যি এমনটা হতো আমাদের সঙ্গে…!
উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র আলতাফ হোসেন কেবল তেলাপোকার ফিসফিসানি শোনেন না, তিনি তাদের সংঘবদ্ধ গোপন তৎপরতা বুঝতে পারেন। লেখক এখানে এমন একটি প্রাণীকে কেন্দ্রীয় প্রতীকে পরিণত করেছেন, যা সাধারণত ঘৃণা ও অবজ্ঞার পাত্র। এই পোকারাই হয়ে ওঠে পৃথিবীর যাবতীয় গোপন তথ্য, ভবিষ্যতের ইঙ্গিত এবং মানব অস্তিত্বের তুচ্ছতার ধারক।
‘পোকা’র সবচেয়ে অনন্য দিক হলো, পাঠককে বাস্তবতা ও বিভ্রমের সীমানায় দাঁড় করিয়ে দেওয়া। পাঠক নিশ্চিত হতে পারবে না যে—আলতাফ হোসেন কি সত্যিই পোকাদের বার্তা শুনছেন, নাকি তিনি পাগল? হুমায়ূন আহমেদের মুনশিয়ানা এখানেই যে তিনি আমাদের বিশ্বাস করতে বাধ্য করেন, এই নগণ্য পোকামাকড়ই হয়তো মহাবিশ্বের অব্যক্ত রহস্যের নিয়ন্তা। এ দ্বিধাই উপন্যাসটিকে একটি শক্তিশালী গল্পের মধ্যে নিয়ে যায়।
লেখক অত্যন্ত সহজ ভাষায় আলতাফ হোসেনের মতো ঘরজামাই এবং ব্যাংক কর্মচারীর জীবন এঁকেছেন। কিন্তু সেই সরলতার ভেতরের ভাঁজে লুকিয়ে আছে জটিল কাহিনি, পোকাদের দ্বারা আলতাফের জীবন নিয়ন্ত্রিত হওয়ায়, তাঁর ব্যক্তিত্বে একধরনের উদাসীনতা দেখা যায়। এই উদাসীনতা আসলে জীবনের অর্থহীনতার প্রতি লেখকের একটি সূক্ষ্ম ইঙ্গিত।
যেখানে অন্যান্য লেখক রহস্য উন্মোচন করতে চান, সেখানে হুমায়ূন আহমেদ রহস্যকে আরও নিবিড় করে তোলেন। তিনি কোনো চূড়ান্ত ব্যাখ্যা দেন না, বরং পাঠককে নিজেদের মনস্তত্ত্বের গভীরে ডুব দিতে উৎসাহিত করেন। এ কারণে উপন্যাসটি কেবল একবার পড়ার জন্য নয়, এটি সেই বিরল সাহিত্যকর্ম, যা পাঠ শেষেও দীর্ঘদিন ধরে পাঠককে ভাবায়। আপনি যতবার পড়বেন, ততবারই আপনার ব্যাখ্যা ও চিন্তাভাবনা পরিবর্তন হতে বাধ্য।
‘পোকা’ হুমায়ূন আহমেদের সেই সাহসী সাহিত্যিক প্রচেষ্টাগুলোর একটি, যা তাঁর ঘরানার বাইরে গিয়েও সমানভাবে সফল হয়েছে। এটি কেবল একটি বই নয়, একটি মেটাফোর—যা আমাদের শেখায়, জীবনের সবচেয়ে নগণ্য উপাদানটির মধ্যেও লুকিয়ে থাকতে পারে গভীরতম সত্য। যাঁরা সস্তা বিনোদনের ঊর্ধ্বে উঠে সাহিত্যের মনস্তাত্ত্বিক দিকটি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে চান, তাঁদের জন্য ‘পোকা’ এক অবশ্যপাঠ্য ভিন্ন স্বাদের সাহিত্য।
সভাপতি, নারায়ণগঞ্জ বন্ধুসভা