চিঠি
বাসুন বারোতে (ষষ্ঠ পর্ব)
চিঠিটি আমার একমাত্র ছেলেকে উদ্দেশ করে লেখা। এই চিঠি যখন লিখি, তখন তার বয়স ছিল ১১ বছর। বর্তমানে সে ২৪ বছরের তরুণ।
বাসুন,
নীরব হয়ে আসা দুপুর দেখেছিস কখনো?
বাংলাদেশে ঢাকা শহর থেকে বের হলে এমন জেলা শহরগুলো চোখে পড়ে। দুপুরবেলা খুব নীরব হয়ে থাকে এলাকাগুলো। ঠিক হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস ‘শঙ্খনীল কারাগার’-এর রাবেয়া যে স্কুল সুপারের চাকরি নিয়ে চলে গিয়েছিল, ছোট লাল দোতালা বিল্ডিংয়ে কেমন বুকের ভেতর হাহাকার করা; সেই দুপুর বা নিঃশব্দ রাত, রাবেয়ার যেমন মনে হয়েছিল জীবনের কাছে চাওয়া–পাওয়ার আর কিছু নেই; দুদিন হলো আমার তেমন একটা অনুভূতি হচ্ছে, জানিস বাবু।
তোর আর আমার নতুন এই ভাড়া বাসা। অচেনা শহর। কাউকে চিনি না, জানি না। কেমন নীরব চারপাশ। হুশহাস কিছু গাড়ির শব্দ। এ ছাড়া বাইরে তাকালে দূর অব্দি সাজানো বাড়িঘর চোখে পড়ে। মনে হয়, মানুষেরা যেন চিরশান্তির জীবন যাপন করছে এখানে। কোনো তাড়া নেই, কোনো চেঁচামেচি নেই। মনে হয়, সবাই বুঝি জীবনকে ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছে।
একটু আগে উঠে গিয়ে দেখি, তুই একমনে বই পড়ছিস। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকি আমি। কোনো দিন কি ভেবেছিলাম, নিজের দেশ ছেড়ে এই বিদেশকে ভালোবেসে ফেলব?
ব্যস্ত টরন্টো শহরকে বিদায় দিয়ে ব্রাম্পটনে এসেছি মোটে দুদিন হলো। টরন্টো শহরের আশপাশেই কিছু ছোট ছোট শহর আছে। এক-দেড় ঘণ্টার দূরত্বে এই শহরগুলো বসবাসের জন্য ভীষণ উপযোগী। জানতাম, এসব শহরে ভিড় কম বলে স্কুলও তুলনামূলক ভালো। কিন্তু সব জানার পরও কোনো উপায় ছিল না এত দিন। কারণ, আমার বেঁচে থাকা এই চাকরিকে কেন্দ্র করেই। টাকা না থাকা মানুষের বা গরিব মানুষের অপশন কম থাকে বাসুন। তাই আমি এত দিন এসব শহরে আসার কথা ভাবতে পারিনি। আজ আমার চাকরিই আমাকে এই লোকেশনে বদলি করে দিয়েছে বলেই না আমার আর তোর এখানে আসা হলো। জানিস বাবা, বিদেশে আমার মতো মধ্যবিত্ত বাঙালির সবচেয়ে বড় সৌভাগ্য হলো, স্থায়ী সম্মানজনক ভালো চাকরি। গত কয়েক বছর আমি তোকে নিয়ে এই সৌভাগ্যের দাবিদার।
তুই এই নতুন বাড়িতে ঢোকার পর থেকেই ভীষণ খুশি। বারবার বলছিস, ‘মা, আই লাইক দ্য হাউস, অ্যান্টিক হাউস মা। দেখো কেমন ওল্ড, কিন্তু অনেক অনেক সুন্দর মা, তাই না বলো?’
তোর–আমার দুটি আলাদা ঘর। ড্রয়িং, ডাইনিং, বসার ঘর, রান্নাঘর, বাইরে একফালি বারান্দা দিয়ে অনেকটা আকাশ আর সার সার সাজানো বাড়ি চোখে পড়ে। আমাদের বাড়ি যদিও মেইন রাস্তার ওপরই, কিন্তু আমরা বিল্ডিংয়ের পেছন সাইডে বলেই এমন অপরূপ প্রকৃতি দেখার সুযোগ মিলেছে। এই যে আজকে তোর প্রথম দিন স্কুল ছিল; তুই স্কুল চলে যাওয়ার পড় সারাটা বেলা আমার একার। বারবার মনে পড়ছিল, নিজের জীবনটার কথা বাসুন। আমি কি ছোটবেলা থেকে এমন জীবনেরই স্বপ্ন দেখেছিলাম সোনা?
যখন আমরা কেবল বড় হয়ে উঠছি, তখন বাবা কাজ করতেন সাভারের পিএটিসিতে। আমাদের চার বোনের জীবনেই শ্রেষ্ঠ সময় সেটা। আমরা বোনেরা তখন সবে বড় হচ্ছি; হাইস্কুল, কলেজ, কী অসাধারণ সেই দিনগুলো! ক্যাম্পাসের ভেতরেই বাবার অফিস, মাত্র এক ঘণ্টা দূরে ঢাকা শহর। আমাদের বাড়ির জানালা দিয়ে তাকালে আরিচা রোড দেখা যেত। দুপুরে সবাই যখন ভাতঘুম দিত, আমি জানালায় বসে থাকতাম। চেয়ে থাকতাম পথের দিকে, তাকিয়ে থাকতাম একমনে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতো; কিন্তু আমি তাকিয়েই থাকতাম, কী ভাবতাম আমি? আজকের দিনগুলো?
এই যে তুই একটু আগে স্কুল থেকে ফিরে নিজের ঘরে বই পড়ছিস, আমার নতুন ঘরের পড়ার টেবিলের সঙ্গে জানালা দিয়ে তাকালে আমি দূর দূর থেকে ফেলে আসা সময় দেখতে পাই। কত দূরে ফেলে এসেছি সেই ভালোবাসার দিন। আবার মনে হচ্ছে এই তো সেদিন, জাহাঙ্গীরনগরের লাল কৃষ্ণচূড়ার ঝাড় থেকে স্কুল–কলেজ শেষ করেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পথে হাঁটা সেই জীবন।
কতটা পথ বাবু?
মনে হয়, এই তো সেদিনের কথা। মেয়েদের হলে থাকার দিনগুলোতেও দুপুরে বাইরে তাকালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নীরব পুকুরঘাট চোখে পড়ত। এরপর নিজের সংসার গড়লাম, ভাঙলও সেটা। আবার মনকে শান্ত করে মাঠে মাঠে কাজ করলাম। টানা সাত বছরের এনজিওর চাকরিতে কত যে মাঠে মাঠে ঘুরেছি।
আহা, জীবনে সময় ফুরিয়ে যায় কেন?
বাংলাদেশের এনজিওর কাজ বাবু, দুই দিন পরপর ফিল্ড ভিজিট। সেটাও একটা টান বাবু, ভীষণ টান জানিস, বাজান। যারা আমার মতো মাঠে মাঠে না গেছে, তারা জানবে না কোনো দিন এই অনুভূতি। একবার এক বড় এনজিওর হর্তাকর্তা বলেছিলেন, ‘লুনা জানেন, কিছুদিন পরপরই ঢাকা শহরে আমার মন হাঁপিয়ে ওঠে। গ্রামে না এলে ভালো লাগে না।’ আমি তখন নতুন চাকরি করি। ওনার কথায় খুব অবাক হয়েছিলাম। এরপর আমি বাংলাদেশের এনজিওগুলোতে কাজ করেছি মোট ৯ বছর। আজও মনে পড়ে, কি ভীষণ সত্যি কথা বলেছেন ভদ্রলোক।
একটু আগে উঠে গিয়ে দেখি, তুই একমনে বই পড়ছিস। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকি আমি। কোনো দিন কি ভেবেছিলাম, নিজের দেশ ছেড়ে এই বিদেশকে ভালোবেসে ফেলব?
মাটি, আকাশ, ঘাসফুল বা ভালোবাসার কোনো জাত থাকে না বাবু। কোনো দ্বিধা নেই এ কথা বলতে যে দেশ থেকে কষ্ট পেয়েই বিদেশ এসেছিলাম। সেদিন ছিল ছেড়ে আসার তীব্রতা। সেদিন কি ভেবেছিলাম, পোড়া দেশ বা ভালোবাসার আবেগঘন দিনগুলো এমন করে পোড়াবে গোটা জীবন? একমুহূর্ত শান্তি পাব না, কেবল ছেড়ে আসার বেদনাই বহন করতে হবে এই জীবনে? জানতাম না বাবু, সত্যিই বলছি জানতাম না। কাছে থাকার চেয়ে ছেড়ে থাকার কষ্ট ঢের ঢের বেশি। ছেড়ে না এলে তা জানা যায় না কোনো দিন। আমার আর তোর নতুন শহরের জীবন যেন আনন্দে ভরে ওঠে বাবু, তোর সময়গুলো যেন তোকে নতুন প্রেরণা দেয়।
আর আমার কথা? গান দিয়ে বলি শোন।
আজ শান্ত দুপুরে শুনছিলাম রবীন্দ্রসংগীত। পঙ্কজ মল্লিকের গলায়, ‘সংসারে কোনো ভয় নাহি নাহি—/ ওরে ভয়চঞ্চল প্রাণ, জীবনে মরণে সবে/ রয়েছি তাঁহারি দ্বারে।/ অভয়শঙ্খ বাজে নিখিল অম্বরে সুগম্ভীর,/ দিশি দিশি দিবানিশি সুখে শোকে’।
আদর বাসুন
তোর মা,
২৬ মার্চ, ২০১২
ব্রাম্পটন, অন্টারিও, কানাডা