করোটির সব জায়গা দখল করে আছে একটামাত্র পুরোনো প্রশ্ন, কী চাই এই জীবনের কাছে?
বেলা যখন সাড়ে তিনটা বা চারটা হয়, তখন বাসার বারান্দায় রোদ আসতে শুরু করে। গত বছর যখন এই ভাড়া বাসায় উঠে আসি, তখন অ্যাপার্টমেন্টের ম্যানেজার রোজা বলেছিল, ‘তোমার বাসাটা উত্তরমুখী। বাসায় বেশ আলো–বাতাস পাবে।’
কিন্তু আসলে আরও রোদ দরকার, তীব্র রোদ। বারান্দায় চারা লাগিয়েছি। করলার চারা, তিন রকম মরিচের চারা, বেগুন, পুঁইশাক, টমেটো। কিছুক্ষণ আগে করলাগাছের সবুজ হালকা ডালগুলো ধরে বাঁশের কঞ্চির সঙ্গে বাঁধ দিয়ে দিলাম, তরতর করে বেড়ে ওঠা চারটে গাছের ডগাগুলোর একটা বাঁধন দরকার, যাকে ভর করে বেড়ে উঠবে ঝকঝকে করলাগাছ।
বাঁধগুলো দেওয়ার সময় গতকাল রাতের কথা মনে পড়ল। কী হলো সেই মহিলার? মাঝরাতে যার ফোন ধরেছিলাম। সেই মহিলার কি ভ্যাকিউম করার পরই বাচ্চা হয়েছিল, নাকি শেষ অব্দি অপারেশন করতে হয়েছিল? সেই খবর তো জানলাম না আমি।
রাত তখন পৌনে চারটা হবে, এ সময় একবার ঘুম ভেঙে যায়, ফোনটা ভাইব্রেশনে দিয়ে রাখি। নাহ, ফোনে কেউ এমন বিরক্ত করে না যে আমার ঘুম নষ্ট হবে, বরং মাঝরাতে দরকারি ফোন আসতে পারে, এই আশায় ফোন পুরো সাইলেন্ট করি না। ফোন লাইনের যে দোভাষীর অফিসে কাজ করছি ২০১১ সাল থেকে, সেটা কানাডার ম্যানিটোবায় অবস্থিত।
টরন্টোর সঙ্গে দুই ঘণ্টা সময়ের ব্যাবধান। অন্যদিকে, এই ফোন সার্ভিস অফিস ২৪ ঘণ্টার জন্য খোলা থাকে। আমেরিকা-কানাডার অনেক কল রিসিভ করতে হয় আমাদের মতো দোভাষীদের, যারা ফোনে কাজ করার জন্য বেতন পাই।
প্রতি মিনিটের পারিশ্রমিক দেয় এই অফিস। যদিও খুব বেশি দেয় না, কিন্তু এটাও একটা কাজ বা চাকরি। যেহেতু সোমবার থেকে শুক্রবার সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা অব্দি কস্টির জব করি, তাই ফোন দোভাষীর অফিস ‘ক্যানটক কানাডা’ অফিসের পর আমাকে লগ-ইন রাখে।
বিভিন্ন প্রদেশের সময়ের পার্থক্যের কারণেই কোনো কোনো সময় মাঝরাতে ফোন পাই। হয়তো মাসে একটা বা দুইটা। কিন্তু যখনই মাঝরাতে ফোন আসে, তখন ঘুম ছেড়ে কথা বলি। আমার মন বলে, পৃথিবীর কোনো প্রান্তে কি আমার দেশের কোনো মানুষ ভ য়াবহ বিপদে পড়েছে? সেই বিপদের চেয়ে কি ঘুম জরুরি?
গতকাল রাতে একবার ফোন মিস করে খারাপ লাগছিল ভীষণ। ভাবলাম, ইশ... ধরতে পারলাম না। দুই মিনিট পরই আবার ফোন। কথা বলা শুরু করে বুঝতে পারলাম, এক মহিলা অপারেশন টেবিলে। বাচ্চা হবে, দুই ঘণ্টা হলো পুশ করছে, কিন্তু বাচ্চার মাথা ভ্যাজাইনার জোনে আসছে না।
চিকিৎসকের ইংরেজি বুঝতে পারছে না ওই মহিলা। তাই দোভাষীর লাইনে আমাকে রাখা হয়েছে। মহিলাকে বলা হলো, তার কাছে তিনটা উপায় আছে। এক. আরও কিছুক্ষণ পুশ করে হবে; দুই. তাকে ভ্যাকিউম করে বাচ্চার মাথা জোনের দিকে আনতে হবে, সেখানে কী কী ঝুঁকি আছে সেটা বলা হলো; তিন. সি-সেকশন বা অপারেশন, যা চিকিৎসক করতে চান না। সেখানেও কী কী ঝুঁকি আছে, সেগুলো বলা হলো।
৩২ মিনিটের কথায় শেষের দিকে বুঝলাম, মহিলার স্বামী পাশেই আছে। তবু মহিলাকে সব বিস্তারিত জানতে ও বুঝতে হবে। এটাই কানাডার নিয়ম। আমাকে বলা হলো লাইনে থাকতে, যদি অপারেশন করতে হয়, তাহলে তাকে ফোনে সম্মতিপত্রে স্বাক্ষর করতে হবে। ফোন স্পিকারে রেখে আবার বালিশে মাথা গুঁজে দিলাম। দেড় ঘণ্টা পর ঘুম থেকে জেগে দেখি ফোন লাইন বন্ধ।
গতকাল ছিল রবিবার। সারা দিন একটা লম্বা সিকিউরিটির শিফট করেছি। ১২ ঘণ্টার শিফট। কোনো কাজ নেই সেই অর্থে। সাধারণত এ দেশের মানুষ রোববারে বাসা থেকে বের হয় না। সিকিউরিটির জব ৮০ ভাগ সময় বসে থাকা। তব দায়িত্বে বসে থাকার একটা চাপ আছে। তাই আজ সোমবার কস্টি অফিসে ফোন করে সিক লিভ নিয়েছি।
এই যে এই মুহূর্তে বকবক করছি, কারণ, ইদানীং লিখতে পারছি না। কিছুতেই না। গত পরশু আরও এক মহিলা নাড়িয়ে দিয়েছে সব হিসাব–নিকাশ।
সেই লরার কথাও বলে রাখি এই ফাঁকে। শনিবার করলাম পাঁচ ঘণ্টার একটা শিফট, সেখানেই পরিচয় লরার সঙ্গে। আগামীকাল যার বয়স হবে ৫৫ বছর। সেই প্রাণবন্ত, ফুল অব লাইফ বলতে যা বোঝায়, লরা তা–ই।
আমি অবাক হয়ে ভাবছিলাম, এমন জীবন্ত প্রাণ যার, সে কেন সিকিউরিটির মতো একঘেয়ে কাজ করতে আসবে? মাত্র ৩০ মিনিটের আলোচনায় বেরিয়ে আসে উত্তর।
লরা ২২ বছর নার্স ছিল। কাজ করত পাইলেটিভ কেয়ার ইউনিটে। মানে যে ইউনিট থেকে রোগী আর ঘরে ফেরে না। রোগী মারা যাওয়ার আগের কয়েক বছর যেখানে থাকে, তার নাম পাইলেটিভ কেয়ার ইউনিট।
কানাডায় যেকোনো নার্সের বেতন শুরু হয় ঘণ্টায় ২৫ থেকে ৩০ ডলার দিয়ে। অন্যদিকে সিকিউরিটির কাজে লরা পায় ন্যূনতম বেতন। জীবনের হিসাব কী দিয়ে মেলে, জানি আমরা কেউ?
লরা ২২ বছর ধরে মৃত্যু দেখতে দেখতে হাঁপিয়ে উঠেছে। বলে, ‘না, লুনা, আর না। আমি আর মৃত্যু দেখব না। তাই ক্যারিয়ার বদলে এই কাজ নিয়েছি। এই কাজে আমি স্বাভাবিক মানুষ দেখি। আমি ডলারের দিকে তাকাইনি। আমি বাঁচার দিকে তাকিয়ে এখানে এসেছি।’ বলেই লরা হাসতে থাকে।
পাঠককে বলে রাখি, কানাডায় যেকোনো নার্সের বেতন শুরু হয় ঘণ্টায় ২৫ থেকে ৩০ ডলার দিয়ে। অন্যদিকে সিকিউরিটির কাজে লরা পায় ন্যূনতম বেতন। জীবনের হিসাব কী দিয়ে মেলে, জানি আমরা কেউ?
মাথার ভেতর সারাক্ষণ বিচিত্র/অদ্ভুত সব বিষয় খেলা করছে। সারাক্ষণ ভাবনা ঘিরে থাকছে। মানুষের মনের চেয়ে বিচিত্র আর কোনো বিষয় এই বিশ্বে নেই। সেই সব মানুষের মুখ আর জীবন দেখি সারাক্ষণ, তবু লিখতে পারছি না ইদানীং।
সারাক্ষণ ঘিরে আছে হাজারো ঘটনা। গত ১৪ বছরের কানাডার জীবনে এই গত ১১ মাস আমি সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত সময় পার করছি, সবচেয়ে বেশি মানুষের মুখ দেখছি। জীবনের এক অদ্ভুত জটিল সময় এটা। শয়ে শয়ে উদ্বাস্তু আসছে শেল্টার সার্ভিস অফিসে। প্রতিটি পরিবারের গল্প, অনুভূতি, সংগ্রাম, চাওয়া-পাওয়া আলাদা। সবাই একটা একটা করে বিশাল বিশাল উপন্যাসের পাঠ হতে পারে। কিন্তু মাথা শূন্য লাগে ইদানীং। বোবার মতো, অসহায়ের মতো তাকিয়ে তাকিয়ে সময় পার করছি। একদম নিজের ভেতরের কিছু হিসাব গুলিয়ে গেছে, মেলাতে পারছি না কিছুতেই।
অনেক অনেক বছর পর, নতুন করে সেই পুরোনো প্রশ্ন বুকের ভেতর পাথর হয়ে বসে আছে। করোটির সব জায়গা দখল করে আছে একটামাত্র পুরোনো প্রশ্ন, কী চাই এই জীবনের কাছে?
করলাগাছের ডগার বাঁধগুলো দিতে দিতে ভাবছিলাম এসব। তেমনি একটা বাঁধন খুঁজি কি আমরা আজন্ম? বা কেঁদে ফেরার জন্য একটা শক্ত কাঁধ, বাঁশের কঞ্চির মতো একটা মাচা, যা যাপিত জীবনকে বেড়ে উঠতে সাহায্য করবে?
কিন্তু শেষ অব্দি হারিয়ে ফেলি নিজের বাঁধন বা নিজেকেই?
২৮ মে ২০১৮
টরন্টো, কানাডা