মেহেরজাদী নামে যে মেয়েটি আমার কোনাকুনি টেবিলে বসে আছে, ওর গোড়ালির ঠিক ওপরে যেখানে জুতার সীমাটা শেষ হয়েছে এবং একটা টাইট জিন্সের প্যান্ট সামান্য ফোল্ড করে পরলে গোড়ালির ওপরের যে দুই ইঞ্চি দেখা যায়, সেখানে ট্যাটু করে একটা শব্দ লেখা আছে।
আমি আর মেহেরজাদী মাত্র দেড় সপ্তাহ হলো এক রুমে বসা শুরু করেছি। মূলত আমরা দুজন টিম। আমি জেনারেল কাউন্সিলর, ও হাউজিং কাউন্সিলর।
একজন নতুন রিফিউজি শেল্টারে ঢুকেই প্রথমে আমার কাছে আসবে; তিন-চার দিন পরে একটু সেটেল হলে ওকে তাড়া দিতে থাকব বাসা খোঁজার জন্য; তখন মেহেরজাদী ওকে সাহায্য করবে। এই হচ্ছে আমাদের দুজনের কাজ।
বিকেলে ফেরার পথে ভাবছিলাম, একদিন এই শহরে একা পথচলা শুরু করেছিলাম। চাই না চাই, সেদিন অনেক অনেক মানুষ অবশ্যই আমাকে সাহস দিয়েছে, ভালোবাসা দিয়েছে; না হলে এত পথ হাঁটলাম কী করে?
আজ যে নতুন রিফিউজি ঢুকেছে আমাদের শেল্টারে, তাঁকে বের করতে না পারলে অন্য রিফিউজিদের জায়গা হবে কী করে? যদিও যতই তাড়া দিই, তিন মাসের আগে কেউ বাসা বের করতে পারে না, কেউ না। খুব কম করে হলেও ছয় মাস লাগে এই শহরে নতুন বাসা পেতে।
আমার পরেই সব নতুন রিফিউজি যাবে মেহেরজাদীর কাছে। হাউজিং কাউন্সিলর ওদের বাসার ব্যাপারে সব ধরনের সহযোগিতা করবে, এমনকি ফ্রি ফার্নিচার পর্যন্ত নিশ্চিত করবে। এভাবেই সাজানো প্রোগ্রাম। শুরুতে আমি আর মেহেরজাদী সামনাসামনি দুই রুমে বসতাম।
কষ্টির এই শেল্টার সার্ভিসে জয়েন করার পর থেকেই মেয়েটা নজর কেড়েছে। একহারা গড়নের মেয়ে, বয়স অবশ্যই চল্লিশের কাছে হবে। ভীষণ মেদহীন শরীর।
প্রথম দিনের আলাপেই জানতে পারি, ও জন্মগত কানাডিয়ান, মা ইরাকি, বাবা ফরাসি। তাই মেহেরজাদী তিনটা ভাষা অনর্গল বলতে পারে—ইংরেজি, ফরাসি ও দারি। এর ওপরে আছে স্বভাবগতভাবে বিশেষ কিছু গুণ। যেমন মেহের মহাত্মা গান্ধীর অহিংস ধর্মে বিশ্বাসী। তাই ও নিরামিষভোজী। গান্ধীর আদর্শ নাকি ও লালন করে মনের গহিনে। আল্লাহ বিশ্বাস করে না; তবে সত্য ও সততা বিশ্বাস করে। গান্ধী যেমন বলেন, ‘সত্য হচ্ছে গড’। মানুষের ক্ষতি হবে, এমন কাজ থেকে নিজেকে দূরে রাখে ও। পায়ের গোড়ালির ওই ফাঁকা জায়গাটুকুতে লেখা আছে ‘অহিংসা’।
সেদিন জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার ট্যাটুতে কী লেখা? এটা তো ইংরেজি ভাষা না, তাহলে কী ভাষা?’ মেহের এমনভাবে ‘অহিংসা’ শব্দটা উচ্চারণ করল যে আমাকে দুবার শুনতে হলো। তারপর ও যখন জানল, আমি গান্ধীর কথা জানি, এমনকি গান্ধীকে নিয়ে একটা ডকুমেন্টারির লিংক ওকে বলে দিতে পারলাম, তখন মেহের ভীষণ উজ্জ্বল হয়ে হাসল।
কী ভীষণ আকর্ষণীয় দেখতে মেয়েটা! ওর একটা ছবি পোস্ট করতে পারলে পাঠক জানতে পারত সেই সত্য; কিন্তু মেহের সোশ্যাল মিডিয়া থেকে নিজেকে দূরে রাখে। প্রচুর বই পড়ে। ওর পোষাপ্রাণী আছে, আর আছে অনেক গাছ। আজ জানলাম কষ্টির ১১ মাসের কাজের অভিজ্ঞতা দিয়ে ও সরকারি চাকরি জুটিয়ে ফেলেছে। এই সপ্তাহ ও আমাদের সঙ্গে শেষ সময় কাটাবে। একটা স্মার্ট মুভ করল মেহের আমাদের সামনেই।
শেল্টার সার্ভিসের এই অফিসে জয়েন করার পর থেকে সময় যেন হাওয়ার আগে ভেসে যাচ্ছে। কত কত মানুষ এবং কত বিচিত্র সবাই। আমি ছাড়া কষ্টির এই প্রোগ্রামে যাঁরা কাজ করছে, সবাই ভীষণ নতুন। এখানে জবের দিক থেকে আমি সবার সিনিয়র, এমনকি ম্যানেজারও জবের দিক থেকে আমার চেয়ে পাঁচ বছরের জুনিয়র। তাই নিজেকে ভীষণ লাকি মনে হয়, যখন একদল তরুণপ্রাণের সঙ্গে কাজ করতে পারি। একটি তরুণপ্রাণের কাছে থেকে যা শেখা যায়, একজন স্টাফ যে শুধু রুটিন জব করেন, তাঁর কাছে সেটি কিছুতেই শেখা বা জানা যাবে না। সারা দিন একটি উৎসবের আমেজের ভেতর দিয়ে সময় পার হয়ে যায়।
এ ছাড়া আছে প্রতিদিন নতুনদের চমক। কানাডায় নতুন আসা প্রতিটি পরিবার একটি করে পৃথিবী। প্রতিটি মেয়ে একটি দেশ/সংস্কৃতি আর বৃহত্তর সমাজের প্রতিনিধি। নাইজেরিয়া থেকে গত পরশু এসেছে গডউইন চ্যারিটি। ওর তিন বাচ্চা নিয়ে আমেরিকার মেরিল্যান্ডে ছিল তিন সপ্তাহ। ওখানে সুবিধা হবে না দেখে কানাডার মন্ট্রিয়ল বর্ডার দিয়ে কুইবেকে প্রবেশ করেছে।
বললাম, ‘এক দিনেই তোমার এত বদল? উইন হেসে দিয়ে বলে, ‘তুমি সাহস দিয়েছ, তোমার কথায় ভীষণ ভরসা পেলাম।’
২৭ বছরের মেয়ে উইন একজন বাই-সেক্সচুয়াল। ওর স্বামীর কাছে প্রথম যেদিন এটা ধরা পড়ে, সেদিনই উইনের জীবন অনিরাপদ হয়ে যায়। নাইজেরিয়ার অজপাড়াগাঁয়ে উইনের শ্বশুরবাড়ির মানুষ কিছুতেই এটা মেনে নেবে না। এমনকি ওর স্বামীও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তাই পৃথিবীর একমাত্র দেশ কানাডায় উইন নিরাপদ। এখানে রিফিউজি ক্লেম করে এক দিনেই ও লিগ্যাল পেপারস পেয়ে গেছে। বাচ্চাদের নিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ দেশে উইনের পথচলা শুরু হলো।
প্রথম দিনের সাক্ষাতে উইন বারবার আনমনা হয়ে যাচ্ছিল। তিন মাসের বাচ্চাকে দুধ খাওয়াচ্ছে। গত দেড় মাসে এক শেল্টার থেকে অন্য শেল্টারে দৌড়াদৌড়ি, অনিরাপদ পথচলায় উইন খেই হারাচ্ছিল বারবার। যখন বললাম, ‘দেখো, আমি ১৪ বছর আগে চার বছরের বাচ্চা নিয়ে এদেশে এসেছিলাম। আমি কিন্তু তোমার মতো ফ্রি থাকা-খাওয়ার সুবিধা পাইনি। মাহমুদা নামের কোনো কাউন্সিলর সেদিন আমার মাথায় হাত দিয়ে বলেনি, আমি পাশে আছি। আজ কিন্তু আমি তোমাকে বলছি, অন্তত আগামী তিন মাস আমি তোমার সঙ্গে আছি, তুমি কেন এত ভয় পাচ্ছ উইন?’
গতকালের সেই মেয়ে আজ সকালে দেখা করতে এসেছিল; একটা সম্পূর্ণ বদলে যাওয়া মেয়ে হয়ে। কি হাসিখুশি সাবলীল। বললাম, ‘এক দিনেই তোমার এত বদল? উইন হেসে দিয়ে বলে, ‘তুমি সাহস দিয়েছ, তোমার কথায় ভীষণ ভরসা পেলাম।’
বিকেলে ফেরার পথে ভাবছিলাম, একদিন এই শহরে একা পথচলা শুরু করেছিলাম। চাই না চাই, সেদিন অনেক অনেক মানুষ অবশ্যই আমাকে সাহস দিয়েছে, ভালোবাসা দিয়েছে; না হলে এত পথ হাঁটলাম কী করে?
আজ সেগুলো ফিরিয়ে দিতে হবে। ভালোবাসা যত ফিরিয়ে দেব, তত ফিরে ফিরে পাব।
১৮ এপ্রিল ২০১৮
টরন্টো, কানাডা