চিঠি
বাসুন বারোতে (পর্ব বারো)
চিঠিটি আমার একমাত্র ছেলেকে উদ্দেশ করে লেখা। এই চিঠি যখন লিখি, তখন তার বয়স ছিল ১২ বছর। এখন সে ২৫ বছরের তরুণ।
টরির সঙ্গে আলাপ করতে করতে মাথা ঘুরছিল। এ দেশের একজন সাদা মানুষ কী করে আমাদের দেশের সামাজিক ব্যবস্থাটা একদম পরিষ্কার করে ধরে ফেলল?
বাসুন,
অফিস থেকে বাড়ি ফিরছি, বিকেল পাঁচটার মতো হবে। চারদিকে রোদ আর রোদ। এই আলো থাকবে রাত ১০টা পর্যন্ত। ছোট চারতলা অ্যাপার্টমেন্ট, মাঝখানে বড় রাস্তা; এপারে আমাদের বাসা আর ওই পারে অফিস। যেতে-আসতে পুরো এক মিনিটও লাগে না।
বাড়ির সামনেই কুকুর নিয়ে হাঁটছে টরি। কত বয়স হবে টরির? আন্দাজে যদি বলি তাহলে হয়তো ৫২। খুব আনন্দে কুকুরের সঙ্গে হাঁটছে আর কথা বলছে। এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘তোমার সঙ্গী কই, বিয়ে করোনি তুমি?’ (এমন প্রশ্ন এসব দেশে হুট করে করা যায় না। ওর সঙ্গে কিছুদিন আগেই পরিচয় হয়েছিল লন্ড্রি রুমে)। হেসে দিয়ে বলে, ‘শোনো বলি, খারাপ সম্পর্ক বহন করার চেয়ে একা থাকা ঢের ঢের ভালো। তোমরা সাউথ এশিয়ান মানুষেরা এখনো একটি ট্রানজিশনাল সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছ। তাই তোমরা ভাবো, বিয়েতেই সব আনন্দ। আসলে কি তাই? অনেক এশিয়ান সিঙ্গেল ছেলেমেয়ের সঙ্গে পরিচয় আছে; কই ওরা তো সব চেষ্টা করেও বিয়ে টেকাতে পারেনি। তুমি কি ওদের দোষ দিতে চাও? আমি এশিয়ান সোসাইটি নিয়ে স্টাডি করেছি। জানি ধর্মীয় মূল্যবোধ রাখতে গিয়েই তোমরা একসঙ্গে থাকো। সেখানে স্বাস্থ্যকর সম্পর্ক কোনো ইস্যু নয়। ওহ ইয়েস, তোমাদের দেশের দারিদ্র্যও মেয়েদের স্বাধীনতা নিয়ে ভাবতে শেখায় না। আর অনেক ছেলে সেটিকে অ্যাবিউস করে, তাই না? আমি কি ঠিক বলছি?’
বাসুন, রাত আটটা বাজে, আমি বাসায় ফিরেছি সন্ধ্যা ছয়টায়। টরির সঙ্গে আলাপ করতে করতে মাথা ঘুরছিল। এ দেশের একজন সাদা মানুষ কী করে আমাদের দেশের সামাজিক ব্যবস্থাটা একদম পরিষ্কার করে ধরে ফেলল? কেবল পড়াশোনা করে বা কিছু বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে মিশে এতটা ধারণা করা কি সম্ভব?
কিন্তু শেষ পর্যন্ত হেরে গেলাম টরির কাছে। শেষমেশ না পেরে ওকে বললাম, ‘ঠিক আছে মানলাম তোমার কথা। এখন বলো, তুমি যে এই গ্রীষ্মের বিকেলে একা কুকুর নিয়ে ঘুরছ, তোমার একা লাগছে না?’ টরি এবার পাল্টা প্রশ্ন করে, ‘ওহ কারেক্ট, তোমার ছেলেটা কোথায়? হি ইজ ভেরি নাইস অ্যান্ড লাভলি।’ এবার আমার চোখের কোনা ভিজে ওঠে, সামলাতে পারি না নিজেকে। টরিকে বলি, তুই ডালাসে আছিস।
টরি এবার একটু সিরিয়াস হয় যেন। ‘দেখো, আমি যত দূর বুঝি, তুমি তো কষ্ট পেয়েই একা হয়েছ। হয়তো কথাটা তুমি এবং তোমার যে পার্টনার ছিল, দুজনের জন্যই সত্য। কিন্তু তোমার জন্য যতটা সত্য এবং কঠিন; বাংলাদেশের মতো ধর্মভিত্তিক দেশে ছেলে হিসেবে ওর জন্য অতটা কঠিন নয়, তাই না?’
‘বাংলাদেশ যে ধর্মভিত্তিক দেশ, সেটিও তুমি জানো?’
‘তুমি কেন বুঝতে পারছ না, আমি হায়ার স্টাডি পড়েছি এশিয়ান কালচারের ওপরে। নইলে তোমার সঙ্গে এত জোর দিয়ে কথা বলছি কী করে, বলো?’
আবার আমাকে প্রশ্ন করে টরি, ‘তুমি বলো তো তোমাদের এই সম্পর্কের ভেতর বড় হলে তোমার ছেলে কি ভালো থাকত? তুমি কি জানো, সাউথ এশিয়ান বাচ্চারা এই নর্থ আমেরিকাতে যত উন্নতি করে, তোমাদের নিজেদের দেশে সেটা করে না। কারণ, তোমাদের দেশে ছেলেমেয়েরা পরিবার থেকে অনেক ভুল কিছু শেখে; যা সে বাকি জীবন বয়ে বেড়ায়।’
টরি বলতে থাকে, ‘জানো, তোমার ছেলের সঙ্গে অনেক কথা হয়েছে আমার। ওর বাবার ব্যাপারে তুমি ওকে যে স্পষ্ট পিকচার দিয়েছ, তুমি কি মনে করো তোমার সংসারজীবনটা তুমি বহন করলে বাচ্চাকে এভাবে বড় করতে পারতে?’
এবার টরিকে আর কথা বলতে না দিয়ে বলি, ‘শোনো টরি, সব মানলাম। এই যে তুমি একা হয়ে কুকুর নিয়ে হাঁটছ, আমি একা অফিস থেকে বাড়ি ফিরতে কষ্ট পাচ্ছি, তার কী হবে বলো?’ টরি আবার বলে, ‘সেটি কিন্তু মানসিক কষ্টের চেয়ে কম কষ্ট, জানো তুমি?’
‘আমি বা পশ্চিমা দেশগুলো কি এক দিনে এই সমাধানে এসেছি, ভাবো?’
‘মানুষ বাদ দিয়ে পশুকে ভালোবাসতে আমাদের কয়েক শ বছর সময় লেগেছে। আজকে তোমার কাছে আমাদের দেখতে যেমন অদ্ভুত লাগে, তেমনই তোমাদের দেশের নির্যাতনের খবর আমাদের কাছে একই রকম লাগে। যাও এবার বাড়ি গিয়ে মুভি দেখো, বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলো। নিজে ভেবে বের করো কী করলে ভালোভাবে সময় কাটানো যায়।’
টরি আমাকে পেছনে ফেলে হাঁটা শুরু করে।
বাসুন, আমি ভাবি তোর কথা। টরির সঙ্গে আজকের আলাপের কথা।
শূন্য ঘর সোনা বাচ্চা। গত বৃহস্পতিবারে তুই চলে গেলি আমেরিকার ডালাসে। ওখানে তোর সেজ খালা আর বাচ্চাদের সঙ্গে দারুণ সময় কাটছে। আজকে সাত দিন হতে চলল তুই বাসায় নেই। সময় কাটে না বাজান। তুই না থাকলে কাকে নিয়ে বাঁচতাম আমি?
তোর শিশুমুখ মনে পড়ে। সারা বাড়িতে যেন তুই আছিস সোনা। আর মাত্র এক মাস, মাঝরাতে ঘুম ভেঙে মনে পড়ে তোকে বাজান।
শূন্যতা ভয়াবহ লাগে। কিন্তু প্রতিনিয়ত কষ্টের চেয়ে এটা ভালো। তুই আছিস এই জীবনের সঙ্গে। এই ভেবে বেঁচে থাকতে ইচ্ছা করে বাসুন। প্রবল ইচ্ছা করে জীবনকে ভালোবাসতে বারবার, বহুবার। তোকে ভালোবাসায় ভরিয়ে দিতে মন চায়। ভালো থাক সোনাবাবু।
আদর বাসুন
তোর মা
৫ জুলাই ২০১২
ব্রাম্পটন, অন্টারিও, কানাডা