প্রেম ও প্রতিহিংসার ‘নীল সুখ’

‘নীল সুখ’–এ রেহান ও মেহজাবীনছবি: নির্মাতার সৌজন্যে

‘নীল সুখ’ নামের মধ্যে ব্যঞ্জনা আছে। নীলকণ্ঠ পৃথিবীর বিষ ধারণ করে সুখী হয়। মানুষ নীলকণ্ঠ নয়, নিজের ভেতরে ভাঙতে ভাঙতে কিছু শক্ত মনের মানুষ ভাঙনের খেলায় না মেতে সৃষ্টিশীল হয়ে উঠতে পারেন। আজীবন নিজের ভেতরে বিষের ব্যথা বহন করতে করতে কিছু মানুষ ক্রিয়ার বিপরীতে এমনই প্রতিক্রিয়া ঘটিয়ে বসেন, যা অনভিপ্রেতই নয়, এই নিয়মতান্ত্রিক পৃথিবীর জন্য বিপদজ্জনকও হয়ে ওঠে। আপন অন্তরে ধুঁকে ধুঁকে মরা মানুষ হয়তো হঠাৎ এই বিপজ্জনক খেলায় আপন মুক্তি, আপন শান্তি, আপন সুখ খুঁজে পায়। এমনই মানসিক বৈকল্যের সামাজিক একটি চরম অসুখের ওয়েবফিল্ম ভিকি জাহেদের ‘নীল সুখ’।

এমন সুন্দর একটি পারিবারিক সম্পর্কের, নরম আদরের নিটোল প্রেমের ছবির এমন পরিণতি হতে পারে, ভাবলেই হাড় হিম হয়ে আসে। ব্যতিক্রমী পরিচালক ভিকি জাহেদ অনবদ্য গল্পের সুন্দর চিত্রায়ণে ফুলের সৌন্দর্যকে শুধু পরিস্ফুটিত করেননি, সংবেদনশীল অনুভূতিতে কাঁটার ব্যথা, ফুলের সংসারে সিঁধ কাটা পোকার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াকেও তুলে এনেছেন।

আরও পড়ুন

আবহে আবহমান কালের নরম রাবীন্দ্রিক অনুভূতির সুর ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে..’, আর বহিরাবরণে মানুষের চরম বিষাদ–বেদনা। জীবন তো শুধু ছবি নয় যে পটে লেখা। এই পটের ভেতরে অফুরান প্রেক্ষাপট অনন্ত শূন্যতা। চাক্ষুষ সৌন্দর্যকেও কখনো কখনো প্রশ্নবিদ্ধ করে, তুমি কি সত্যিই সুন্দর, এমন নির্বিকার? আবার প্রাণ খুলে হাসা মানুষও চরম শোকে চোখে জল নিয়ে বাঁচে, এই জলের নামও সত্য। শোকে পাথর হয় তবু পারস্পরিক হিংসা, বিদ্বেষে আচ্ছন্ন হয় না। সব পথ বন্ধ হয়ে গেলেও পথের শেষে পথের অপেক্ষায় থাকে, এই অনন্ত পথের পথিকের নামও সুন্দর।

গল্পের সামান্য গরমিল আছে। অর্পা যদি জানতই যে পরিবারে সে যাকে খুব ভালোবাসে, সেই খালামণি রোখসানা বেগমও আপন জীবনের অপ্রাপ্তি, বিষাদের হতাশায় অর্পার জীবনের প্রেমকেও ধ্বংস করে দিতে চাইছে। সেই কারণেই ওঠানামার ভাঙা সিঁড়িতে পিচ্ছিল কিছু ছড়িয়ে দিয়েছে। তবে সে সাবধানে ওঠানামা করেনি কেন? পা ভেঙে যাওয়ার পরেই বোধোদয় হয়েছে?

‘নীল সুখ’–এ মেহজাবীন। ফেসবুক থেকে

শৈশবে জন্মলগ্ন থেকে যার সঙ্গে বাসরলিখন লেখা হয়ে গেল, বিয়ে বিয়ে হৃদয়বরণ সাঙ্গ হয়েছে, আজীবনের প্রেমিক সেই মারুফ যদি পঙ্গু মেয়েকে বিয়ে করতে না চায়, তবে তো সে প্রেমিকই নয়। অথচ সহজ–সরল জীবনের আবরণে, প্রেমের বুননে কোথাও বোঝার উপায় ছিল না যে সে প্রেমিক নয়, প্রেমিক-অভিনেতা। স্বার্থের কারণে কাছের মানুষ দূরে সরে যায়—বাস্তব সত্য। একজন গন্ধবিশারদ জীবনকে ভিন্ন পথে যাপন করতে চাওয়া বিকল্প পথের পথিক, পারিবারিক কারণে হঠাৎ পাল্টে গেলে দুনিয়াটা সত্যিই পাল্টে যায়। অর্পার জীবনে চেনা ফুলের গন্ধও এভাবে পাল্টে গিয়েছে।

সংলাপ সুন্দর, টুকরা টুকরা মুহূর্তের বুনন চিত্রায়ণ অসম্ভব সুন্দর। পরিচালকের হাতে যশ আছে, বড় বড় পরিচালকের কাছে শিক্ষা নেওয়ার অধ্যবসায় আছে। চলচ্চিত্রে সম্পর্কের রসায়নের ক্রিয়া-বিক্রিয়ায় সিদ্ধহস্ত বোঝা যায়। মেহজাবীন চৌধুরী অনন্য। একাই প্রায় গল্পকে ধরে রাখেন। এই গল্পের মনস্তাত্ত্বিক এত মুহূর্ত, এত ভাঙাচোড়া প্রতিটি ক্ষণে সুন্দর সাবলীল অভিনয় করে যাওয়া সহজ কাজ নয়। সংলাপহীন মেহজাবীনের চোখমুখের ভাষাও বাগ্ময়। ফারুক আহমেদ রেহানও মারুফ চরিত্রে মেহজাবীনের পাশে সেই শিল্পীসত্তা মেলে ধরতে পেরেছেন। খালামণি চরিত্রে গোলাম ফরিদা চন্দকে খুবই ভালো লেগেছে। অভিনয় যে নিয়মিত চর্চার বিষয়, এ ধরনের প্রজ্ঞাবান শিল্পীর অনুশীলিত সাবলীল সত্তা দেখেই বোঝা যায়। মেধার দীপ্তিতে তিনি সুন্দরী।

একটা বড় ক্যানভাসের আশপাশে স্পেস থাকে। সেই ফাঁকা জায়গাতেও শিল্পীমনের অনেক আঁকিবুঁকি থাকে, যা মূল ছবিকে সমৃদ্ধ করে। ঠিক তেমনি মূল গল্পের ধারার পাশে এই ওয়েবফিল্মেও কিছু মন ছুঁয়ে যাওয়া দৃশ্য এসেছে। মারুফের বোন ইলাকে নিয়ে সকাল, দুপুর, অর্পা, মারুফ পাঁচজনের গ্যাং ছিল। চায়নিজদের মতো দেখতে বলে ইলাকে নিয়ে সবার ছড়া কাটা—‘ইলা হোলো চায়না, ব্যাঙ ছাড়া খায় না...’ আমাদেরও একরাশ ছোটবেলায় ফিরিয়ে দেয়। কৈশোরে অর্পা হারিয়ে গেলে মারুফ কাঁদে। মারুফের চোখে জল দেখে ফিরে আসা অর্পা প্রতিজ্ঞা করে, ‘ও আমার জন্য দুফোঁটা চোখের জল ফেলেছে, প্রতিদানে আমি ওর জন্য সারা জীবন কাঁদব!’

পরবর্তী সময়ে আমরা দেখেছি, চোখের জলে ভেসে গিয়েছে ওদের প্রেম ও প্রতিজ্ঞা। সাত বছর আগে জন্মদিনে দেওয়া অর্কিডগাছ, সাত বছর পর ফোটা ফুল, সঙ্গে ব্যথার সানাই। হৃদয়ের গহিন অতলান্তে কবিতার মুহূর্ত তৈরি হয়। মারুফের সঙ্গে মিশে অর্পার সিগারেট খাওয়া, পরবর্তী সময়ে মারুফহীন অর্পার নেশার আসক্তি সুখ-ভালোবাসার বিপরীতে জ্বালাপোড়ার বহিঃপ্রকাশ। এ–ও এক নীল সুখ। এসবই বিবর্ণ জীবনের প্রতিচ্ছবি। রেখাটা সরল ও বক্র—এভাবেই চলে আমাদের জীবনের চক্র।