কৃষ্ণচূড়া বাড়ি

ছবি: এআই/বন্ধুসভা

অধরা—বয়স তেইশ। অথচ মনে হয় কত যুগের স্মৃতি জমে আছে তার ভেতরে। সাড়ে তিন বছর বয়স থেকে একটা শহরে বসবাস করলেও এই শহর, এই রাস্তা, এই মানুষের ভিড়—কোনোটার প্রতিই তার মনে কোনো টান জাগে না। এতগুলো বছর কেটে গেছে, কিন্তু এই জায়গার সঙ্গে কোনো মায়া গড়ে ওঠেনি। অথচ জন্মের পর থেকে তিন বছর পর্যন্ত যে বাসায় ছিল, সেই জায়গার প্রতি, সেই বাসার প্রতি, সেই শহরের প্রতি, সেই প্রতিবেশীদের প্রতি আজও এক গভীর আবেগ কাজ করে।

ছয় বছর বয়স পর্যন্ত, ওই কৃষ্ণচূড়া বাড়িতে অধরার যাওয়া-আসা ছিল নিয়মিত। তারপর কেটে গেছে দীর্ঘ সতেরো বছর। মনের অজান্তেই কোথায় যেন ভীষণ টান সেই বাড়িটার প্রতি। জীবনের সবচেয়ে রঙিন সময়টা কেটেছে সেখানে।

দাদা-দাদু, আব্বু-আম্মু, চাচ্চু, কাকি, ভাড়াটিয়াদের ছেলেমেয়েরা—সবাই মিলে কী আনন্দের সংসার ছিল তাদের! দাদু কখনো বাইরে গেলে অধরা জানালার ফাঁক দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকত, অপেক্ষা করত তাঁর ফেরার। দাদু দেরি করলে, সে দোতলার দরজার পাশে বসে কাঁদত। রাতে যখন কারেন্ট চলে যেত, মা ভূতের গল্প শোনাতেন আর অধরা ও তার ভাই মায়ের কোলে মুখ লুকিয়ে থাকত ভয় আর মুগ্ধতার মিশ্র অনুভূতিতে।

অধরার প্রায়ই ইচ্ছা করে, যদি একবার সেই বাসায় ফিরে যাওয়া যেত! যদি কয়েকটা দিন থাকা যেত কৃষ্ণচূড়া বাড়িতে!

আব্বু নামাজে মাঝেমধ্যে ওকে সঙ্গে নিতেন মসজিদে, আবার কোনো কোনো বিকেলে নিয়ে যেতেন লঞ্চঘাটে—মেঘনার তীরে দাঁড়িয়ে নদীর পানির ঢেউ দেখাতেন মেয়েকে। ওদের বাসার কাছেই ছিল সেই মেঘনা নদী, যার গন্ধ, যার বাতাস এখনো অধরার স্মৃতির ভেতর বেঁচে আছে।

পাশের বাসার সালমা একদিন অধরাকে নিয়ে গিয়েছিল বাউল মেলায়। যাওয়ার আগে আম্মু পাঁচ টাকা দিয়েছিলেন হাতে। মেলায় গিয়ে অধরার চোখে পড়ে একটি খেলনা পিস্তল, দাম দশ টাকা। টাকা না থাকায় কিনতে পারেনি সে। কিন্তু আজও মনে পড়ে মেলার সেই বিকেল, নদীর তীরের হাওয়া আর না-পাওয়ার কষ্ট। আর কখনো নদীর পাড়ের বাউল মেলায় যাওয়া হয়নি তার।

অধরাদের বাসার ছাদ অর্ধেক ঢেকে রাখত কৃষ্ণচূড়াগাছের ডাল। লাল ফুলে ভরে যেত চারপাশ। অনেক পুরোনো সেই গাছটি এখনো আছে—সতেরো বছরে আরও বড়, আরও সবল হয়েছে। যেন সেই গাছও অধরার মতো স্মৃতি ধরে রেখেছে, নীরবে।
কিন্তু শহরটা আর আগের মতো নেই। সরকারি অফিস-আদালত সরিয়ে নেওয়ার পর জায়গাটা এখন প্রায় পরিত্যক্ত। মানুষের ভিড় কমে গেছে, হাসির শব্দ হারিয়েছে। লঞ্চঘাটে এখন সারা দিনে মাত্র দুই-তিনটি লঞ্চ আসে–যায়। নেই আগের সেই জমজমাট পরিবেশ।

আরও পড়ুন

ওর দাদা বাড়িটা বড় ফুফুকে লিখে দিয়েছেন। এখন ফুফু সেটি বিক্রি করে দিতে চান, ক্রেতা খুঁজছেন। পুরোনো বাড়ি বলে, নতুন কেউ কিনলে হয়তো সেটি ভেঙে ফেলবে। আর তাতে চিরতরে হারিয়ে যাবে অধরার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় স্থানটি—যেখানে তার জন্ম, যেখানে জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময়গুলো কেটেছিল।

অধরার প্রায়ই ইচ্ছা করে, যদি একবার সেই বাসায় ফিরে যাওয়া যেত! যদি কয়েকটা দিন থাকা যেত কৃষ্ণচূড়া বাড়িতে! কিন্তু আবার ভয়ও লাগে—যদি সেই দেয়ালগুলো, সেই ছাদ, সেই গাছ, সেই ঘরগুলো হারিয়ে যাওয়া মুখগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়? যদি বাড়িটা তাকে আরও গভীরভাবে টেনে নেয় সেই অতীতে।

জীবনের সবচেয়ে কষ্টের বিষয় হলো—যখন কেউ জানে, কোনো সম্পর্ক আর কোনো দিন মিলবে না। অধরা জানে, তার আব্বু-আম্মু আর কোনো দিন এক হতে পারবেন না, সেই কৃষ্ণচূড়া বাড়ির পরিবারটিও কোনো দিন ফিরে পাওয়া যাবে না।

শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়