ইনবক্সে যতবার স্ক্রল করি, ততবার এমন প্রিয় মানুষগুলোর সঙ্গে কথা হওয়ার সময় দেখায়—এক বছর, দুই বছর, পাঁচ বছর, সাত বছর, বারো বছর আগের!
এই বয়স পুরোনো স্মৃতি খোঁজার বয়স না, আমি বুঝি। এ–ও বুঝি, বাস্তবতার সমীক্ষায় লোকে আমাকে পাগল বলবে। বলেও তা–ই। আমি অবশ্য বিশ্বাস করতাম না। এমন হাসিখুশিভাবে চলা কোনো মানুষ আবার পাগল কীভাবে হয়!
কাজল চোখের মায়াবী মেয়েটিও একবার একই কথা বলল। এর পর থেকে কেউ আমাকে পাগল বললে বিশ্বাস করি। মানুষ যখন কাউকে মন থেকে বিশ্বাস করে, তখন তার বলা সব কথাও সত্য বলে মনে হয়। ঠিক মা–বাবার মতো। মা রেগে গেলে প্রায়ই বলত, ‘তোকে দিয়ে পড়ালেখা হবে না।’ আমি কান্না জুড়ে দিতাম। বিশ্বাস করে নিতাম, সত্যিই আমার পড়ালেখা হবে না। মায়ের হাত-পা ধরে মাফ চেয়ে আবার পড়তে বসতাম। সে অনেক আগের কথা। তখন গ্রামে থাকি, বিকেল হলেই মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে ক্রিকেট খেলতে যাওয়ার বয়স তখন।
তবু প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে পুরোনো দিনের স্মৃতি নাড়াচাড়া করি। আমি জানি আমি সত্য। আমার কথাগুলোর কোনো নড়চড় হয়নি। শুধু কথা রাখার জন্য নিজের অবস্থান থেকে সহস্রবার ফিরে এসেছি, নত হয়েছি; বিনীত হয়েছি।
আইমানকে লিখতে দিয়ে হঠাৎই পুরোনো দিনে কথা হয়েছে, এমন মানুষের ইনবক্সে যাই। স্ক্রল করে ওপরের দিকে গিয়ে দেখার চেষ্টা করি, কী কথা বলতাম!
কলেজে পড়ার সময় একজনকে বলেছিলাম, ‘আজ থেকে ঠিক এক বছর পর আমার প্রতি তোমার এই দুর্বলতা মুছে যাবে।’ উত্তরে ভদ্রমহিলা বলেছিল, ‘কখনোই না। আপনি নিজের মতো করে সবকিছু ভেবে নেন বলে এমন মনে হচ্ছে। নারীদের মনে একবার জায়গা করে নেওয়া পুরুষদের নারীরা ভুলতে পারে না।’
আমি সেদিন বাড়ির মধ্যে হো হো করে হেসে উঠলাম। বড় চাচি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আব্বা কী হইছে তোর, হাসিস কেন?’ বললাম, ‘এমনিই বড় মা। কিছু হয়নি। জন্ম থেকে কবরে যাওয়ার আগ অবধি মানুষ মানুষকে চেনার জন্য দীর্ঘ সংগ্রাম করে। আপাতত আমিও সেই যাত্রায় যাত্রী!’ বড় মা উঠোন ঝাড়ু দিতে দিতে বললেন, ‘কী জানি বাপু! তোদের কথার হাবভাব বুঝি না।’
আমি এগিয়ে গিয়ে ঝাড়ুটা নিয়ে বড় মাকে বললাম, ‘বড় মা, এই যে তোমাদের যুগের মানুষেরা এত হাবভাব বোঝে না। এই ভালো। আমরা আসলে একটু বেশি বুঝি। বেশি বুঝতে গিয়ে একটা বয়সে এসে বুঝতে পারি। কিন্তু আফসোস ছাড়া আমাদের কাছে তখন কিছুই থাকে না।’
ইনবক্স থেকে যত দূরে যাই, ততই বছরের সংখ্যা বাড়তে থাকে। হিসাব করে দেখি, অমুকের সঙ্গে কথা হতো আজ থেকে প্রায় তিন বছর আগে, চার বছর আগে, পাঁচ বছর আগে। আট-দশ বছর আগেও হয়েছে। ছোট্ট করে জিজ্ঞেস করি, ভালো আছেন?
কেউ কেউ আশ্চর্য হয়। এত বছর পর আপনি! আমি বলি, হ্যাঁ। এর মধ্যে প্রায় আটটি বছর চলে গেছে।
কারও কারও সঙ্গে কথা হয় না। শুধু দেখি। ঠিক আজকের এই দিনে এক বছর আগে যে মানুষ, যে কথা, যেভাবে আমাকে বলেছিল—এখন সে মানুষের কথার ধরন ভিন্ন। নিজের প্রতি নিজে আশ্চর্য হয়ে আমাকেই জিজ্ঞেস করি, নিজেকে এমন ভেঙে ফেলেছিস কেন?
আমার বিবেক উত্তর দেয় না। চুপ করে থাকে। ওর চুপ করে থাকায় আমার মেজাজ খারাপ হয়। নিজের ওপর নিজের মেজাজ খারাপ হওয়ার চেয়ে বিরক্তিকর বোধ হয় আর কিছু হয় না। বিবেক একবার তার ভেতরের চোখ মুছে ফেলে বলতে চায়, আমি দুঃখিত। কিন্তু নিজেকে সামলে উঠতে পারে না বলে তা–ও বলতে পারে না।
একদিন খুব কাছের একজন মানুষের ইনবক্সে গিয়ে শেষ মেসেজে দুবার ট্যাপ করে দেখলাম, শেষবার কথা হয়েছিল ২০১৮ সালে। লিখলাম, ‘ভালো আছেন ভাইয়া?’ অন্তর ভাই আশ্চর্য হলেন। বললেন, ‘এত দিন পর ভাইয়ার কথা মনে পড়ল? তোকে খুব মিস করি ভাইয়া। আমি এখন গ্রামেই আছি। বিয়েশাদি করেছি। একবার এসে ঘুরে যাইস এলাকায় এলে।’
আমি বললাম, ‘আচ্ছা ভাই।’
ইনবক্সে যতবার স্ক্রল করি, ততবার এমন প্রিয় মানুষগুলোর সঙ্গে কথা হওয়ার সময় দেখায়—এক বছর, দুই বছর, পাঁচ বছর, সাত বছর, বারো বছর আগের!
আইমানকে পড়াতে এসে আমার মতোই কোনো মানুষ দীর্ঘ সময় পর যদি এমন বছরের দূরত্ব মাপতে যায়; তবে দেখবে, ইনবক্সে পাঠানো শেষ বার্তাটি লেখা আছে, ‘ভালো আছ?’ উত্তর না পাঠানোর যন্ত্রণা তখন তাকে ছুঁবে কি না, আমার জানা নেই। জেনে নেওয়ার সব সুযোগের ঊর্ধ্বে থাকা আমি একটু মুচকি হেসে দেখব, ধ্রুবতারা জ্বলছে। আকাশে কোনো মেঘ নেই। আকাশ পরিষ্কার, সেদিন মেঘ হওয়ার সম্ভবনাও নেই।
বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, ঢাকা