আলেয়ার তলপেটে ব্যথা করছে। সারা রাত ঘুমাতে পারেনি। ভোরের আকাশ ফরসা হতে শুরু করেছে। দূর থেকে থেমে থেমে ডাকছে অপরিচিত নিশিজাগা পাখি। তীব্র ব্যথা কতটুকু আর সহ্য করা যায়? মাকে যে বলবে সেই সাহসটুকুও নেই। চুরি করে ট্যাবলেট খাচ্ছে। নিয়মকানুন তেমন জানে না। প্যাকেট থেকে বের করে তাড়াহুড়া করে খেয়ে নেয়। তখন অতকিছু বোঝেনি। এমনিতে মাসিকের সময় ঘনিয়ে এলে আতঙ্কে থাকে। দক্ষিণবঙ্গের উপকূলীয় এই এলাকায় পানযোগ্য সুপেয় পানির বড় অভাব। পরিচ্ছন্নতার জন্য পানি তো অলীক কল্পনা। মাসিকের সময় ব্যবহার করতে হয় ন্যাকড়া। এত যন্ত্রণা, রীতিমতো ভয়ংকর ব্যাপার। আলেয়া ক্লাসের এক সহপাঠীর কাছ থেকে গর্ভনিরোধক বড়ি খাওয়ার বুদ্ধিটা পেয়েছে। সামনের বছর ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেবে। সুবুদ্ধি না কুবুদ্ধি, সেটা বুঝে উঠতে পারছে না। ব্যথা বাড়ছে। রাতও পেরোল। ঘুম না হওয়ায় মাথাটা ভার হয়ে আছে। আজান শেষে বিছানায় আরও কিছুক্ষণ থেকে গড়াগড়ি খেয়ে উঠে পড়ল।
বড়ি সে গত বছর থেকে খায়। এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়নি। কিছুদিন মাসিক বন্ধ থাকায় বরং খুশিই ছিল। মাসিকের দিনগুলোর কথা স্মরণ হলে বুকে কাঁপন ধরে। অসম্ভব মানসিক যন্ত্রণার দিন। বাড়িতে একটা স্যানিটারি ল্যাট্রিন পর্যন্ত নেই। কাপড় দিয়ে পরিচ্ছন্নতার নামে সংক্রমণ। লবণাক্ত পানি ব্যবহারের কারণে জননাঙ্গসহ চামড়ায় চুলকানি। এত সব ধকলে মনমেজাজও খিটখিটে হয়ে থাকে। এক বিভীষিকা! ভালো লাগে না কিছু। প্রস্রাবে সমস্যা। চেপে থাকে। পানি কম পান করে যেন প্রস্রাবের চাপ কম আসে। জ্বালাপোড়া করে। নানাবিধ সমস্যা। গত কয়েক মাস এসব যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়েছিল। বিয়ের কথা ওঠায় কিছুদিন বড়ি খাওয়া বন্ধ রেখেছিল। বিয়ে মোটামুটি ঠিকঠাক হয়ে যাবার পরও শেষ দিকে যৌতুক নিয়ে বনিবনা না হওয়ায় বিয়েটা হয়নি। বড়ি খাওয়া বন্ধ করার পর এক মাস বিরতি দিয়ে ফের মাসিক চক্রের শুরু। তাই গত মাস থেকে বড়ি খাওয়া শুরু করেছিল। এবার বিপত্তিটা বাধল। মাসিক তো বন্ধ হয়নি, উল্টো রক্তপাত বেড়ে গেছে। প্রথম দিন এত বেশি রক্ত দেখে ঘাবড়ে গেলেও ভয় পায়নি। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় দিনে ধারাবাহিকভাবে রক্তপাত যখন আরও বাড়ল তখন ভয়টা পেল। শরীর দুর্বল হতে থাকল। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অসহ্যকর ব্যথা।
বিছানা ছেড়ে উঠে বাড়ির আঙিনা ঝাড়ু দিয়ে আলেয়া নিজেদের চিংড়ির ঘের দেখতে গেল। আশপাশে পানি বাড়ছে। গতবারের বন্যায় ঘের ভেসে গিয়ে তাদের পথে বসিয়ে দিয়েছিল। বাবা ঋণ করে এ বছর আবার চিংড়ির চাষ করেছে। উপায়ও নেই। নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে এই অঞ্চলে চাষাবাদও তেমন একটা হয় না। লবণাক্ততা, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঘন ঘন বন্যার প্রকোপ, চাষযোগ্য জমির অভাব—সব মিলিয়ে সাগরে মাছ ধরা বা মাছ চাষ করা ব্যতীত হাতের কাছে তেমন একটা উপায়ও নেই। সংসারের বাড়তি আয়ের জন্য বাবার সঙ্গে পানিতে নেমে মাছ ধরতে হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দিনের প্রায় পুরোটা সময় সারা অঙ্গ ভিজিয়ে পানিতে থাকতে হয়। শরীরের জন্য ক্ষতি। উপায় তো নেই। এই অঞ্চলের বেশির ভাগ নারীর জীবনই এ রকম। পরিবারের কিছুটা বাড়তি আয়ে সহযোগিতা করা। আলেয়া, আলেয়ার মা, তার ফুফু কিংবা আশপাশের দশজন নারী...পরবর্তী বেলার ভাতের চাল কেনার নিয়মিত দুশ্চিন্তার কাছে তাদের প্রজননস্বাস্থ্যের চিন্তা লঘু হয়ে যায়। এবার বন্যা হানা দিলে তাদের দুচোখ বন্ধ করে কোনো দিকে চলে যেতে হবে।
ঘেরের সামনে দাঁড়িয়ে আলেয়া দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। কত কত স্বপ্ন! যদি ঠিকঠাক মাছগুলো বেড়ে ওঠে, বন্যা না হয়… ঋণ শোধ করতে হবে, ঘরের চাল ঠিক করতে হবে, মায়ের অপারেশন। সবকিছু পরিকল্পনামাফিক হলে পরিবার থেকে তাকে বিয়ে দেবে বছর না পেরোতেই। বিয়ের কথা কল্পনায় আলেয়ার চোখে-মুখে খানিক লজ্জার আভা ফুটে উঠল!
দ্রুত বাড়ি ফিরে কিছু না খেয়েই কলসিটা নিয়ে রীতিমতো দৌড়াতে থাকে। স্কুলের কাছের ট্যাংক থেকে খাবার পানি আনতে হবে। আগে আগে না পৌঁছালে, লম্বা লাইন শেষে পানি নাও পেতে পারে। প্রায় সময়ই চাহিদামতো পাওয়া যায় না। উপায়ান্তর না দেখে ফিটকিরি দিয়ে পুকুরের পানি খেতে হয়। এই পানি খেতে আলেয়ার ভালো লাগে না। তৃপ্তি পায় না। পানির লোভে সে আরও একটু জোরে দৌড়াতে চেষ্টা করে। ব্যথার সঙ্গে লড়াই করে পারছে না। খুবই অস্বস্তি লাগছে। পাড়ি দিতে হবে চার কিলোমিটার পথ। পানির জন্য এমন হাহাকার!
আলেয়া প্রয়োজনের অর্ধেক পানি সংগ্রহ করতে পারে। যেদিন এমন হয়, সেদিন মন ভার করে বাড়ি ফেরে। আধুনিক পৃথিবীর মানুষ নতুন নানাবিধ সমস্যা মোকাবিলা করে, আর বাংলাদেশের এই অঞ্চলের মানুষগুলোর জীবনের অপরিহার্য পানির সমস্যা মোকাবিলা করে বেঁচে থাকা দায়। রাষ্ট্র তাদের মৌলিক অধিকারটুকু নিশ্চিত করতে পারছে না। শুধু কি রাষ্ট্রের ব্যর্থতা? আগে অন্তত পাঁচ-ছয় মাস মানে বর্ষাকাল পেরিয়ে গেলেও সুপেয় পানি পাওয়া যেত, এখন সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতার ফলে লবণাক্ততা বেড়ে গিয়ে আরও বেশি মিঠাপানির সঙ্গে মেশে। সমুদ্রের পানির সঙ্গে কোনো সীমানা নেই। পুকুরের পানিতেও লবণ। ছয়-সাত শ ফুট গভীর নলকূপ থেকেও লোনাপানি ওঠে! বর্ষাকালেও সুপেয় পানির ব্যবস্থা হয় না। একমাত্র উপায় বৃষ্টির পানি। সেটার কতটুকুই আর সংরক্ষণ করা যায়! জলবায়ু পরিবর্তনের বাস্তবিক দুর্যোগ তাদের এমনভাবে আঘাত করছে, আধুনিকতার নামে পৃথিবীবাসীর এই নিষ্ঠুরতার প্রভাব ধ্বংস করছে জনজীবন। আধুনিকতার কতটুকুই তারা ভোগ করতে পারে? সামান্য চিকিৎসার জন্য পায়ে হেঁটে, বা ভ্যান-লঞ্চে চড়ে পাড়ি দিতে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ কিলোমিটার পথ। তিন বেলা পেট ভরে খাবারের জন্য বন্য লড়াই করতে হয়। আজকের প্রয়োজনই মেটে না, আগামীকালের চিন্তা করা দুর্ভাবনা।
পানির কলস রেখে হাত-মুখ ধুয়ে আলেয়া দুইটা টোস্ট বিস্কুট খেয়ে নেয়। ব্যথা কমার কোনো নামগন্ধ নেই। কী করবে, বুঝে উঠতে পারছে না। রক্তও আরও বেশি যাচ্ছে। চোখেমুখে অন্ধকার দেখে।
আলেয়ার মায়ের জীবনও যুদ্ধময়! বয়স সবে মধ্য তিরিশ। আলেয়ার পর বুকজুড়ে আর কোনো সন্তান জন্মায়নি। একমাত্র আলেয়াই সম্বল। তার জরায়ুতে সংক্রমণ দেখা দিয়েছে। ডাক্তার বলেছে জরায়ু কেটে ফেলতে হবে। নইলে সংক্রমণ ছড়িয়ে ক্যানসারে রূপান্তর হবার আশঙ্কা আছে। হাসপাতালে গিয়েছিল বছর দুয়েক আগে। হাজার পঞ্চাশেক টাকার প্রয়োজন। শুধু চিকিৎসার জন্য একসঙ্গে এত টাকা খরচ করার সামর্থ্য তাদের নেই। জোগাড় করবে কোথায় থেকে! বাড়তি ঋণ নিয়ে সুদ চালাবে সেই সুযোগও নেই। পরিবারের দৈনিক আয় মোটে সাড়ে চার শ-পাঁচ শ টাকা। কোনো রকম খেয়ে পরে বেঁচে থাকাই দায়। সমস্যা আর টাকার অভাবে জর্জরিত। মানসিক স্বাস্থ্যও ভালো না। মেয়েটার বিয়ের সম্বন্ধ এসে ভেঙে যায়। গায়ে গতরে ডাঙ্গর হয়েছে, আরেকটু বয়স বাড়লেই বিয়ের বাজারে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবে। তখন উপায়? সমাজের মানুষ এখনই নানা কথা বলে বেড়াচ্ছে। আড়ালে–আবডালে কিছু কথা আলেয়ার মায়ের কানেও আসে। শোনে চুপচাপ। তার নিজের ব্যক্তিগত জীবনেও কি দুর্দশা কম?
এই বয়সে জরায়ু হারানোর মতো বেদনা আর হয়? এত চেষ্টার পরও দ্বিতীয় সন্তানটি পৃথিবীর মুখ দেখল না। কলিজা ছিঁড়ে কান্না আসে। মেয়েটার জন্যও চিন্তা হয়। এই অঞ্চলের প্রতিটি নারীর জীবনের ভবিষ্যৎ যেন একই। চোখেমুখে অন্ধকার দেখে। উত্তরণের উপায় খোঁজে। অকূল পাথর থেকে তাদের উদ্ধার করবে এমন ঐশ্বরিক শক্তি কোথায়!
এত এত অভাবে দিগ্বিদিক শূন্য আলেয়ার বাবা মাঝেমধ্যে ভাবে, ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য ঢাকা শহরে যাবে। যদি ভাগ্যের চাকা ঘোরে! গ্রামের অনেক সামর্থ্যবান পুরুষ গেছে। আলেয়ার বাবা ঠিকঠাক সাহস করে উঠতে পারে না। শহরে গেলে তার পরিবারটি পুরুষশূন্য হয়ে যাবে। মন একবার সায় দেয়, আবার দেয় না। পরিবেশ পরিস্থিতিও ভালো না।
আলেয়া মন ভার করে বসে আছে। চোখ জোড়া কোটরে ঢুকে গেছে। চুলগুলো রুক্ষ সব। সে বুঝে উঠতে পারেনি যে ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া গর্ভনিরোধক বড়ি খাওয়া ঠিক নয়। এসব নিয়ম করে নিয়মিত খেতে হয়। একবার খাওয়া শুরু করে বন্ধ করে আবার খাওয়া ঠিক নয়। শরীরে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। গ্রামে, যেখানে সুপেয় পানিই ঠিকমতো পৌঁছায় না, পৌঁছায় না মানসম্মত স্যানিটারি ন্যাপকিন, বিপর্যস্ত প্রজননস্বাস্থ্য সেখানে সচেতনতাই-বা পৌঁছাবে কীভাবে!
টানা বৃষ্টিতে পানি কেবল বাড়ছে। চারদিক প্লাবিত হয়ে গেছে। কেবল শুকিয়ে যাচ্ছে আলেয়ার শরীরের রক্ত। তাদের চিংড়ির ঘের ফের বন্যার কবলে পড়বে বোধ হয়। এবারও ভেসে গেলে ঋণ শোধ করবে কীভাবে? খাবেই বা কেমন করে! চিকিৎসা করবে কীভাবে? আলেয়ার বিয়ের যৌতুকের জন্য টাকাই-বা কোথা থেকে জোগাড় হবে! চোখের সামনে পরিবারের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যাচ্ছে। আলেয়া নিরুপায়। তার বুক ধড়ফড় করে।
রাজ্যের চিন্তা মাথায় চেপে আলেয়া ঘেরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সব দিকে থই থই পানি। কলকল শব্দ। এত পানি, তবু ব্যবহার করার মতো নয়। ভীষণ তৃষ্ণা পায়। যদি দুই হাতের আঁজলা ভরে পানি পান করতে পারত! আফসোস। সব লোনাপানি। মুখে নেওয়া যায় না। পানি কেবল বাড়ছে। একে একে নষ্ট হচ্ছে বুনে রাখা স্বপ্ন…। আশপাশে ভাঙনের শব্দ শোনা যাচ্ছে।