চিঠি
বাসুন বারোতে (চতুর্থ পর্ব)
চিঠিটি আমার একমাত্র ছেলেকে উদ্দেশ করে লেখা। এই চিঠি যখন লিখি, তখন তার বয়স ছিল ১১ বছর। বর্তমানে সে ২৪ বছরের তরুণ।
বাসুন,
প্রতি মুহূর্তের চ্যালেঞ্জ মানুষকে গতিময় রাখে। জীবনকে খুঁজে পাওয়া যায় প্রবল বাধার ভেতর দিয়ে। যে মানুষ যত বেশি নিরাপদ বেষ্টনীতে বড় হয়, সে তত কম সফলতা পায়। বাধা মানুষকে করে ইস্পাতসম কঠিন।
কথাগুলো বলছিলাম বালাজির কাহিনি শুনে। বালাজি দুখমে এসেছে আফ্রিকার সিয়েরা লিওন থেকে। ওর গ্রামের নাম মনে পড়ছে না এই মুহূর্তে। বালাজি অফিসে এসেছিল কাজের খোঁজে, পার্টটাইম কাজ। প্রথম যেদিন আসে, স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বলেছিলাম, ‘বালাজি, তোমাকে অনেক দূরে যেতে হবে, পড়াশোনা করে নিজেকে দাঁড় করাতে হবে, ভালো জব পেতে হবে। মনে রেখো, জীবনে সফল হতে না পারলে সারা জীবন কষ্ট পেতে হবে।’ সেদিন জানতাম না বালাজি বাড়ি গিয়ে আমার কথা শুনে কাঁদবে। এতিম ছেলে বলেই কথাগুলো ওর মনে এতটা দাগ কেটেছিল।
২১ বছর বয়সী কালো ছেলে, আফ্রিকা থেকে রিফিউজি হয়ে কানাডায় প্রবেশ করেছে। এখনো লিগ্যাল পেপারস হয়নি। প্রথম তিন মাস ছিল রাস্তায় রাস্তায়, কখনো ঘুমিয়েছে ফুটপাতে। তীব্র ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে গেছে কারও বাড়ির গ্যারেজে। কিন্তু সেই কষ্টই সব নয়; বরং জন্ম হওয়ার পর ১৬ বছর বয়সে নিজের যে পরিচয় বালাজি পেয়েছে, সেই বেদনা ওকে আছন্ন রাখে প্রতি মুহূর্ত।
কোথায় জন্মেছিল ও? কারা ওর বাবা-মা? কেমন ছিলেন তাঁরা দেখতে? কী ওর শিকড়? কোথা থেকে এই মানবজন্ম বালাজির? এসব প্রশ্নের কাছে খাওয়া–পরার চিন্তাটা হয়তো মামুলিই মনে হয় বালাজির। নইলে কেঁদে ফেলল কী করে কুচকুচে কালো বালক ছেলে? বালাজির সঙ্গে বসে কথা বলছিলাম কফি শপে।
বলো, তোমার বাবা-মা, তোমার পরিবারের কথা। আমি শুনতে চাই।
বালাজির গল্প শুনতে শুনতে তোর শিশুমুখ ভেসে উঠল নিজের আয়নায়। আমি চলে গেলে তোকেও তো একা বাঁচতে হবে বাবু। মা না থাকলে কি মানুষের কেউ থাকে?
বালাজি তাকিয়ে আছে শূন্যদৃষ্টি নিয়ে। ‘জানো লুনা, জন্মাবার এক বছর পরে আমার গ্রামে সিভিল ওয়ার হয়। জানো তো আফ্রিকার কথা, তাই না? আমার বয়স তখন এক বছর, ১৯৯১ সাল। আমার জন্ম হয় ১৯৯০-এ। যুদ্ধে মারা যায় আমার পরিবারের সবাই। আমাকে বড় করেন অন্য এক মানুষ। তাঁর নাম আলাজি। আমার তখন ১৬ বছর বয়স। একদিন পালিত বাবা আমাকে হাসপাতালে ডাকেন, ভীষণ অসুস্থ আলাজি সেদিন। সিয়েরা লিওনে হীরার খনিতে কাজ শুরু করি ১৪ বছর বয়সে। আমার কাজের জায়গা থেকে ডেকে বলা হয়, “তোমার বাবা তোমাকে হাসপাতালে ডাকছেন।” যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাবা আমার হাত ধরে বলেন, “শোনো বালাজি, এখন যা বলব তা তুমি কোনো দিন শোনোনি। আমি তোমার সত্যিকারের বাবা নই। ওই যে দেখছ মহিলা, যাকে তুমি এত দিন মা ডেকেছ, সেও তোমার নিজের মা নয়। তোমার জন্মের এক বছর পরে তোমার বাবা-মা নিহত হন। আমি তোমাকে লালন–পালন করি। কিন্তু অর্থের অভাবে তোমাকে পড়াতে পারিনি। কিছুই করতে পারিনি তোমার জন্য। তুমি চেষ্টা করো নিজে বাঁচতে, দুনিয়ায় আপন বলতে তোমার কেউ নেই।” এ কথা বলতে বলতে আলাজি সেদিন শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন।’
বালাজির ১৬ বছর বয়সে ওর পালিত মা ওকে এতিমখানায় রেখে চলে যান অন্য শহরে। ডায়মন্ড খনিতে কাজ করতে করতে বালাজি স্বপ্ন দেখে আফ্রিকার দরিদ্র গ্রাম থেকে পালাবে। আরও বছর দুই কাজ করার পর বালাজি দালাল ধরে নানা পথ পার হয়ে কানাডায় রিফিউজি হয়ে প্রবেশ করে।
বালাজির গল্প শুনতে শুনতে তোর শিশুমুখ ভেসে উঠল নিজের আয়নায়। আমি চলে গেলে তোকেও তো একা বাঁচতে হবে বাবু। মা না থাকলে কি মানুষের কেউ থাকে? হ্যাঁ, তোর বাবা আছেন, তোর বাবাও তোকে ভালোবাসেন ভীষণ। যেকোনো ব্রোকেন ফ্যামিলির চেয়ে তোর বাবার সঙ্গে তোর বন্ধন অনেক অনেক শক্ত। আজকে ১২ বছর পরে সে কথা আমি জোরের সঙ্গেই বলতে পারি। কিন্তু বাবু, এই বিদেশ–বিভুঁইয়ে তো তুই একা। এই যে বড়দিনের ছুটি, আমি লিখছি, তুই বসে গেম খেলছিস; আমাদের নিরাপদ জীবন। আমি একটা একটা করে দিন পার করেছিলাম এই আজকের জীবনটার জন্য। আমিও তোর জন্য বাড়ি, গাড়ি, জমি, টাকা—কিছুই জমিয়ে যেতে পারব না সোনা। তুই কি সেদিন বালাজির মতো করে বাঁচতে শিখবি বাবু?
পৃথিবী বিখ্যাত স্টিভ জবস যেভাবে গড়েছিলেন নিজেকে বা আজকে থেকে মাত্র আট বছর আগে ২০০৪-এর ২০ ডিসেম্বরে বাংলাদেশ থেকে তোর হাত ধরে টরন্টো এসেছিলাম, সেদিন সত্যিই ভাবিনি ২০১১-এর ডিসেম্বরের বালাজির সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে নিজেকে ভাবব বা কোনো দিন তোকে নিয়ে নিজের মতো বাঁচতে পারব। সেদিন সারাক্ষণ একটা অনিশ্চয়তা ঘিরে থাকত, আর সেই বাধা পার হওয়ার তাড়নাই বাঁচিয়ে রাখত আমাদের, তাই না বাসুন?
ডিসেম্বর মাস এলেই আমার কী যেন হয় বাবু। চারদিকের বরফে মন ভীষণ অন্য রকম হয় সোনা। আজকে বিশ্বাস করি, সাহস আর আত্মশক্তি মানুষের বড় সহায়। বালাজি দাঁড়িয়ে যাবে এই শহরে। পৃথিবীর বুকে সবাই জায়গা করে নেবে বাবু। তুই, আমি, বালাজি—সবাই।
তোর মা
২৫ ডিসেম্বর ২০১১
টরন্টো, কানাডা