চিঠি
বাসুন বারোতে (তৃতীয় পর্ব)
চিঠিটি আমার একমাত্র ছেলেকে উদ্দেশ করে লেখা। এই চিঠি যখন লিখি, তখন তার বয়স ছিল ১১ বছর। বর্তমানে সে ২৪ বছরের তরুণ।
তোর কি মনে থাকবে বাসুন, আমার-তোর আজকের দিনগুলো?
বাসুন,
আবার ছুটির দিন সকাল। এইমাত্র কফি শেষ করে লিখতে বসলাম। একটা অনুভূতি, খুব বলতে ইচ্ছা করছে। এই যে তোকে নিয়ে আমার বয়ে যাওয়া জীবন লিখছি, খুব ভালো লাগছে, জানিস বাসুন! মনে হচ্ছে, পৃথিবীর কত কত মানুষের সঙ্গে একমুহূর্তে যোগ ঘটে যায়। টেকনোলজির এই এক গুণ, তাই না সোনা?
তোরা বড় হচ্ছিস, এই সময়কে সঙ্গে নিয়ে। ভীষণ ভালো লাগে একটা পর্ব লিখে যখন পোস্ট দিই, যেন নতুন করে বেঁচে ওঠা। প্রতিটি চিঠি ছাপা হলেই তুই বলিস, ‘মা, পড়ে শোনাও।’ আমি কিন্তু কিছু বাদ দিয়ে দিয়ে পড়ি, তোর শিশুমনে আমার কষ্টের কথা কোনো রেখাপাত যেন না করে। মায়েরা বুঝি এমনই হয়, তাই না বাবা? আজকে আমাদের মা ১৭ হাজার মাইল দূরে বসে থাকেন, বাংলাদেশ নামক এক দেশে, জন্মের নাড়ি পোঁতা আছে যে মাটিতে।
২১ বছর বয়সের ভেতর চার মেয়ে জন্ম দিয়ে যে মা আমাদের মানুষ করতে গিয়ে বেসামাল হয়ে গিয়েছিলেন একটা সময়; আজকে সেই মায়ের অফুরন্ত অবসর। মা–বাবা বসে থাকেন আমাদের একটা ফোনের অপেক্ষায়। যে বাবা কম বেতন পেতেন বলে বস্তা বস্তা বোর্ডের খাতা দেখতেন, আজকে সেই বাবা আমাদের ফোনালাপ শুনে নীরবে চোখ মোছেন।
জানিস বাজান, আমাদের মায়ের জীবনে একটা সময় ছিল, যখন তিনি কেবল ভাবতেন কবে আমরা বড় হব? কবে সব কষ্ট দূর হবে?
সরকারি চাকুরে বাবার সামান্য আয় দিয়ে কী করে মা আমাদের চার বোনসহ এত বড় সংসার টেনেছেন? কেমন অবাক লাগে ভাবতে। আমার মা বুঝি কোনো দিন নিজের কথা ভাবেননি। কী করে ভাববেন? ১৫ বছর বয়সে বিয়ে, ২১-এর ভেতর চার মেয়ে, বাবা কলেজ টিচার, কী করবেন মা? কী নিদারুণ টানাপোড়েন। মায়ের সারা বেলা কেটেছে অপেক্ষাতে—‘এই তো সামনের মাসে বাবার বেতন হলেই তোমাদের এটা দেব, ওটা দেব।’ তারপর বেতন হওয়ার আগেই আরও পাঁচটা জরুরি চাহিদা পূরণ করতে হয়েছিল মাকে। যেন আমার আজকের এই জীবন দিয়েই মাকে দেখতে পাই বাবু। তোর কি মনে থাকবে বাসুন, আমার-তোর আজকের দিনগুলো? তুই যে বলিস প্রায়ই, ‘মা, কবে আমরা বাড়ি কিনব? কবে গাড়ি কিনব?’ আমি তোকে আমার মায়ের ফেলে আসা ৪০ বছর আগের জীবনের মতো বোঝাতে থাকি, বলতে থাকি, জীবনে বড় হতে গেলে কষ্ট করতে হয়। এখনো বিশ্বাস করি সে কথা। কিন্তু আধুনিকতার ধোপে প্রায়ই টলে ওঠে এই বোধ, কেন এমন করে ভাবি আমি?
আজ থেকে ৭ বছর আগে মাত্র ১০০ ডলার নিয়ে কানাডায় এসে ছোট বোনের বাসায় উঠেছিলাম। কী বিশাল যুদ্ধ ছিল সেটা! ছোট বোন–বোনজামাই আমাদের অমন করে ভালো না বাসলে আজকের দিনের সূচনা করতে পারতাম না। কিছুতেই না। যেমন আমার মা করেছেন অনেকের জীবনে। নিজের পাতের খাবার তুলে দিয়েছেন গ্রামের সেই তরুণ বা তরুণীর প্লেটে। যে নতুন করে ঢাকায় সেটেল করতে চেয়েছে, তার জন্য করেছেন আমার মা-বাবা।
আমার বোন–বোনজামাই তা–ই করেছে আমার-তোর জন্য। তোকে নিয়ে নতুন করে বেঁচে থাকার যুদ্ধে আমার বোন ছিল একান্ত সহায়। কিন্তু আজকের টরন্টো শহরে যে নতুন অভিবাসীদের জীবন দেখি, তাঁরা যেন আমার চেয়ে অনেক অনেক ভিন্ন। তাঁরা কাঁড়ি কাঁড়ি ডলার নিয়ে আসেন, হাজার হাজার ডলার। কোনো আত্মীয়স্বজনের বাসায় উঠতে পারেন না বা উঠলেও মাত্র কিছুদিনের ভেতর সেই দুই পরিবারের সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়। দেখেছি, এই শহরে আপন ভাই-বোনে সম্পর্ক নেই, মা–বাবা বিদেশে এসে ছেলেমেয়ের কাছে কষ্ট পাচ্ছেন।
তারপরের কাহিনি তো আরও গভীর। নতুন অভিবাসীরা এসে বলতে থাকেন, ‘এই কাজ করব না, ওই কাজ করব না। কেন আবার কষ্ট করব? আমার এখনই জব চাই।’ যেন কষ্টের পথে হাঁটতেই চান না তাঁরা। মনে করেন, কষ্ট করার জন্য তো বিদেশে আসেননি তাঁরা!
কিন্তু সংগ্রাম ছাড়া জীবন অর্জন হবে কী করে বাসুন? এসব বলেছি কেন সোনা? কারণ, আমি তোর জন্য কিছুই করিনি। কোনো সেভিংস প্ল্যান না, কোনো এডুকেশন প্ল্যান না, কিচ্ছু না। কেবল তোকে একটা উন্নত দেশের নাগরিক করে দিতে পেরেছি। কিন্তু তোর জীবন তো তোকেই গড়তে হবে বাবু। আমি চোখ বুজলে যেন তুই অনেক সাহস পাস। তুই যাতে বিশ্বাস করিস, জীবন অর্জন করে নিতে হয় নিজেকেই। এর বাইরে কোনো সত্য নেই।
আমার এই ধারাবাহিক লেখার একজন পাঠক মন্তব্য করেছেন, লেখার মোড় ঘুরছে। কথাটা টানছে ভীষণভাবে। অনুভূতির মোড় ঘুরলেই না জীবনের মোড় ঘুরবে, তবেই না লেখার মোড় ঘুরবে। সব কি এত সোজা, বল বাসুন? লটারির মতো নম্বর মিললেই যদি বদলে ফেলা যেত জীবন, তাহলে কি ৯ মাস ৯ দিন সন্তানকে পেটে ধরতে হতো? তিল তিল রক্ত দিয়ে যে মা সন্তানকে বড় করেন, তিনিই কেবল হিসাব ছাড়া ভালোবাসতে পারেন—আর কেউ কি পারে জীবনের সেই বোধ অনুভব করতে?
আদর বাসুন
তোর মা
৬ ডিসেম্বর ২০১১
টরন্টো, কানাডা