শৈশব অভিযান

প্রতীকীছবি: শামীনূর রহমান
সূর্যও ঠিক মধ্যগগন ছুঁই ছুঁই। আমার আবার স্কুল শুরু হয় দুপুর ১২টায়। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্র পলায়ন করে পাঠশালায় যাওয়ার মতো কাপুরুষতা সেদিন দেখাতে পারলাম না।

জেলা শহর থেকে প্রায় শত মাইল দূরে, গাড়িতে ঘণ্টা তিনেক অস্থিমজ্জার ব্যায়াম সারার পর, আরও মিনিট তিরিশ পাঁকে-জলে পা মাড়িয়ে হাঁটার পর অবশেষে সেখানে পৌঁছানো যায়। হাওয়া বদলের জন্য কোনো রোগী যদি এই জায়গায় আসতে চান, আমার বিশ্বাস, মধ্যভাগেই তাঁর ভ্রমণ-পরিক্রমা সমাপ্ত করে সোজা বাড়িতে ফেরার জন্য ছটফট করবেন। আর সেটাই তাঁর স্বাস্থ্যের পক্ষে মঙ্গলজনক।

তবে আমার জন্ম এখানেই। স্থানটিকে অজপাড়াগাঁ বললেও তার যথাযথ মহিমা পূর্ণ হয় না—বলতে পারেন, একুশ শতকের প্রথম দশক পর্যন্তও এটি সভ্যতার বিদ্যুতের রশ্মি থেকে বেশ সচেতনভাবেই দূরত্ব বজায় রেখে চলেছিল। মাঘের মধ্যরাতে শীতের তোয়াক্কা না করে আমার আবির্ভাব, সেই হিসেবে নিজেকে বেশ সাহসীই বলতে পারি। মাঘের শীতে বাঘ না ভয় পাক, এক লহমায় জন্মকালীন শীতলতা ভুলিনি।

বাবার অবশ্য এ অঞ্চলের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা। তাঁর মতে, এখানকার মতো উপাদেয় বায়ু আর সৃষ্টিশীল পরিবেশ আর কোথাও হতেই পারে না। তাঁর ধারণা, কুড়ি মাইলের বাইরের মানুষ আর আন্দামানবাসী বুর্জোয়ার মধ্যে তেমন তফাত নেই। একমাত্র এ অঞ্চলবাসীই যেন সভ্যতার শিখরে আছে। আমার অভিজ্ঞতা, যা কিনা কেবল সাড়ে তিন শ ক্রোশ দূরে রাজধানী ভ্রমণের সুযোগেই সীমাবদ্ধ, তা বাবার মতের সঙ্গে বিশেষ মেলে না। শূন্য ভাঁড়ারে অভিজ্ঞতা যা আছে, তাতে এই ‘শিখর’ আর পাঁচটা ধূলিমাখা মাঠের মতোই মনে হয়েছে।

আজ সেই সামান্য অভিজ্ঞতার ভান্ডারের সবচেয়ে সাহসিকতার গল্পটিই লিখতে বসেছি।

আমি তখন ক্লাস থ্রিতে পদার্পণ করেছি। হেমন্তকাল—গ্রামের দিক হওয়ায় শীত বেশ জাঁকিয়ে বসেছে। কুয়াশাও পড়েছে ভালোই। আমন ধানের খেত চারদিকে হলদেটে ছোঁয়া লেগেছে, তার মধ্যে খেতের নিচের মাটি শুকিয়ে গেলেও কেউ হেঁটে গেলে পায়ের ছাপ স্পষ্ট বোঝা যায়। সেখানে পাঠশালা খুলেছে শিয়াল পণ্ডিতমশাই। শিক্ষানবিশের আকাল পড়ায় সে নিজেই শিক্ষার্থী সংগ্রহে নেমেছে। গ্রামে হঠাৎ হট্টগোল শোনা গেলে বোঝা যায়, মহাগুরু শৃগালের নতুন শিষ্য বাড়ল।

গতকাল থেকে মায়ের কাঞ্চন রাঙা ডিম পাড়া মুরগিটি গায়েব। বুঝতে বাকি নেই যে সেটি পণ্ডিত মশাইয়েরই আস্তাবলে গেছে। আস্তাবল বলতে অবশ্য মাটির গর্ত, কিন্তু শিয়াল পণ্ডিতের নিজস্ব শিক্ষাপদ্ধতি অনুযায়ী সেটিই তাঁর ‘একাডেমি’।
বাবা বলেন, ‘শিয়াল হলো প্রকৃতির সবচেয়ে বুদ্ধিমান শিক্ষক। এমনি এমনি তো আর শিয়ালকে সবাই পণ্ডিত বলে না।’
মা অবশ্য এ মতের ঘোর বিরোধী। বাবার সব মতেই মায়ের বিরোধী মত অবশ্যম্ভাবী। এবারও তাই, ‘তোর বাবার মাথায় যে কী আছে, কে জানে! শিয়াল আবার শিক্ষক হয় নাকি? নিজে যেমন, ভাবনাও তেমন!’—মায়ের এই দার্শনিক মন্তব্যটি বাবার মতো আমারও বিশেষ পছন্দ নয়।

আরও পড়ুন

বেশ সকাল, সবে মক্তব থেকে ফিরছি। রোদের তেমন দেখা নেই, কুয়াশাও বেশ ভালো। বাড়ির সামনের মাঠের কোণে ছোটখাটো জটলার মতো। জিজ্ঞাসু চোখে এগিয়ে গেলাম।
গিয়ে দেখি—এ কী কাণ্ড! শিয়াল শিকারের বিশাল আয়োজন। দুটো বুড়ো, প্রায় লোমহীন ন্যাড়া কুকুর, আর জনা বিশেক মানুষ, হাতে লাঠিসোঁটা। গতকাল থেকে গ্রামের মোড়লের লাল মোরগটি পাওয়া যাচ্ছে না। সেই মোরগ আবার মোড়ল পেয়েছে শ্বশুরবাড়ি থেকে—অর্থাৎ পারিবারিক ঐতিহ্য আর মানসম্মানের প্রশ্ন। আর শিয়াল সেটিই বাগিয়ে নিয়ে চলে গেল! তাই আজ আর শিয়ালের নিস্তার নেই।

মোড়লের বাড়ির কাজের লোক, নামটা ঠিক মনে নেই, যিনি আমাদের এই মহাযুদ্ধের অনানুষ্ঠানিক সেনাপতি, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ পরিকল্পনা বলছেন। তাঁর গলার স্বর বেশ গম্ভীর। ‘শোনো ভাইসব’, তিনি ফিসফিস করে প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘শিয়াল হলো কুত্তার চেয়েও চালাক। ওরা জানে কখন পালাতে হয়। তাই আমাদের দুদিক থেকে ঘিরে ধরতে হবে।’

একজন সাহসী মহামানবের জন্য গ্রামের দৈন্য দিনে শিয়ালের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে যোগ না দেওয়াটা ঘোর লজ্জাজনক। তাই মক্তব থেকে ফেরার মাথার টুপি পকেটে গুঁজে যোগ দিলাম শিয়াল শিকারে। একটা আধশুকনো বাঁশের লাঠিও পেয়ে গেলাম—যুদ্ধের জন্য তৈরি।

গ্রামের বসতি খুব একটা ঘন নয়। বাড়িঘরগুলো বেশ দূরে দূরে। আর খালি জায়গায় গুল্মলতায় জঙ্গলের মতো ছেয়ে গেছে। শীতকালের আভাস শুরু হওয়ায় সাপের ভয় খুব একটা নেই, তবে কাঁটা ফোটার ভয়ে যথাসম্ভব সাবধানে পা মাড়াচ্ছি।
সেনাপতি মহোদয় আবার হুকুম জারি করলেন, ‘কেউ একা একা যাইয়েন না। দুইজন মিলে যান। শিয়াল আবার পাল্টা আক্রমণও করতে পারে।’

আমার সঙ্গী হলো নিয়াজ। ক্লাস ফাইভে পড়ে, আমার চেয়ে বছর দুই কি তিনেক বড়। তার হাতে একটা ভাঙা লোহার তার প্যাঁচানো প্লাস্টিকের স্টিক। আমার বাঁশের লাঠির চেয়ে অবশ্যই উন্নত অস্ত্র—যাহোক, কার্যসিদ্ধি হলেই হলো।

আমরা গেলাম পুকুরপাড়ের বাঁশঝাড়ের দিকে। নিয়াজ বলল, ‘শিয়াল নাকি বাঁশঝাড়ে লুকিয়ে থাকতে পছন্দ করে।’
‘কেন?’ আমি জানতে চাইলাম।
‘কারণ, বাঁশঝাড়ে অনেক গোপন পথ থাকে। একদিক দিয়ে ঢুকে অন্যদিক দিয়ে বেরিয়ে যেতে পারে। একদম বুদ্ধির গোড়ায়!’

সূর্যও ঠিক মধ্যগগন ছুঁই ছুঁই। আমার আবার স্কুল শুরু হয় দুপুর ১২টায়। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্র পলায়ন করে পাঠশালায় যাওয়ার মতো কাপুরুষতা সেদিন দেখাতে পারলাম না।
কিন্তু কী জানি, বিশেষ কোনো দ্রুতগামী দূতের মারফত আমার শিয়াল শিকারের কাহিনি মায়ের কান অবধি পৌঁছে গিয়েছিল। এর ফলাফল যা হলো, তা শিয়াল শিকারের চেয়েও ভয়াবহ। বাড়ি থেকে লোক পাঠিয়ে আমাকে ডেকে আনল না, আদতে চ্যাং-দোলা করে তুলে আনা হলো।

প্রায় নমনীয় বাঁশের চিকন বেতের উত্তম-মধ্যম পড়ল পিঠে। ফলে সপ্তসুরের বিভিন্ন স্কেলের সুর প্রকম্পিত হতে লাগল আমার স্বরে। সেই সুর অনেকটা হুক্কাহুয়ার মতোও প্রতিধ্বনিত হলো কি না, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার পাঠকের ওপরই রইল।
সেদিন শিয়াল পণ্ডিতের সন্ধান পাওয়া যায় কি না, তা আমার আর জানা হলো না। তবে আমার ঠিকই দুপুরের গ্রাম্য পাঠশালায় যেতে হয়েছিল।

অগ্রহায়ণ মাসের মধ্যভাগ। ধানকাটা শেষ। প্রান্তরজুড়ে ধূসর এক চাদর যেন ছেয়ে আছে। বার্ষিক পরীক্ষার ফল প্রকাশ হলো। ছয় বিষয়ের তিনটিতেই তেত্রিশের কম পেয়ে স্যারদের বিশেষ কৃপায় আমি পরবর্তী ক্লাসে উত্তীর্ণ হলাম। তাতে আমার একগাল প্রস্ফুটিত হাসি।
হেডস্যার বললেন, ‘তুই তো দেখি ইংরেজিতে শূন্য পেয়েছিস!’
আমি গর্বিত গলায় বললাম, ‘স্যার, পাস তো করেছি।’ আমার মতে, জয় জয়ই।

এরপর বেশ কয়েক বসন্ত গেল। মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে উচ্চমাধ্যমিকে। কলেজ ভর্তির জন্য ছুটলাম চাকচিক্যময় জেলা শহরে। লন্ঠনের ক্ষীণ আলো নেই। দেয়ালে সুইচ চাপলে আলোর ঝলকানি। গলা আর গাড়ির ঝঞ্ঝাট। দম ফেলার ফুরসত নেই কারও।

সেই যে বেরিয়ে আসা বাড়ি থেকে। আর কখনো সেই ছোটবেলার মতো বাড়ি ফেরা হয়নি আজ অবধি। আমার অভিজ্ঞতার ভান্ডার এখন সাড়ে তিন শ ক্রোশের গণ্ডি পেরিয়েছে, কিন্তু শীতকালের কুয়াশামাখা সেই শিয়াল শিকারের অপ্রকাশিত অভিযানের স্মৃতিটুকু আজও অমলিন।

সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, সিলেট