পথ এখনো শেষ হয়নি

অলংকরণ: আরাফাত করিম

অবিরাম বৃষ্টি ঝরছে তিন দিন ধরে। বৃষ্টির টুপটাপ শব্দ ছাপিয়ে যাচ্ছে ঝিঁঝি পোকার একঘেয়ে বিলাপ, আর দূরের পাহাড়ি পাখির বিষণ্ন সুরে—যেন প্রকৃতি নিজেই শোকে মুহ্যমান। পাহাড়ের খাড়া ঢালে মেঘ আর বৃক্ষের নিঃসঙ্গ যুগলবন্দী চিরে দাঁড়িয়ে আছে জীর্ণশীর্ণ একটা পাতার ছাউনির ঘর। বারান্দার সরু মাচায় বসে হুঁকোয় টান দিচ্ছে জহরং সরদার। বয়স ষাটের ঘরে। মুখের রেখা গভীর খাঁজে কাটা। চোখের দৃষ্টি কঠিন, চেহারায় অনিশ্চয়তার ছাপ স্পষ্ট।

উঠানের এক পাশে খেলছে দুই নাতি মংলু আর শান্তি। মংলুর বয়স আট, শান্তির ছয়। দুজনের মাথায় জটপাকানো চুল, গায়ে কাদার ছোপ। মংলুর গায়ে রংচটা লাল গেঞ্জি। শান্তির পরনে হাঁটু অবধি ছেঁড়া প্যান্ট, খালি গা। দরিদ্রতার কৌলীন্য তাদের নেই। জহরং হুঁকোয় গভীর টান দিল। ধোঁয়ার সঙ্গে বেরিয়ে এল ভারী দীর্ঘশ্বাস। ঘরে খাবার ফুরিয়ে গেছে। টানা তিন দিনের বৃষ্টিতে কাজও বন্ধ। জঙ্গল থেকে শাক আর বুনো ইঁচড় তুলে এনে সেদ্ধ করে খাওয়াচ্ছে। জুম চাষের সামান্য জমিটুকু আছে পাহাড়ের গায়ে। কিন্তু এই বর্ষায় সেখানে কিছু ফলবে না বোধ হয়। বছর দুয়েক আগে ছেলে আর ছেলের বউ কালাজ্বরে কাতরে মরেছে। মারা যাওয়ার আগে বলেছিল, ‘বাপু মোর তো শেষ, পোলা মাইয়াডারে তুই দেহিস।’ এখন শুধু দুটি নাতিকে নিয়ে তার ভাঙা সংসার।

হঠাৎ উঠানে শোরগোল উঠল। মংলু আর শান্তির মধ্যে মারামারি। শান্তি একটা আমলকী পেয়েছিল, মংলু কেড়ে নিয়েছে। শান্তি কামড় দিয়েছে মংলুর হাতে। নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে ধাক্কা দিতেই শান্তির ছোট্ট দেহটা ছিটকে পড়ল কাদায়। শোরগোল শুনে হুঁকো মুখ থেকে তুলে বারান্দা থেকেই হাঁক দিল জহরং। তার কর্কশ কণ্ঠস্বরে দুজনই থমকে দাঁড়াল। শান্তি কাঁদতে কাঁদতে দাদার কাছে এসে দাঁড়ায়। মংলু মাথা নিচু করে সরে গেল খানিকটা অপরাধীর মতো।

বিকেলে বৃষ্টি কিছুটা কমল। জহরং ঠিক করল সমতলের হাটে যাবে। জঙ্গল থেকে সংগ্রহ করা কিছু বনজ মধু আছে, আর সের দুয়েক বুনো কাঁঠালবিচিও। সেগুলো বিক্রি করতে পারলে কিছু চাল কেনা যাবে, কিছু নুন, হয়তো একটু তেল। মংলু ও শান্তিকে ডাকল। দুজনই খুশিতে লাফিয়ে উঠল। হাটে যাওয়া মানে মিঠাই খাওয়ার সুযোগ। কাদায় পথ পিচ্ছিল। জহরং শক্ত হাতে দুই নাতিকে ধরে রাখল। পাহাড়ের প্রতিটা বাঁক চেনা তার। তবু এই দুটি প্রাণের জন্য ভয় হয়।

ঘণ্টা দুয়েক হাঁটার পর তারা হাটে পৌঁছাল। জহরং একটা পুরোনো বটগাছের নিচে তার সামান্য পসরা সাজিয়ে বসল। কিন্তু খদ্দের আসে না। একজন ব্যাপারী এসে এমন অপমানজনক দাম বলল যে জহরংয়ের মুখ কঠিন পাথরের মতো জমে গেল। কিন্তু কী করবে? বাড়িতে চাল নেই। বাধ্য হয়ে সামান্য টাকায় মধু আর কাঁঠালবিচি বিক্রি করল। পাঁচ টাকায় ছখানা বাতাসা কিনে দিল মংলু আর শান্তির হাতে। মুখে তৃপ্তির হাসি।

বাজার সদাই শেষে ফেরার পথে নামল বিপদ। আকাশ হঠাৎ কালো হয়ে এল। ঝড়, সঙ্গে প্রচণ্ড বৃষ্টি। গাছ নুয়ে পড়ছে। পিচ্ছিল পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে এগােনোও যাচ্ছে না। জহরং দ্রুত পা চালাল। শক্ত হাতে আঁকড়ে ধরল মংলু আর শান্তিকে। শেষ বাঁক, পেরোলেই পৌঁছে যাবে। প্রথমে মৃদু কম্পন, তারপর কানফাটানো শব্দ। পাহাড়ের একটা বিশাল অংশ ধসে পড়ল। পাথর আর কাদার স্রোত রাস্তা বন্ধ করে দিল। জহরং শিশু দুটিকে বুকে জড়িয়ে ধরে একটা বড় পাথরের আড়ালে আশ্রয় নিল। ঝড় থামল কতক্ষণ পর ঠাহর করতে পারল না। প্রকৃতি খানিকটা ক্ষান্তি দিলে, কাদামাটি ঠেলে বাড়ির দিকে এগোয়। তাদের প্রতিদিনের পথ উধাও। শুধু কাদা, পাথর, উপড়ে পড়া গাছের স্তূপ।

জহরং মরিয়া হয়ে দৌড়াল। দুহাতে দুটি জীবন্ত বস্তুকে টানতে টানতে বাড়ি পৌঁছে দেখল ধ্বংসলীলা। ঘরের দেয়াল ধসে গেছে, ভেতরে মাটি আর পাথরের স্তূপ। ঘর সম্পূর্ণ গিলে নিয়েছে পাহাড়। জহরং স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এখানে আর থাকা যাবে না। শহরে যেতে হবে। কাঁপা হাতে একটা পুঁটলি বাঁধল, মধু বিক্রির টাকায় কেনা আধা সের চাল, একটা পুরোনো কাঁথা, সঙ্গে অজস্র স্মৃতির ভার। মংলু আর শান্তির হাত দুটো শক্ত করে ধরল। সে শুধু তাকাল দূরের পথের দিকে, যে পথ সমতলে নেমে গেছে, যে পথ অজানার দিকে চলে গেছে, এক নতুন শুরুর আশায়।

তিনটি ছায়ামূর্তি ধীরে ধীরে, ক্লান্ত পায়ে এগিয়ে চলল। পেছনে পড়ে রইল জন্মভূমি। পথের দেবতা নীরবে দাঁড়িয়ে প্রসন্ন হেসে বলছেন, পথ তো মাত্র শুরু হলো। এই অবসন্ন দেহে পথপরিক্রমার ক্লান্তি দেওয়ার অবসর এখনো আসেনি। এ যাত্রা দীর্ঘ, অনন্ত।

শিক্ষার্থী, সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, সিলেট