অস্থির দুপুর

অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান

ঘড়িতে তখন বেলা ১১টা বেজে ২৫ মিনিট, ১২টা তখনো বাজেনি। রুপম নরসিংদী সরকারি কলেজ গেটের সামনে থেকে অটোরিকশায় উঠেছে, যাবে জেলা গণগ্রন্থাগারে। কলেজে এসেছিল প্রবেশপত্র তুলতে। কিন্তু অনার্স ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা শুরু হওয়ায় পরীক্ষার্থী ছাড়া আর কাউকে প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। গেটের প্রবেশপথে দাঁড়ানো দায়িত্বরত গণিত বিভাগের শিক্ষক নাঈম আহমেদ তাকে বলেছে, ‘১টার পর আসো, এর আগে পরীক্ষার্থী ছাড়া অন্য কেউ প্রবেশ করতে পারবে না।’ রুপম অনুরোধ করলেও শিক্ষক কোনো কথা শুনলেন না। সে ভাবল, এতক্ষণ কলেজ গেটের সামনে অপেক্ষা করার কোনো মানে হয় না। তা ছাড়া ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা বিরক্তিকর। এসব ভেবে সে লাইব্রেরিতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল।

সরকারি কলেজ থেকে বেশি দূরের পথ নয় পাবলিক লাইব্রেরি, অটোরিকশায় যেতে সর্বোচ্চ ৮-১০ মিনিট লাগে। যাওয়ার পথে মালাকার ডাক্তারের মোড়ে আরেকটা অটোরিকশা থেকে তার বন্ধু মাসুদ তাকে ডাক দিয়ে বলল, ‘কী রে রুপম, পরীক্ষা দিবি না? কোথায় যাচ্ছিস? আমাদের সিট তো মহিলা কলেজে পড়েছে। তুই উল্টো দিকে কোথায় যাচ্ছিস?’ অটোরিকশা থেকেই রুপম ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে চেয়ে বলল, ‘তুই যা, আমার একটা কাজ আছে, সেটা সেরে আসতেছি।’

আসলে রুপম আজকের পরীক্ষাটা দেবে না। এই সিদ্ধান্তটা সে দুই দিন আগেই নিয়েছে। তাই প্রবেশপত্র তুলতে আসেনি এত দিন। পরীক্ষা দিলে নিশ্চয়ই কেউ পরীক্ষার প্রথম দিনের কয়েক ঘণ্টা আগে প্রবেশপত্র নিতে আসে না। তার প্রস্তুতি তেমন নেই, সামনের বছর এই বিষয়ের পরীক্ষাটা দেবে ঠিক করেছে। পরবর্তী সব বিষয়ের পরীক্ষা দেবে কি না, এখনো সে সিদ্ধান্ত নেয়নি। তবে মনে মনে ঠিক করেছে, অন্তত ২টা বাদে সব কটিতে অংশগ্রহণ করবে।

রুপম জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নরসিংদী সরকারি কলেজে উদ্ভিদবিজ্ঞান নিয়ে অনার্স করছে। প্রতি বর্ষেই সে ২-৩টা করে ইমপ্রুভ পরীক্ষা দেয়। পাবলিক লাইব্রেরিতে যখন প্রবেশ করল তখন আকাশে অনেক রৌদ্র, ক্লান্তি লাগছে। ভেতরে ঢুকে ফিল্টার থেকে এক গ্লাস জল নিয়ে পান করল। সাহিত্যসম্পর্কিত বইয়ের আলমারি থেকে রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ বইটা নিল। চেয়ার টেনে একটা টেবিলে বসল বইটা নিয়ে। নিছক সময় কাটানো ছাড়া এই মুহূর্তে তার আর অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই। আগে প্রায়ই সে লাইব্রেরিতে আসত। এ কারণে পরিচিত কয়েকজন ইশারায় তাকে ডাকল। রুপম শুধু একবার মুচকি হাসি দিল, উঠে গিয়ে কারও সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না তার।

বই খুলে ‘হৈমন্তী’ গল্পটি পড়বে বলে স্থির করলেও পড়তে পারছে না। বারবার মনোযোগ হারাচ্ছে আর সদ্য প্রয়াত হওয়া নানার চেহারাটা চোখে ভাসছে। দুদিন আগেই তিনি মারা গেছেন। গত বছর বাবা যখন রাগারাগি করে বাড়ি থেকে বের করে দেয় রুপমকে, তখন নানা নাসির উদ্দিন মিয়াবাড়িতে জায়গা দিয়ে বলেছিল, ‘আমৃত্যু আমার বাড়িতে তুই থাকবি। তোকে এই বাড়ি থেকে কেউ বের করে দেবে না। আমি সব ব্যবস্থা করে রেখে যাব।’ রুপমের দুই মামাও অনেক খোঁজখবর রাখে। তাই মামিরা তেমন কিছু বলতে পারে না। তবে নানা মারা যাওয়ার পর রুপমের এখন আর ভালো লাগছে না সেই বাড়িতে থাকতে। কোথাও যাওয়ার আর জায়গা নেই বলে সে এখনো থাকছে।

‘হৈমন্তী’ গল্পটি আবার পড়া শুরু করল। কিছুক্ষণ পড়ার পর মনোযোগ হারিয়ে ফেলে। মায়ের কথা মনে পড়ছে। মা ক্যানসারের রোগী ছিলেন। হাইস্কুল থেকেই সে মাকে অসুস্থ হতে দেখেছে। দীর্ঘদিন বিছানায় পড়েছিল। রুপমের বাবা আবার বিয়ে করেছিল। তাই রুপম এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে একই এলাকায় মেসে থেকে পড়াশোনা করেছিল দীর্ঘদিন। মায়ের মৃত্যুর কয়েক মাস আগে মা-বাবার অনুরোধে বাড়িতে গিয়ে থেকেছিল। সৎমায়ের অবহেলা, কটুকথা সে নীরবে মেনে নিত শুধু অসুস্থ মায়ের মুখের দিকে চেয়ে। কিন্তু মায়ের মৃত্যুর পর বাবা মোজাম্মেল সাহেব কেমন জানি বদলে গেল। হঠাৎ একদিন ঘুম থেকে দেরিতে ওঠা নিয়ে রাগারাগি শুরু করে দিল তার সঙ্গে। একটা সময় বলেই ফেলল, ‘আমার সামনে থেকে দূর হ, তোর মুখ আর দেখতে চাই না। মায়ের সঙ্গে সঙ্গে তুইও মরলি না কেন? আমার বাড়িতে তোর আর জায়গা নেই।’ কোনো কূলকিনারা না পেয়ে সে নানাবাড়ি এসেছিল সেবার। তারপর থেকে এখানেই থাকে।

আরও পড়ুন

‘এই যে রুপম, কী অবস্থা? কত দিন পর লাইব্রেরিতে এলে, তা কোন বই পড়ছিলে?’ খুব ধীরে কথাগুলো বলল দীর্ঘদিনের পরিচিত বড় ভাই জুয়েল মিয়া। ওনার কথায় রুপমের হুঁশ ফিরে এল। বইয়ের পৃষ্ঠা থেকে চোখ তুলে ওপরে তাকিয়ে সালাম দিয়ে স্বল্পস্বরে কথা বলল কিছুক্ষণ। একটু পর বড় ভাইটি চলে গেলে, সে আবার পড়া শুরু করল। দুটি লাইন বারবার পড়ছে সে, ‘কী নির্মম সত্যে ও উদার আলোকে তাহার প্রকৃতি এমন ঋজু শুভ্র ও সবল হইয়া উঠিয়াছে। তাহা হইতে হৈম যে কীরূপ নিরতিশয় ও নিষ্ঠুর রূপে বিচ্ছিন্ন হইয়াছে এত দিন তাহা আমি সম্পূর্ণ অনুভব করতে পারি নাই, কেননা তাহার সঙ্গে আমার সমান আসন ছিল না।’

রুপমের মনে হচ্ছে সে গল্পের কিছুই বুঝছে পারছে না। বাংলা গল্প বুঝতে পারছে না—এমনটাও তো হওয়ার কথা না! বাংলা সাহিত্যের অনেক লেখকের লেখা পড়েছে। সবচেয়ে বেশি পড়েছে সমরেশ মজুমদারের। এই লেখকের অনেকগুলো গল্প ও উপন্যাস পড়েছিল। লাইব্রেরির অনেকেই তখন ঠাট্টা করে বলত, ‘তুমি কি সমরেশ মজুমদারকে নিয়ে পিএইচডি করবা নাকি?’ সে কোনো উত্তর দিত না, একটু হেসে আবার পড়ত। তখন সময়গুলো খুব কঠিন ছিল তার জন্য। মায়ের অসুস্থতা, নিজের পড়াশোনা, সৎমায়ের দুর্ব্যবহার, প্রেমের সম্পর্কের টানাপোড়েন ইত্যাদি ব্যাপার থেকে মুক্তি পেতে প্রায়ই সে লাইব্রেরিতে এসে সময় কাটাত বই পড়ে।

হঠাৎ চোখ গেল ঘড়ির দিকে, বেলা ১টা বাজে। গল্পটি তখনো পড়া শেষ হয়নি। শেষ করার ইচ্ছেও হচ্ছে না। মাথার মধ্যে নানা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। সম্প্রতি এলাকার একটা হাইস্কুলে অতিথি শিক্ষক হিসেবে জয়েন করেছে সে, সেখানেও পরীক্ষা শুরু আগামীকাল থেকে। আবার দুই মাস ধরে একই কলেজের একজন জুনিয়র মেয়ের সঙ্গে ভালো বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে তার। সেই সম্পর্কটা ঠিক কোন দিকে মোড় নিচ্ছে, তা সে বুঝতে পারছে না।

রুপম ভাবল, না, আর বসে থাকা যায় না, এবার উঠতেই হবে। কোনো কিছুই ভালো লাগছে না। কলেজে গিয়ে ডিপার্টমেন্ট থেকে প্রবেশপত্রটা নিয়ে আবার স্কুলে যেতে হবে। আগামীকাল থেকে সাময়িক পরীক্ষা শুরু, সিট নম্বর দেওয়ার দায়িত্ব তার। এখানে বসে সময় নষ্ট করার কোনো মানেই হয় না। কাজগুলো শেষ করতে হবে।

বইটা বন্ধ করে উঠে গেল রুপম। লাইব্রেরি থেকে বের হয়ে অটোরিকশায় উঠল। ডিপার্টমেন্টের বন্ধুরা সব পরীক্ষা দিচ্ছে হলে গিয়ে, আর সে ডিপার্টমেন্টে যাচ্ছে প্রবেশপত্র নিতে। এমন একটা দিন যে রুপম দেখবে, সেটা সে নিজেও কোনো দিন কল্পনা করেনি। মায়ের অসুস্থতা, পারিবারিক ঝামেলা, আর্থিক সমস্যার পরও পড়াশোনা নিয়মিত করার চেষ্টা করত। কিন্তু এখন সবকিছুই যেন অলীক মনে হচ্ছে। তবে ব্যাপারটা যেমনই হোক, রুপমের জন্য সেসব কিছুই না, সেসব পরিস্থিতি মেনে নিতে শিখতে চায়। তবু মনের মধ্যে অস্থিরতা কাজ করছে।

১০ মিনিটের রাস্তা যেন শেষ হচ্ছে না। রুপম সিটে বসার কিছুক্ষণ পরই ড্রাইভারকে বলতে লাগল, ‘ভাই একটু জোরে চালান না, আমার একটু তাড়া আছে।’ অটোরিকশাচালক বলল, ‘আরে ভাই সামনে যে ভিড় লেগে আছে দেখছেনই তো, কেমনে যামু কন!’

উপজেলা মোড়ের এই রাস্তায় ভালো যানজট লেগে গেছে। কিন্তু রুপমের যেন এই অপেক্ষা আর মাথায় আসা চিন্তাগুলো তার মেজাজ ঠিক থাকতে দিচ্ছে না। মাথা দিয়ে ঘাম ঝরছে, সে চুপ করে বসে থাকার চেষ্টা করছে।

হাজীপুর, নরসিংদী