ফসলের মাঠে জীবনের ছন্দ

ছবি: এআই/বন্ধুসভা

পৌষ মাসের এক শীতের ভোর। চারদিক কুয়াশার চাদরে ঢাকা। খালি চোখে কয়েক হাত দূরের বেশি কিছুই দেখা যায় না। গাছের পাতায় জমে থাকা শিশির টুপটাপ ঝরে পড়ছে। গ্রামময় নেমে এসেছে একধরনের নীরবতা, শুধু দূরে কোথাও শিয়ালের ডাকে ঘুম ভাঙে কারও কারও।

আলতাফ ভোররাতেই ঘুম থেকে উঠেছে। সারা রাত শীতের কনকনে হাওয়ায় বিছানায় শরীর গুটিয়ে শুয়ে ছিল। ভোরের আজানের সুর মসজিদ থেকে ভেসে আসতেই উঠে পড়ল। কুয়াশা ভেদ করে গোয়ালের দিকে গেল। গোয়ালে বাঁধা দুটি বলদ, কুণ্ডু আর কালা। গরুগুলোও শীতের কাঁপুনি সামলাচ্ছে। আলতাফ হাতে খড় ধরিয়ে দিল, একটু পানি ছিটিয়ে তাদের জাগিয়ে তুলল। তারপর কাঁধে বাঁশের লাঙল তুলে নিয়ে বেরিয়ে গেল মাঠের দিকে।

পথঘাট কাদা ও শিশিরে ভেজা। মাটির পথ বেয়ে হাঁটার সময় আলতাফের পায়ের নিচে মচ মচ শব্দ হয়। ভোরের নিস্তব্ধতার ভেতরে শোনা যায় নদীর ঘাটের দিকে অতিথি পাখির কিচিরমিচির। এরা দূরদেশ থেকে এসেছে, শীতকালে বিলে জল পেলে মনের আনন্দে খেলা করে।

আলতাফ মাঠে পৌঁছে গরু জোতা লাগিয়ে হালচাষ শুরু করল। মাটির গন্ধে ভরে উঠল চারদিক। শীতের ভোরের ঘন কুয়াশার ভেতরে কেবল গরুর ঘণ্টাধ্বনি আর লাঙলের টানার শব্দ প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। প্রতিটি দাগ কেটে যেতে যেতে জমি প্রস্তুত হয় বোরো ধানের চারা রোপণের জন্য।

এদিকে আলতাফের স্ত্রী মকবুলা উঠানে হাঁড়িতে ভাত বসাল। ভোরবেলা সে পিঠা বানায়—চালের গুঁড়ো দিয়ে পুলি, খেজুরের রসের পাটিসাপটা। কনকনে ঠান্ডায় গরম পিঠার ধোঁয়া ঘিরে ধরে উঠান। ছোট ছেলে রফিক পিঠার গন্ধে লোভ সামলাতে না পেরে কাছে এসে দাঁড়ায়। মকবুলা এক টুকরা গরম পিঠা হাতে দিয়ে বলে—
‘যাও, মাঠে তোমার বাপকে দিয়ে এসো।’

রফিক খুশিতে দৌড়ে চলে যায়। ধানখেতের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে দেখে আকাশে একটু একটু করে আলো ফুটছে। কুয়াশা সরে সূর্যের আভা উঁকি দিচ্ছে। সে মাঠে পৌঁছে দেখে বাবা হাল ধরছে, শরীর ঘামে ভিজে গেছে; যদিও শীতের কনকনে হাওয়া বইছে। রফিক হাঁপাতে হাঁপাতে বলে—
‘মা তোমার জন্য পিঠা পাঠাইছে।’
আলতাফ লাঙল থামিয়ে একটু বিশ্রাম নেয়। রফিক হাতে তুলে দেয় গরম পিঠা আর এক বাটি পায়েস। আলতাফ পিঠার গন্ধে মুখে হাসি ফোটায়। মাটির ওপর বসে খেতে খেতে বলে—
‘হ্যাঁরে, শীতের সকালে এর চাইতে মিষ্টি কিছু আর নাই।’

আরও পড়ুন

চারপাশে তখন আরও কৃষক মাঠে নেমেছে। কুয়াশার ভেতর একেকটা হালচাষের দৃশ্য যেন প্রকৃতির আঁকা ছবি। কেউ গান গায়, কেউ হা-ডু-ডু খেলতে থাকা বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে মজা পায়। এভাবেই শুরু হয় একেকটা শীতের সকাল।

আলতাফ আবার হাল ধরল। গরুগুলো ধীরে ধীরে জমি চষে চলে। দূরে দেখা যায়, আরেক কৃষক ধোঁয়া ওঠা চুল্লির পাশে দাঁড়িয়ে খেজুরের রস সংগ্রহ করছে। রসের হাঁড়িতে বাষ্প ওঠে, চারদিকে ভেসে যায় মিষ্টি ঘ্রাণ। গ্রামীণ জীবনের শীতকাল যেন এক অপূর্ব উৎসব—খেজুরের রস, পিঠা, শিশির আর কুয়াশার ভেতর গরুর লাঙল।

এভাবে সকাল গড়িয়ে যায়। সূর্য একটু ওপরে উঠতেই কুয়াশা সরে যায়। জমির ওপর সূর্যের আলো পড়ে ঝিলমিল করে ওঠে। আলতাফ তখনো হাল চালাচ্ছে, কপালে ঘাম জমেছে। দূরে নদীর ঘাট থেকে ভেসে আসছে নৌকার দাঁড় টানার ছন্দ। জীবন যেন কেবল পরিশ্রম আর তার ভেতরে লুকিয়ে থাকা এক অদ্ভুত আনন্দ।

সূর্য যখন আকাশের মাঝ বরাবর উঠে আসে, তখন কুয়াশা অনেকটা কেটে যায়। মাঠের চারপাশে আলোর ঝলকানি ছড়িয়ে পড়ে। শিশিরভেজা ধানের জমিতে ঝিলিক ধরে। শীতের সকাল ক্রমে দুপুরের দিকে গড়াতে থাকে।

আলতাফ তখনো জমিতে ব্যস্ত। ভোর থেকে অবিরাম হালচাষ করতে করতে শরীর যেন ক্লান্তিতে ভেঙে পড়তে চাইছে, কিন্তু কাজ থামানোর অবকাশ নেই। বোরো ধানের জমি সময়মতো তৈরি না হলে চারা রোপণ দেরি হয়ে যাবে। ফসলের ফলন কমে আসবে।

এদিকে বাড়িতে মকবুলা দুপুরের ভাত রান্নায় ব্যস্ত। হাঁড়িতে সেদ্ধ হচ্ছে নতুন ধানের ভাত, পাশে ডাল ফোড়ন দিয়ে ফুটছে। শর্ষের তেলে ভাজা ছোট মাছের গন্ধে উঠান ভরে উঠছে। খেজুর গুড় গলিয়ে তৈরি হচ্ছে মিষ্টি দই। শীতের দুপুরে এমন খাবারের স্বাদই কৃষক-পরিবারের কাছে এক প্রকার উৎসব।
মকবুলা বড় মাটির হাঁড়িতে ভাত সাজিয়ে রাখে, সঙ্গে ডাল, মাছভাজা আর কচু শাক। ছেলে রফিককে বলে—
‘যাও বাবা, খাওয়ার থালা মাঠে নিয়ে যাও।’

রফিক আবার দৌড় দেয় মাঠের পথে। সঙ্গে তার ছোট বোন রহিমাও যায়। দুজনের হাতে কাঁসার থালা আর বাঁশের তৈরি ঢাকনা ঢাকা হাঁড়ি। হাঁটতে হাঁটতে তারা দেখে, মাঠের একপাশে কয়েকজন কৃষক হালচাষ থামিয়ে বসে কথা বলছে। কেউ কেউ আবার মাটির ঢিবির ওপর বসে বাঁশি বাজাচ্ছে।

আলতাফ তখন জমির একপাশে গরু ছেড়ে বিশ্রাম নিচ্ছে। রফিক আর রহিমা কাছে গিয়ে হাঁড়ি নামিয়ে দেয়। মকবুলার রান্না করা গরম ভাতের গন্ধ চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। আলতাফ মাটিতে বসে হাতে ভাত মাখতে শুরু করে।
‘বাপ, আজ ভাত বেশ মজা হবে, মা দইও বানাইছে।’ রহিমা মিষ্টি হেসে বলে।
আলতাফ খেতে খেতে মাথা নেড়ে বলে—
‘তোমাদের মায়ের রান্নার মতো স্বাদ কেউ দিতে পারবে না।’

মাঠের অন্য কৃষকেরাও তখন খাওয়ার জন্য বিরতি নেয়। কেউ বাড়ি থেকে নিয়ে আসা পিঠা খাচ্ছে, কেউ খেজুর রস দিয়ে ভাত গুলছে। কেউ–বা একে অপরকে ডেকে নিয়ে বসে খাচ্ছে একসঙ্গে। গ্রামের এই মিলনভোজের দৃশ্য সত্যিই দেখার মতো। খাবারের মাঝেই গল্প চলছে—ফসলের দামের হিসাব, নতুন সারের কথা, গ্রামের হাটের আলাপ, কিংবা কারও পরিবারের সুখ-দুঃখ।

মধ্যাহ্নভোজ শেষ হলে কৃষকেরা একটু শুয়ে নেয় জমির ধারে। কেউ গাছের ছায়ায় শুয়ে থাকে, কেউ–বা মাটির ঢিবির ওপর মাথা রেখে আকাশ দেখে। শীতের দুপুরে সূর্যের গরম আলো শরীর ভেদ করে আরাম দেয়। চোখ বুজলেই মনে হয় যেন স্বপ্ন এসে ভর করে।

অন্যদিকে, মকবুলা দুপুরের খাবার শেষে আবার কাজে ব্যস্ত। উঠান ঝাঁট দেয়, গরুর জন্য খড়-পানি সাজায়। ঘরে ছোট মেয়েকে খাওয়ায়, কাপড় ধোয়, আর দুপুর গড়ালে বসে সুতা কাটে। কিষানির জীবনও কম কষ্টের নয়—সকালের রান্না, দুপুরের ভাত, বিকেলে আবার পিঠা কিংবা রাতের খাবার, সবই তার হাতে সামলাতে হয়।

দুপুর ফুরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে আবারও মাঠে কাজ শুরু হয়। কৃষকেরা জমিতে পানি তোলার যন্ত্র চালায়, কোথাও সেচের খাল খোঁড়ে। আলতাফ গরু দিয়ে আবার জমি চষতে শুরু করে। কপাল বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ে, শরীর ভিজে যায়। তবু তার চোখে স্বপ্ন—ফসল উঠলে সংসার চলবে, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা হবে, সংসারে অভাব থাকবে না।

এদিকে রফিক আর রহিমা মাঠের ধারে খেলায় মেতে ওঠে। তারা কুয়াশা ভেজা ঘাসে দৌড়ে বেড়ায়, কচি বাঁশ কেটে বাঁশি বানায়, কাগজের ঘুড়ি ওড়ায়। মাঝেমধ্যে বাবার কাছে গিয়ে দেখে, কেমন করে গরু দিয়ে হাল টানা হয়। শিশুমনের ভেতরে জমে ওঠে গ্রামীণ জীবনের শিক্ষা—কঠোর পরিশ্রমই জীবনের মূলমন্ত্র।

বিকেলের দিকে সূর্যের রং পাল্টাতে শুরু করে। লালচে আলো পড়ে ধানের জমির ওপর। গরু তখন চরে বেড়ায় মাঠের কিনারায়। কৃষকেরা ধীরে ধীরে কাজ গুটিয়ে বাড়ির পথে হাঁটা শুরু করে। কারও হাতে কাঁধে লাঙল, কারও হাতে পানির কলসি। দূরে কোথাও আবার হাট বসেছে—সেখানে বিক্রি হচ্ছে সবজি, চাল-ডাল, কিংবা খেজুরের গুড়।

আলতাফ গরু নিয়ে মাঠ থেকে বের হয়। রফিক-রহিমা মিলে গরু সামলায়। তিনজন একসঙ্গে বাড়ির পথে হাঁটে। রাস্তার দু’পাশে তখন লাল সূর্যের আলোয় ভরে ওঠে আকাশ। শীতের বিকেল যেন গ্রামীণ জীবনের ক্লান্তি ধুয়ে দিয়ে নতুন শান্তি এনে দেয়।

সন্ধ্যা নামছে ধীরে ধীরে। পশ্চিম আকাশে লাল আভা মিশে যাচ্ছে শীতের কুয়াশায়। মাঠ থেকে কৃষকেরা গরু নিয়ে একে একে বাড়ি ফিরছে। কারও হাতে বাঁশের লাঠি, কারও হাতে লাঙল। শিশুদের হাসি-খেলার শব্দে চারদিক মুখর। কেউ কেউ গরুর পিঠে বসে বাঁশি বাজাচ্ছে, আবার কেউ গরুর পেছনে হাঁটতে হাঁটতে গান ধরছে।

আলতাফও গরু নিয়ে ফিরছে। রফিক এক হাতে লাঠি আরেক হাতে দড়ি ধরে রেখেছে, যেন বাবার কাজ ভাগ করে নিচ্ছে। রহিমা ছুটে ছুটে বাবার পাশে আসছে, আর গরুর ঘণ্টাধ্বনির টুংটাং শব্দ যেন গ্রামীণ সন্ধ্যার এক বিশেষ সুর তৈরি করছে।

বাড়ি পৌঁছে গরুগুলোকে গোয়ালঘরে বেঁধে দেওয়া হয়। খড়ের গাদার পাশে রাখা হয় তাজা খড়, আর বড় হাঁড়িতে পানি। গরুগুলো তখন ক্ষুধার্ত মুখে খড় খেতে শুরু করে। আলতাফ হাত বুলিয়ে দেয় তাদের গলায়, যেন দিনের কষ্ট ভুলে গিয়ে তাদেরও শান্তি মেলে।

উঠানে তখন রহিমার ব্যস্ততা। হাঁস-মুরগিকে ডেকে খোঁয়াড়ে ভরে দিচ্ছে। শীতে শেয়ালের উৎপাত বেশি, তাই আগেভাগেই সব সুরক্ষা নিতে হয়। মাটির চুলায় তখন রাতের ভাত বসানো হয়েছে। হাঁড়িতে শর্ষের তেলে কচি মুলা ভাজা হচ্ছে, পাশে ডাল ফুটছে। মাঝেমধ্যে সেই গন্ধ চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে।

বিকেলের শেষ আলোয় মকবুলা উঠানে বসে পাটকাঠি কেটে জ্বালানি বানাচ্ছে। তার হাতে যেন কোনো ক্লান্তি নেই। সকাল থেকে নিরন্তর কাজ করলেও মুখে এক চিলতে হাসি। মাঝেমধ্যে বাচ্চাদের ডেকে বলে—
‘যাও, একটু খেজুর রস খেয়ে এসো। ঠান্ডা রস, শরীর গরম রাখে।’

রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে গ্রাম যেন এক অন্য রূপ নেয়। খড়ের গাদার পাশে ছোট ছোট কুপি জ্বলে ওঠে। কারও উঠানে হারিকেনের আলো, কোথাও আবার কেরোসিন ল্যাম্প। শিশুরা উঠানে বসে গল্প শোনে। বড়রা একত্রিত হয়ে গ্রামের খবরাখবর নিয়ে আলোচনা করে। শীতের রাতের আড্ডা যেন গ্রামীণ জীবনের এক চিরন্তন আনন্দ।
আলতাফ গোয়ালঘরে কাজ সেরে এসে উঠানে বসে। মকবুলা তখন কাঁথা সেলাই করছে। পুরোনো কাঁথায় নতুন কাপড় জুড়ে নিচ্ছে। শীতে গরম কাপড়ের কদর সবচেয়ে বেশি, তাই কিষানি নিজের হাতে পরিবারের জন্য কাঁথা বানায়। বাচ্চারা পাশে বসে কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে থাকে।

রাতের খাবার সাজানো হলে সবাই একসঙ্গে বসে। কাঁসার থালায় ভাত, পাশে ডাল, মুলা ভাজা, খেজুর গুড় আর পেঁয়াজ। শীতের রাতে এমন খাবার যেন স্বর্গীয় স্বাদ এনে দেয়। আলতাফ সন্তুষ্ট মনে বলে—
‘মকবুলা, তোমার রান্নায় দিনশেষে সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়।’
খাওয়া শেষ হলে শিশুরা মায়ের পাশে ঘুমিয়ে পড়ে। কাঁথার ভেতর গা ঢেকে তারা স্বপ্নে চলে যায়। উঠানে তখন শুধু রাতের নিস্তব্ধতা। বাঁশঝাড়ে বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ, দূরে কুকুরের ঘেউ ঘেউ, আর মাঝেমধ্যে শেয়ালের হুক্কা-হুয়া ডাক।

আলতাফ শুয়ে শুয়ে আকাশের তারা দেখে। তার চোখে ভেসে ওঠে দিনের শ্রম, মাঠের ঘাম, জমির সবুজ ধানগাছের স্বপ্ন। পাশে শুয়ে থাকা মকবুলাকে বলে—
‘দেখো গো, আল্লাহ চাইলে এ বছর ফসল ভালো হবে। গোলা ভরে যাবে ধানে। আমাদের সন্তানেরা সুখে থাকবে।’
মকবুলা মৃদু হাসে। তার কাছে এই সামান্য কথাই জীবনের সব সুখ। তাদের সংসার সচ্ছল হোক বা না হোক, এই শ্রম আর ভালোবাসার বন্ধনই তাদের জীবনের আসল সম্পদ।

রাত গভীর হয়। চারপাশ নিস্তব্ধ। কুয়াশার চাদরে মোড়া গ্রাম ঘুমিয়ে পড়ে। কৃষক-পরিবারের নিঃশব্দ শ্বাস–প্রশ্বাস মিশে যায় প্রকৃতির নীরবতায়। আর শীতের সকালের অপেক্ষায় থাকে নতুন দিনের ফসলি স্বপ্ন।

উপদেষ্টা, ময়মনসিংহ বন্ধুসভা