একটা সময় সমুদ্রকাহিনি লেখা হতো ঢেউয়ের রঙে আর মেঘ-বায়ুর সুরে। সে রকম এক রোববার বিকেলে, বঙ্গোপসাগরের নীল আয়নায় যখন সূর্য হেলে পড়ছিল, তখনই একটি ছোট্ট হৃদয় পৃথিবীতে তার প্রথম শ্বাস নিল।
নাম ইলতুৎমিশ। নামটা এসেছে তুর্কি ভাষা থেকে; যার অর্থ ‘রাজ্য রক্ষক’। সে এক বিরাট কাহিনি।
সাগরে মাছ শিকার করতে যাওয়া জেলেদের মুখে মুখে যে গল্প মহাকাশ অব্দি ডালপালা ছড়িয়েছে।
ইলতুৎমিশের মা ছিল এক প্রবল শক্তিধর ও কোমল হৃদয়ের ডলফিন। নাম ইয়ানো ইলতুৎমিশ। সে ভারত মহাসাগরে বাস করত। ইয়ানো ইলতুৎমিশ বহু সাগর–মহাসাগর পেরিয়ে বিশ্বমণ্ডল ভ্রমণ করেছে। সাগরজলের নানা প্রাণীর সঙ্গে তাঁর সখ্য। ইলতুৎমিশের জন্মের দিন বিভিন্ন মহাসাগর থেকে ছোট প্রাণীরা মেঘের মতো এসেছিল তাকে দেখতে। দিনটি সমুদ্র-উৎসবের মতো ছিল। কিন্তু যখন ইলতুৎমিশ নয় মাসের ছোট্ট গড়নের প্রাণী, যখন তার মা ইয়ানো তাকে প্রথমবার বঙ্গোপসাগরের সাদুপানি-মিশ্র মোহনায় নীল জলে নিয়ে আসে। সেই মোহনায় যেখানে নদীর পানির উজান স্রোত বঙ্গোপসাগরের লীলা ছুঁয়ে যায়।
এক.
ইলতুৎমিশ এখন নয় মাস বয়সের ছোট্ট গড়নের ডলফিন–শাবক। সাধারণত এই বয়সের ডলফিন–শাবকেরা মায়ের আশপাশে থেকে সাঁতার শেখে। এ সময় তারা মায়ের কাছ থেকে সাঁতারের কৌশল, শিকার ধরা, লাফানো ইত্যাদি শিখে থাকে, যাকে বলে ‘এশেলন সুইমিং’। শিশুর শারীরিক শক্তি বৃদ্ধি ও শত্রুদের হাত থেকে রক্ষার জন্য মা ডলফিনরা শাবককে নিরাপদ কোনো স্থানে নিয়ে যায়। ইলতুৎমিশের মা ইয়ানো বঙ্গোপসাগরের বড় বড় জাহাজের ঢেউ ও উত্তাল সমুদ্রের ঝাপটা থেকে তাকে রক্ষা করতে মোহনা অঞ্চলে নিয়ে আসে। মোহনায় এসে ইলতুৎমিশ প্রথমে শুধু মায়ের সঙ্গে খেলার মতো করে লাফালাফি করত। নদী ও সাগরের মোহনায় ভেসে ওঠা বুদবুদ নিয়ে নাচানাচি, স্রোতের সঙ্গে খেলা, ছোট ছোট মাছের সঙ্গে দৌড়াদৌড়ি করে সময় কাটিয়ে দিত।
ছোট্ট শাবকের এসব খেলাধুলা দেখে ইয়ানো হাসত আর তার কণ্ঠের ইকোলোকেশন শব্দে ইলতুৎমিশকে সঙ্গতিশীলতা শেখাত। কখন কোন দিকে স্রোত, কোথায় গভীরতা বদলে গেছে, কোন জায়গায় ছায়া পড়ে আছে, সেসব সম্পর্কে উপলব্ধি করতে শেখাত। ইলতুৎমিশের এসব শেখার চেয়ে কৌতূহল বেশি। সে জানতে চেয়েছিল, কেন এমন ভিন্ন ভিন্ন জলের রং? ইয়ানো সহজ ভাষায় বুঝিয়ে বলত, ‘দেখো, সামনে নদীর পানি মৃদু মিষ্টি। সমুদ্রটা নোনা; এখানে দুটি পানির মিশ্রণ হয়, এটাকে বলে মোহনা। এখানে মাছেরা বিশ্রাম নেয়।’ ইলতুৎমিশ সেই মিশ্র জলে ছোট ছোট মাছের সঙ্গে লুকোচুরি আর সামুদ্রিক কাঁকড়ার সঙ্গে নানা রকম খেলায় মেতে ওঠে। এসবই যেন তার নতুন পৃথিবী।
দুই.
ইলতুৎমিশ সামুদ্রিক কাঁকড়া আর ছোট মাছেদের সঙ্গে যখন খেলছিল, ওই সময় মা ইয়ানো একবার মোহনার কাছাকাছি চলে আসে। ইয়ানো বহু বছর পর মিঠা পানিতে এল। সে একবার ভুস করে পানির ওপরে গলা তুলে শ্বাস নেয়। এ সময় দেখল, মোহনার খুব কাছেই একঝাঁক বকপাখি ডানা মেলে বিশ্রাম নিচ্ছে। নোনা পানির উজান স্রোতে কচু ফুল ভেসে আসছে। সেখানে মরা কোনো পশুর শরীরকে কেন্দ্র করে কাকদের মেলা বসেছে। দূরে তেলবাহী একটি জাহাজ দাঁড়িয়ে আছে। এসব জাহাজে করে তেল আসে আর ছোট ছোট জাহাজে করে সেই তেল বন্দর হয়ে মানুষের কাছে চলে যায়। ইয়ানো ভাবে, উন্নয়নের নামে এত জ্বালানি পুড়িয়ে মানুষ আসলে কী করে?
মোহনার কাছে কচু ফুল আর পাখিদের মেলা ছাড়াও আরও কিছু অদ্ভুত জিনিস দেখা যেত। সেটা হলো প্লাস্টিক ও বোতল। মানুষের ব্যবহৃত এসব প্লাস্টিকজাত বস্তু উজানের স্রোতে ভেসে আসে আর মোহনায় জমে নদী ও সাগরকে ভাগাড় করে তোলে। ইলতুৎমিশ প্রথমে এসব প্লাস্টিকের জিনিসকে খেলনা মনে করত। একদিন সে আর লাল কাঁকড়ার দুই শাবক মিলে একটা প্লাস্টিক ব্যাগের ভেতরে ঢুকে লুকোচুরি খেলছিল। ইয়ানো তাকে বলেছিল, ‘শোনো বাচ্চা ইলতুৎমিশ, এগুলো মানুষের ব্যবহৃত জিনিস। মানুষ থেকে যত বেশি দূরত্ব রাখবে, ততই ভালো। আজ কৌতূহল থেকে দেখছ, খেলছ, সেটা ঠিক আছে। কিন্তু মানুষ থেকে সাবধান।’
ছোট্ট ইলতুৎমিশ এসব প্লাস্টিকের ভেতর খেলাঘর পেয়ে খুশি ছিল। মায়ের উপদেশ সে খেয়াল করেনি। ইলতুৎমিশ প্লাস্টিকের ভেতরে ঢুকে খেলছিল।
হঠাৎই ঢেউয়ের বুকে একটা অদ্ভুত দাগ ছড়িয়ে পড়ে। চকচকে কালো সেই দাগ, ঝাবরানো তেলের বুদ্বুদ চারদিকে মিশে যায়। তেলজাতীয় পদার্থ জলে ছড়িয়ে পড়লে সেটা পাখির ডানার মতো সিলক তৈরি করে। এসব দেখে ইয়ানো ভয় পায়। কারণ, সে জানত যে এটা বিপদ।
তিন.
ইলতুৎমিশ তখনো প্লাস্টিকের ব্যাগে লুকোচুরি খেলছিল। কালচে, ঘন ও দুর্গন্ধযুক্ত তেল স্রোতে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে তাকে ঘিরে ফেলে। হঠাৎ চারদিক অন্ধকার হয়ে আসে। ইয়ানো অন্ধকার ভেদ করে ইকোলোকেশন শব্দযন্ত্র ব্যবহার করে ডাকে, ইলতুৎমিশ! ইলতুৎমিশ!! ইয়ানোর সেই ডাক শুধু একটা সরু সংকেত হয়ে ধ্বনিত হয়। পলিথিনে আটকে পড়া ইলতুৎমিশের পথ চিনে সেই আওয়াজ পৌঁছায় না। ইয়ানো কাঁপতে থাকে; সে গুমড়ে ওঠে। ইকোলোকেশনের মাধ্যমে শেষবারের মতো সে ডাক দেয়, ‘ইলতুৎমিশ’। একবার, দুবার, বারবার। কিন্তু তেলে ঢেকে যাওয়া স্রোত শব্দকে এবং ইয়ানোর শরীরকে দুর্বল করে দেয়। এদিকে এক সপ্তাহ যায়, দুই সপ্তাহ যায়। ইলতুৎমিশ প্লাস্টিকের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। তার ‘মা, মা’ ডাক ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে আসে। ইয়ানো পেছনে স্রোত ধরতে থাকে। সে আকাশে পাখিদের কাছে সাহায্য চায়, কাছাকাছি থাকা কচ্ছপ, সামুদ্রিক প্রাণী ও মানুষের কাছে সংকেত দেয়। কিন্তু একটি বড় তেলবাহী জাহাজ যেখানে কাজ করে, সেখানে মানুষজন ছোট ছোট অনেক বিষয় নজরে আনে না। তারা বুঝতেই পারে না যে মোহনায় কী ঘটছে।
একদিন গ্রামের ছেলে রুমি মোহনায় মাছ ধরতে গিয়ে দেখে, নদীতে তেল ভাসছে। নদীতে তেল দেখে রুমি চিৎকার করে এলাকাবাসীকে ডাকতে থাকে। এলাকাবাসী মোহনায় এসে তেল সংগ্রহ করার সময় প্লাস্টিকের ব্যাগে আটকানো ইলতুৎমিশকে দেখতে পায়। পরে ডা. নীলকে খবর দেওয়া হয়। ডা. নীল ছিলেন রুমির স্কুলের বিজ্ঞানশিক্ষক। তিনি দ্রুত কয়েকজন গ্রামবাসী ও মৎস্যজীবীর সাহায্য নিয়ে ছোট নৌকা বানালেন; সেই নৌকা নিয়ে ছুটে গেলেন মোহনায়। ইয়ানো এসে তাদের পথ দেখাল। পলিথিন ও তেল দিয়ে শিশু ইলতুৎমিশের দেহ আটকে আছে। জেলেরা প্লাস্টিক টানতে চেষ্টা করে। কিন্তু প্লাস্টিক ভেঙে গেলে ইলতুৎমিশের দেহ আরও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে ডা. নীল জানান।
রুমি চোখে পানি নিয়ে এগিয়ে আসে। সে প্লাস্টিকটা কেটে ফেলার জন্য একটি ধারালো ছুরি নিয়ে আসে। ইলতুৎমিশের ক্ষতি না করে প্লাস্টিক কাটার সব চেষ্টা করা হয়। কিন্তু প্লাস্টিক জড়ানো ও তেলের সংমিশ্রণের ফলে ইলতুৎমিশের শরীর শক্ত হয়ে ছিল। প্রকৃতি ও মানুষের অদ্ভুত এক রহস্যে সেদিন ডা. নীল, স্কুলছাত্র রুমি ও জেলেদের সব চেষ্টা সার্থক হতে পারেনি। কয়েক সপ্তাহ খাবার না পেয়ে ইলতুৎমিশ দুর্বল হয়ে পড়ে। একসময় ক্ষুধায় ছোট রাজ্য রক্ষকের মৃত্যু ঘটে। ডা. নীল ইলতুৎমিশের শরীর মোহনায় ভাসিয়ে দেন। এ সময় জেলে–বউরা কান্নায় ভেঙে পড়ে। ইয়ানো শেষবার সন্তানের দেহ স্নেহে জড়িয়ে ধরে এবং ইলতুৎমিশের শরীরকে জলের ওপরে ভাসিয়ে মোহনায় কয়েক চক্কর দেয়। পরে ধীর ও কম্পমান শিস দিতে দিতে মোহনায় ডুব দেয়।
চার.
ইলতুৎমিশের দেহ নিয়ে পানিতে ডুব দেওয়ার পর মা ইয়ানো ডলফিন আর মুখ দেখায়নি। তরুণ শিক্ষক ডা. নীল চিরাচরিত ভাষায় গ্রামবাসীদের বোঝালেন, ‘তেল জলে ভেসে গিয়ে শ্বাসনালি হয়ে মাছের শরীরে প্রবেশ করে। এতে মাছ মারা যায়। প্লাস্টিক তেলের সঙ্গে মিশে ছোট কণায় ভেঙে যায়। মাইক্রোপ্লাস্টিক হয়। এগুলো মাছ ও কচ্ছপ খেয়ে মানবের খাবারের শৃঙ্খলে উঠে আসে। আজ ইলতুৎমিশ আমাদের শেখাল, আমাদের অসতর্কতায় সৃষ্ট প্রতিটি ছোট কাজ কীভাবে বড় প্রভাব ফেলে।’
গ্রামবাসীদের মধ্যে পরিবর্তনের ঢেউ লাগল। ইলতুৎমিশের স্মৃতিতে গ্রামবাসীরা শুরু করল মোহনা পরিষ্কার অভিযান। মৎস্যজীবীরা, স্কুলের শিক্ষকেরা, মহিলা সমিতি সবাই মিলে প্লাস্টিক সংগ্রহ করল। ডা. নীল সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের সেমিনার করলেন। রুমির নেতৃত্বে ‘ইলতুৎমিশ মেলা’ নামে একটি স্থানীয় জলবায়ু সংগঠন গড়ে উঠল। তারা মোহনায় ‘নো প্লাস্টিক ডে’ পালন করল।
ইয়ানো এখনো তার পুত্রকে ভুলতে পারেনি। সে প্রতিদিন মোহনায় এসে নিঃশব্দে গান গাইত, ইকোলোকেশন সুরে ইলতুৎমিশের নাম ধরে ডাকত। একদিন এক বৃদ্ধ তিমি মোহনায় এল। নাম তার দরিয়া। ইলতুৎমিশের সমুদ্রযাত্রা সাঁতার অনুষ্ঠানেও দরিয়া এসেছিল। দরিয়া ছিল ইয়ানোর পুরোনো বন্ধু। সে ইয়ানোকে ইলতুৎমিশের মৃত্যুর কারণ হিসেবে মানুষের ব্যবহৃত প্লাস্টিককে দায়ী করল। সে বোঝাল, ‘ছোট্ট ইলতুৎমিশ নিজের জীবন দিয়ে হাজারো প্রাণের রক্ষক হয়ে উঠেছে। তার নাম এখন কেবল তোমার একার নয়। এটা সাগরের সব জীবের কাছে এক পরিচিত নাম।’ ইয়ানো প্রথমে অনিশ্চিত ছিল, কিন্তু পরে বুঝল যে ইলতুৎমিশের স্মৃতি মানুষকে কতটা বদলে দিয়েছে।
পাঁচ.
ইলতুৎমিশ এক রাতে সূর্যাস্তের পর বঙ্গোপসাগরের নীল সরলীতে আলোর ঝিলিক হয়ে হাজির হলো। সে আর শারীরিক দেহে নেই। কিন্তু তার ইকোলোকেশন থেকে আসা সুর এখন সারা মোহনাকে স্পর্শ করে, একধরনের কম্পন তৈরি করে। সাগরপাড়ের মৎস্যজীবীরা বলাবলি শুরু করল, রাতের কোনো এক সময় তারা ছোট একটা সাদা চামড়ার আভা ঢেউয়ের ওপর নেচে উঠতে দেখেছে। ইলতুৎমিশ ফিরে এসেছে।
ইলতুৎমিশের আত্মা একটা নীল বুদ্বুদে পরিণত হয়ে মোহনায় ছড়িয়ে পড়ল। সেই বুদ্বুদ ধীরে ধীরে প্লাস্টিককে ঘিরে ফুল হয়ে ফুটে উঠল। সমুদ্রের জীব ও মানুষের মধ্যে নতুন বন্ধুত্ব হলো। এভাবে বছর গড়াল, ইলতুৎমিশের নাম সাগরপাড়ের জেলেদের মুখে মুখে গল্প হয়ে রইল।
আর ইয়ানো? সে এখন বয়সে বুড়ো হয়ে গেছে। কিন্তু প্রতিদিনই সে মোহনায় এসে ডলফিনদের সঙ্গে খেলতে থাকে। লাল কাঁকড়ার বাচ্চা আর সামুদ্রিক ছোট ছোট মাছের শিশুদের সঙ্গে তার দিনের সময় কেটে যায়। রাতে ইলতুৎমিশের স্মৃতিতে মোহনায় গলা উঁচু করে একটুখানি গান গায় সে। সেই গানে শুরুতে কষ্ট, পরে গৌরব ফুটে উঠত। ইলতুৎমিশের জন্য গর্ব করতে করতে ইয়ানো গান থামিয়ে চুপ হয়ে থাকত।
সাবেক সভাপতি, কুড়িগ্রাম বন্ধুসভা