চিঠি
বাসুন বারোতে (পঞ্চম পর্ব)
চিঠিটি আমার একমাত্র ছেলেকে উদ্দেশ করে লেখা। এই চিঠি যখন লিখি, তখন তার বয়স ছিল ১১ বছর। বর্তমানে সে ২৪ বছরের তরুণ।
বাসুন,
এই বেলা আবার তোকে লিখতে বসলাম। আসলে একটা জীবনযাপনই তোকে লিখছি বলেই যা যা করি, লিখতে বসার আগে সেটাই এ রোজনামচায় চলে আসে।
‘মোরাল কারেজ নেভার ফেইলড’, আত্মবিশ্বাস কখনো পরাজিত হয় না।
মিশেল হুসেইন নামের এক তরুণী বিবিসি ওয়ার্ল্ড নিউজে মহাত্মা গান্ধীর ওপর ধারাবাহিক প্রতিবেদন করছেন বেশ কিছুদিন ধরে। প্রিয় নিউজ চ্যানেল বিবিসি। যেটুকু সময় পাই এ চ্যানেলটাই দেখি। সেখানেই দেখছিলাম গান্ধীর জীবনী।
একটা দেশ গড়ে ওঠে কত কিছুর ভেতর দিয়ে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম বড় হতে থাকে ইতিহাসের ধারাবাহিকতা দেখে দেখে। মানুষ সারা জীবনে কত কত বিষয়ের মুখোমুখি হয় প্রতি মুহূর্তে। কতটুকু নেয় সে নিজের জীবনে? কতটুকু গ্রহণ করে নিজের জীবনে? কোথা থেকে ব্যক্তিমানুষের ভালোমন্দের বোধ তৈরি হয়?
যুক্তরাষ্ট্রে একটি সমসাময়িক গবেষণায় বলা হয়েছে, পরিবার থেকে একটা বয়সের পর বাচ্চারা খুব কমই গ্রহণ করে। মানুষ নাকি বেশি গ্রহণ করে বাইরে থেকে। স্কুল, কলেজ, বন্ধু, ইউনিভার্সিটি, কর্মক্ষেত্র—বিশেষ করে ২১ থেকে ২৮ বছর বয়স পর্যন্ত মানুষ যুক্তি দিয়ে বিবেচনা করে; সত্যিকার মানসিক মনোবল তৈরি করে এ সময়ের ভেতরেই।
মিশেল গতকাল সিরিজে দেখাচ্ছিলেন নারায়ণ নামের একজন ৮৫ বছর বয়সী মানুষকে, যিনি নিজে গান্ধীকে দেখেছেন। নারায়ণের বয়স যখন ১০-১২ বছর, তখন গান্ধী ৭৫ বছরের। নারায়ণের বাবা ছিলেন গান্ধীর সহকারী। নারায়ণ ছোটবেলায় দেখেছেন তাঁর বাবাকে গান্ধীর পাশে পাশে। সেই সুবাধে নারায়ণকে গান্ধী কখনো আদর করেছেন, কখনো কোলে তুলে নিয়েছেন। কী অবাক, সেই বালক নারায়ণ আজ গুজরাটে গান্ধী আশ্রমের দেখাশোনা করছেন। নারায়ণের ভেতরে গেঁথে আছে গান্ধীর জীবনদর্শন।
অবাক হয়ে ভাবি, এমন লিডার কি জন্মেছে আমার দেশে?
আমি তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি। কেবল রংপুর থেকে ঢাকায় এসেছি। ১৯৮০ সালের শুরুর দিকে হবে হয়তো।
আপন বড় মামা, মানে তোর কালো নানাভাই ছাত্রজীবনে জাসদ ছাত্রলীগ করতেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পর মামাদের একটা বড় দলকে দেশের বাইরে যেতে হেল্প করেন তৎকালীন নেতারা, মানে আ স ম আবদুর রব ও মেজর জলিল ছিলেন আমার মামাদের লিডার। বড় মামা জার্মানি থেকে দেশে ফেরেন ১৯৮০ সালে।
স্পষ্ট মনে পড়ে, জলিল মামার (বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিল) বড়মগবাজারের বাসায় গিয়েছিলাম বড় মামার সঙ্গে, উনি তখন কেবল দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন।
সেই কালো কালো দাড়িসমেত পাঞ্জাবি পরা মানুষটা এখনো আমার চোখে জ্বলজ্বলে হয়ে ভাসে। আমি ওনার দোতলা বাড়ি দেখে বললাম, ‘ওমা, আপনার এত বড় বাড়ি–গাড়ি কেন? আপনি না নেতা! আপনি তো অনেক বড়লোক? বড়লোক কি নেতা হয়?’ এ রকম কিছু এলোমেলো কথা। জলিল মামা আমাকে ধরে বলেছিলেন, ‘পাগলি ভাগনি আমাদের, তোকে বড় হলে মেয়েদের লিডার বানিয়ে দেব।’
কী অদ্ভুত জীবন, জানিস বাজান! পরে জেনেছিলাম বড় মামা জলিল মামার কাছে গিয়েছিলেন ব্যবসার লাইসেন্স বানানোর জন্য। মাত্র এক-দেড় বছর হবে, আমার বড় মামা ব্যবসায় নেমে টাকা কাকে বলে সেটা দেখালেন। আর ওই ছাত্রজীবনের আদর্শ? ওসব কথায় বড় মামা পরবর্তী জীবনে একটা হাসি দিতেন। যে হাসির অর্থ আমি একেক বয়সে একেক রকম করে বুঝেছি।
কোথায় আদর্শ বাস করে?
বড় মামাদের কাছে দেশ স্বাধীনের পরের যে গল্প শুনেছি সেখানে তো কেড়ে খাওয়ার ইতিহাস। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পড়েছি তখন কী দেখলাম? আজকে দ্বিধাহীনভাবে যদি বলি তাহলে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির শিক্ষক আনু মুহাম্মদ স্যার ছাড়া তো কাউকে শিক্ষকই বলা উচিত না।
আজকের বাংলাদেশের শিক্ষকেরা কি শিক্ষক, নাকি ঠিকাদার ব্যবসায়ী? হয়তো আমিই ভুল বলছি। সরদার ফজলুল করিম স্যারের মতো আর একজন ত্যাগী মানুষের নাম কি আমি মনে করতে পারি এখনো?
সারাজীবনে সৎ থাকার পর একজন কলেজ টিচার আমার বাবা বলেছিলেন—মাত্র ৯ বছর আগের কথা বাসুন, আমি তখন বাবার বাসায় থাকি। বাবা বললেন, ‘তুমি এনজিওতে কাজ করো লুনা। তুমি যদি তাদের কাজ নিয়ে প্রশ্ন তোলো, তুমি কোথাও কাজ করতে পারবে না।’
আমি অবাক, বাবা কী বলছেন এসব!
বাবা সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়ে তখন বছর দুয়েক হলো এনজিওতে কাজ করছেন। প্রায় ৫৬ বছর সরকারি চাকরি করে দুই বছরে বাবা যা বুঝলেন, আমি তার আগে সাত বছর এনজিওতে কাজ করেও সেটা বুঝলাম না।
এক বছর পরে আমি বিদেশ চলে আসি। বিদেশে এসে কী দেখলাম?
বাংলাদেশ নামক দেশটার সবগুলো পলিটিক্যাল লিডার, ব্যবসায়ী, নামীদামি শিক্ষক, অর্থাৎ বাংলাদেশকে ধর্ষণকারী সবগুলো মানুষের ছেলেমেয়েরা বিদেশে থাকে। দেশের বারোটা বাজিয়ে তাঁরা নিজেদের ছেলেমেয়েদের কানাডা–আমেরিকায় পুষছেন। এই কি আদর্শ আমার দেশের? এ দেখেই কি আমাদের দেশে প্রজন্ম গড়ে উঠবে? বিবেকবান প্রজন্ম?
জীবনে বোধ হয় একটাই ভালো কাজ হলো বাবু—তুই খুব কাছে থেকে দেখলি না কত কত নোংরামি আর ইতরামি দেখে দেখে তোর মায়ের জীবনটা গড়ে উঠেছিল।
কিসের ফেসবুক, কিসের মিডিয়া? আমি হলফ করে বলতে পারি, বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম কেউ কাউকে একমুহূর্তের জন্য বিশ্বাস করে না। আজকের আধুনিক ছেলেমেয়েরা সবার আগে অবিশ্বাস করে নিজেকে। কারণ, তারা বড় হচ্ছে একটা প্রতিযোগিতার ভেতর, যেখানে টাকাই বড় অস্ত্র। ভালোবাসা বা নীতিকথা সেখানে মূর্খের বচন।
আর আমার মতো ছাপোষা তুলনামূলক সৎবাবা–মায়ের ছেলেমেয়েরা, যারা কোনো রকমে পাঁচ–ছয় বছর চেষ্টা করে বিদেশে এসেছি; তারা ছুটির দিনে বিদেশ থাকা এনজয় না করতে পারার অক্ষমতা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশের জন্য ব্লগে বাংলা লেখে। দেশের ভালো কেন হলো না, এ নিয়ে কথা বলে নিজেদের ভেতর কেঁদে কেঁদে ফেরে।
আর যাঁরা আজকের বাংলাদেশের জন্য দায়ী তাঁরা এবং তাঁদের ছেলেমেয়েরা আমাদের এসব আদর্শবাদী কথা শোনার সময় পাবেন না। কারণ, তাঁদের ছুটির দিনে অনেক কাজ থাকে। তাঁরা বাংলাদেশের পেছন মেরে যেসব টাকা জমিয়েছেন সেসব দিয়ে ছুটির দিন উপভোগ করতে বেরিয়ে যান।
জীবনে বোধ হয় একটাই ভালো কাজ হলো বাবু—তুই খুব কাছে থেকে দেখলি না কত কত নোংরামি আর ইতরামি দেখে দেখে তোর মায়ের জীবনটা গড়ে উঠেছিল। শেষ করার আগে মনে পড়ছে বাসুন, মানুষ নাকি ততক্ষণ রাগ দেখায় যতক্ষণ আশা থাকে। আসলেই কি তাই বাবু?
এই যে ছুটির দিনে তোকে সময় না দিয়ে টাইপ করে চলছি। আশার আলো কি খুঁজি আমি নিত্যই? নিশ্চয়ই খুঁজি, নইলে বাঁচি কী করে। আবার ফিরব তোর কাছে বাজান।
আদর বাসুন
তোর মা
১০ মার্চ ২০১২
টরন্টো, কানাডা