নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে চট্টগ্রাম শহরে আমার কিশোর বয়সেই বুঝতে শুরু করেছিলাম বাংলাদেশের দুজন কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ ও ইমদাদুল হক মিলনের জনপ্রিয়তা ঠিক কতটা! একেবারে রুপালি পর্দার তুমুল জনপ্রিয় নায়কদের থেকে কোনো অংশে কম ছিল না। নিকটাত্মীয়ের বিয়েবাড়ির অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানে দেখতাম উপহার হিসেবে দুজনের বই এসে ভরে যাচ্ছে। নবীন প্রেমিক তার ভালোলাগা মেয়েটির জন্য লাইব্রেরি থেকে অনবরত দুজনের বই তুলে এনে দিচ্ছে। প্রেমিকাও নাওয়া–খাওয়া ভুলে গোগ্রাসে অনবরত গিলে নিচ্ছে দুজনের রচনা। এমনই টান টান লেখা দুজনের কলমে উঠে আসে যে একবার পড়তে শুরু করলে শেষ না করে ছাড়া যায় না। এদিকে বিনোদন পত্রিকায় পড়ছি, গাড়ির কাচ নামিয়ে জনপ্রিয় লেখক তাঁর পাঠকদের অটোগ্রাফ দেন। যেখানে যান, পাঠকেরা মৌমাছির মতো ঘিরে ধরে। দুজনের রচনা নিয়ে নাটক, ধারাবাহিক, চলচ্চিত্রও কম হয়নি। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক যে জনপ্রিয়তার মধ্যগগন থেকে হুমায়ূন আহমেদকে চলে যেতে হয়েছে অকালে।
ইমদাদুল হক মিলনের ‘শ্রাবণ জ্যোৎস্নায়’ উপন্যাসকে সুন্দর চলচ্চিত্রায়িত করেছেন বিশিষ্ট পরিচালক আবদুস সামাদ খোকন। এই বর্ষীয়ান পরিচালক বেশ ধর্মপ্রাণ একজন মানুষ। সাধারণত আমরা দেখি, কবি, লেখক, সাহিত্যিক, পরিচালকেরা অধিকাংশই প্রগতিশীল ধারার হয়ে থাকেন। কেউ ঘোষিত নাস্তিক হন, কেউ ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করলেও ব্যক্তিগত ধর্মাচরণ আড়ালেই রেখে দেন। প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিগত সত্তাকে অবশ্যই সম্মানের সঙ্গে বরণ করা উচিত। আবার ধর্মপ্রাণ মানুষের সঙ্গেও কিন্তু সৃজনশীল সত্তার কোনো বিরোধ নেই। ধর্ম তো ধারণ করার জন্য। ধর্মপ্রাণ মানুষের মনও খুবই কোমল, সংবেদনশীল হয়। আর হয় বলেই প্রেম, প্রীতি, ভালোবাসা, মনের আনন্দ, হৃদয়ের বেদনা তাঁরাও গভীরভাবে অনুভব করতে পারেন। যে কারণে আবদুস সামাদ খোকন ‘শ্রাবণ জ্যোৎস্নার’ পরতে পরতে হৃদয় তোলপাড় করা ভালোবাসা আর অনাবিল সৌন্দর্যকে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন। যেন ধ্যানমগ্ন সাধকের অন্তরের নির্জন সৌন্দর্য পরিস্ফুটিত হয়েছে। ধর্মহীন মানুষের প্রগতিশীল পথের সঙ্গেও ধর্মপ্রাণ মানুষের এই মতের কোনো বিরোধ নেই। কারণ, এ ধরনের সৃজনশীল ধর্মপ্রাণ মানুষও ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কারকে বর্জন করেই নিজের মতো প্রগতিশীল হয়ে উঠতে পেরেছেন।
ক্যামেরা দিয়ে কবিতা বুনে চলার মতো একটা চলচ্চিত্র ‘শ্রাবণ জ্যোৎস্নায়’। অভিনেত্রী প্রার্থনা ফারদিন দীঘির জন্যও এই চলচ্চিত্র যেন গ্রামবাংলার দীঘিতে ফোটা ফুল হয়ে ফুটেছে। সুন্দরী দীঘি অন্তর নিঃসৃত অভিনয়ের সৌন্দর্যে ভরিয়ে দিয়েছেন এই চলচ্চিত্র। ভালোবাসার নিবেদনে মোহিত করেছেন। পরিচালক সামাদের কল্পনায় দৃশ্যবুনন চিত্রনাট্য, সংলাপ অবশ্যই প্রসংসার যোগ্য। আসাদুজ্জামান মজনু লেখক ও পরিচালকের কল্পনাকে বাস্তবের ক্যামেরায় ক্যানভাসে আঁকা ছবির মতো ধারণ করেছেন। এই কল্পনার দৃশ্যগুলো ধারণ করার জন্য উপযুক্ত জায়গা খুঁজে নিতে ও ধরে ধরে দীর্ঘ সময় চলচ্চিত্রায়ণ পর্ব চালিয়ে যেতে প্রযোজক তামান্না সুলতানা বাজেটের দিক থেকেও কোনো রকম কার্পণ্য করেননি। আমরা ঘরের নারীদের বলি লক্ষ্মী। লক্ষ্মীরা শুধু অর্জিত টাকাপয়সা সঠিক খাতে যাবতীয় খরচপত্র সামলে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করেন না, ভান্ডারে সুনিশ্চিত ভবিষ্যৎকেও গচ্ছিত রাখেন। তেমনি ঘরের লক্ষ্মীরা যদি চলচ্চিত্র প্রযোজনায় আসেন, অবশ্যই এই শিল্পজগৎটিও সমৃদ্ধ হবে।
রবীন্দ্রনাথের ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে…’ ইংরেজি অনুবাদের আবৃত্তি, দৃশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সুন্দর ব্যবহার করা হয়েছে। অন্য অনেক মন ছুঁয়ে যাওয়া কবিতার কলিও বারেবারে ঘুরে ফিরে এসেছে। কবিতার এই আলোকমালা ঘটনা, পরিস্থিতি ও পরিবেশ অনুযায়ী দৃশ্যকে প্রাণবন্ত করে তুলেছে। শিল্পের সঙ্গে শিল্পের সাঁকোর এই কৃষ্টিকে সাধুবাদ জানাতে হয়। বিশিষ্ট সংগীতশিল্পীদের কণ্ঠে গাওয়া রবীন্দ্রসংগীতের ব্যবহারও অতুলনীয়। মনির খানের গাওয়া ‘ভবপারে লও আমারে বাইয়া...’ গানটিও ভালো লাগে। এই গানের কথা লিখেছেন সাধক পরিচালক নিজে। সংগীত পরিচালনা করেছেন মিল্টন খন্দকার এবং বিনোদ রায় দাস।
প্রবাসী বাঙালি ব্যস্ত তরুণ নাবিল, বাংলাদেশের গ্রামের সহজ সরল পরোপকারী অনাথ ছেলে শুভ ও শহুরে সংস্কৃতিমনস্ক কন্যা মৌকে নিয়ে একটি ত্রিকোণ প্রেমের ছবি ‘শ্রাবণ জ্যোৎস্নায়’। প্রকৃত মনের মানুষ খুঁজে পাওয়ার একটি বাস্তবিক দ্বন্দ্ব, মানুষের অন্তর্নিহিত স্বরূপ চিনতে পাওয়ার সংঘাত, জীবনের প্রকৃত লক্ষ্য নির্ধারণের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, প্রেম-প্রেমহীনতা, চিরকালীন প্রেমের যন্ত্রণা, বিরহ এবং ভালোবেসে দীর্ঘ সন্ন্যাস যাপনের ছবিও।
কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কবিতায় ‘উদাসী সঙ্গম’-এর কথা লিখেছিলেন। তাঁরও একটা আক্ষরিক রূপ উন্মোচিত হলো এখানে। শ্রাবণ পূর্ণিমার নির্জন জ্যোৎস্না আলোকিত নদীর চরে প্রেমিক যুগলের মনের সঙ্গম। দীঘি এবং গাজী আব্দুন নূরের অসাধারণ অভিনয় এই চরের দৃশ্যে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। দীঘি বাঙালির রোমান্টিক চেতনার নায়িকা, ফুল ও শিশুর মতো মুগ্ধতার আবেশ ছড়ায়, তার মধ্যে অনাবিল প্রকৃতির স্নিগ্ধ রূপ, বৈচিত্র্যের আলো-ছায়া খেলা করে, আর গাজী আব্দুন নূরের চেহারার মধ্যে একটা সাধকসুলভ ভাব আছে। এই ছবিতে তিনি হয়ে উঠেছেন রোমান্টিক সাধক ও প্রেমিক, যা একই সঙ্গে পরিচালকের সৃষ্টি দর্শনের প্রতিফলনও বলা যেতে পারে।
এই চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন সুব্রত বড়ুয়া, বাপ্পা শান্তনু, মুনমুন আহমেদ, মাসুম বাশার, মিলি বাশারসহ অনেকে। বিশিষ্ট অভিনেতা ও শিল্প নির্দেশক উত্তম গুহকে আমরা পেলাম অতিথি নিবাসের দেখাশোনা করার একটি চরিত্রে। এই ছবির শৈল্পিক সেট নির্মাণ চোখ জুড়ানো, মন ভোলানো। এক টুকরা সুন্দর বাংলাদেশকেও পরিবেশন করে এই ছবি। এককথায় ইমদাদুল হক মিলনের কাহিনির সার্থক রূপায়ণ। সম্পাদনায় ছিলেন মনিরুল ইসলাম।
হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত