চলচ্চিত্রের কাহিনির মধ্যে একটি মনস্তাত্ত্বিক মোচড়ও আছে। প্রিয়জনকে হারানোর ধাক্কা সহ্য করতে না পেরে গভীর মানসিক ক্ষত থেকে আত্ম পরিচয় ভুলে যাওয়া এবং প্রিয়জনকে ফিরে পাওয়ার মাধ্যমে অসুখ থেকে মুক্তি।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগের খ্যাতিমান সৃজনশীল পরিচালক নির্মাতাদের মধ্যে অন্যতম নারায়ণ ঘোষ মিতা। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে থেকেই তাঁর সৃজনশীলতার দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান আমলে নির্মিত ‘এতটুকু আশা’ চলচ্চিত্রটি আপামর বাঙালির হৃদয় ছুঁয়ে যায়। আবার দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ‘আলোর মিছিল’, ‘লাঠিয়াল’ প্রভৃতি চলচ্চিত্র নির্মাণের মধ্য দিয়ে তিনি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে পাকাপোক্ত জায়গা করে নেন।
১৯৬৯ সালে নির্মিত নারায়ণ ঘোষ মিতা তাঁর ‘নীল আকাশের নিচে’ চলচ্চিত্রটিতে গতানুগতিক ধারার বাইরে এসে মধ্যবিত্ত সমাজের পারিবারিক সম্পর্কের বন্ধন ও তৎকালীন সমাজের বাস্তব রূপকে প্রতিফলিত করেন। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোর মধ্যে বিভিন্ন শ্রেণিরূপ, শ্রেণিগত চিন্তাধারা অতি সহজ সরল কাহিনির চিত্রায়ণের মধ্য দিয়ে অনবদ্য রূপ দিতে পারেন নারায়ণ ঘোষ মিতা। এই শ্রেণি–সংঘাতের মধ্য থেকেও একদিকে সমাজের ক্ষতগুলো যেমন চিহ্নিত হয়, অন্যদিকে মানবিক মূল্যবোধকে জাগিয়ে তুলতে, সেই ক্ষত নিরাময়ে বদ্ধপরিকর নিবিড় সুপ্ত ভালোবাসার বন্ধনের চেতনাও প্রতিবাদী দৃষ্টিতে কাজ করে যায়।
‘নীল আকাশের নিচে’ চলচ্চিত্রটির কাহিনি, চিত্রনাট্য ও সংলাপ রচনা করেছেন ইসমাইল মোহাম্মদ। মূলত এক আকাশের নিচে বাস করা সত্ত্বেও মানুষের সামাজিক শ্রেণিগত বৈষম্য এখানে নিপুণভাবে উঠে আসে। বাঙালি সমাজে মধ্যবিত্তের রক্তের সম্পর্কের পারিবারিক বন্ধনগুলো কতটা গভীর হয়, শ্রেণিবিভাজন দূরে ঠেলে মানুষে মানুষে ভালোবাসার সম্পর্ক কতটা গাঢ় হয়, তা হৃদয়ের অতল ভেদ করে উঠে আসে।
মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ও গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা সুন্দর কিছু গান আছে। গানগুলোতে কণ্ঠ দিয়েছেন খন্দকার ফারুক আহমেদ, ফেরদৌসী বেগম, শাহনেওয়াজ বেগম, মাহমুদুন্নবী ও মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী। গানের অনবদ্য চিত্রায়ণ, নায়ক-নায়িকার চরিত্রের নিপুণ অভিনয়ে পুরোনো দিনের সাদাকালো ছবির সেই আমেজ ধরে রাখে, বর্তমান সময়ে বসেও যা কখনো মন থেকে মিলিয়ে যায় না। নায়কের চরিত্রে রাজ্জাক ও নায়িকা কবরীর চলচ্চিত্রে অন্তরঙ্গ দৃশ্যগুলো উত্তম-সুচিত্রাকে মনে করিয়ে দেয়। এভাবেই এপার বাংলা এবং ওপার বাংলা শিল্পের বন্ধনে কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়। নারায়ণ ঘোষ নিজেও একটা সময়ে কলকাতা এসে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন।
রাজ্জাকের দাদা মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন ট্যাক্সি ড্রাইভারের চরিত্রে অভিনয় করেছেন আনোয়ার হোসেন। তখনকার সমসাময়িক অনেক চলচ্চিত্রের মতো এই চলচ্চিত্রেও আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে জুটি বেঁধেছেন রোজী সামাদ। চলচ্চিত্রের তথাকথিত পার্শ্বচরিত্রগুলোর মধ্যেও যে সফল জুটি হতে পারে, কিংবদন্তি এই দুই শিল্পী প্রমাণ করে দিয়ে গেছেন। নিজের রক্ত ঘাম এক করে বাড়ির বড় ভাই ছোট ভাইকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করান। ভাবি এমনভাবে দেবরের দেখাশোনা করেন, যাতে তার পড়াশোনার ক্ষতি না হয়। মধ্যবিত্ত পরিবারের বড় ভাই ও ভাবিরাও যে মা–বাবার মতো, তা এখানে প্রতিফলিত হয়। মুখে রক্ত তুলে মরতে মরতেও বড় ভাই সংসারের জোয়াল কাঁধে নিয়ে, লড়াই ছাড়ে না। আনোয়ার হোসেনের জলজ্যান্ত তুখোড় অভিনয় বুকের ভেতরে ঝড় তোলে, রোজী সেই ঝড়ের দোলা আলোর পাশে আলোর নাচন আর রাজ্জাক এবং কবরীর প্রেম যেন সমুদ্রের অতল হৃৎস্পন্দন, হৃদয়ের গভীরে দাগ কেটে যায়।
বধূ নির্যাতনের সামাজিক ব্যাধির ছবি ধরা পড়ে। নারীরা শুধু পুরুষের দ্বারা নির্যাতিত হয় না, শাশুড়ি নামক পরিবারের এক বিপুল ক্ষমতাবান গৃহমন্ত্রী নারীর মাধ্যমেও নির্যাতিত হয় এবং সমাজে তা দীর্ঘদিন ধরে ঘটে আসছে। সমাজের ধনী শ্রেণির বিত্তশালী ক্ষমতাবান বাবা নিজের মেয়ের সঙ্গে একজন ট্যাক্সি ড্রাইভারের সম্পর্ক তৈরি হতে দেয় না। বিত্তবান পরিবার মেয়ের জন্য যে বিত্তবান সুপাত্র বেছে নেয়, সে আবার দুশ্চরিত্র, লম্পট। আর ট্যাক্সি ড্রাইভারের ভাই ট্যাক্সি ড্রাইভার বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে প্রথম হয়। খবরের কাগজে তার নাম এবং ছবি দেখে সবাই চমকে যায়। আমাদের সমাজে গোবরের মধ্যেও যে পদ্মফুল ফোটে, তা শুধু নজির নয়, সমাজ পরিবর্তনের একটি উজ্জ্বল দিকও।
চলচ্চিত্রের কাহিনির মধ্যে একটি মনস্তাত্ত্বিক মোচড়ও আছে। প্রিয়জনকে হারানোর ধাক্কা সহ্য করতে না পেরে গভীর মানসিক ক্ষত থেকে আত্ম পরিচয় ভুলে যাওয়া এবং প্রিয়জনকে ফিরে পাওয়ার মাধ্যমে অসুখ থেকে মুক্তি। ভালোবাসা পথ্যের মতো, মানুষের জীবনে ভালোবাসা গভীর অসুখের উপশম। এই অগ্নিপরীক্ষার অভিনয়ে রাজ্জাক এবং কবরী চিরকালের সফল নায়ক-নায়িকা।
অভিনয়ে আরও ছিলেন কবিতা, নারায়ণ চক্রবর্তী, স্বাতী খন্দকার, আলতাফ, সুলতানা, সাইফুদ্দিন, হাসমত, সিনা, এনাম আহমেদ, রব্বানী, কোরেশী, সাইদুর রাজু, রহিমা, রিনা, আনু, শাহজাহান, আফতাব চৌধুরী, অপর্ণা, স্বপ্না, মীরা, প্রতিমা, জিল্লু, হুমায়ুন, মেসবাহ, মাস্টার বাবলাসহ অনেকে। পরিবেশনায় ছায়াবাণী সংস্থা। যন্ত্রসংগীতে ছিল আলাউদ্দিন লিটল অর্কেস্ট্রা। আবহসংগীত করেছে লাহের ‘খ’ শাখা। প্রধান সহকারী পরিচালক ছিলেন হাসমতউল্লাহ খান, সহকারী সেখ ফজলুর রহমান, শিল্পনির্দেশক ছিলেন আবদুস সবুর, সম্পাদনায় বশীর হোসেন, চিত্রগ্রহণ করেছেন বেবী ইসলাম এবং সংগীত পরিচালনায় সত্য সাহা।
রাজ্জাকের চরিত্রের নাম মামুনুর, কবরীর চরিত্রের নাম তৃষ্ণা। নারায়ণ ঘোষ মিতার সৃষ্টির পৃথিবীতে নীল আকাশের নিচে ভুবন আলো করে দুজনে অসীম প্রেমের তৃষ্ণা জাগিয়েছেন এবং আবহমানকালের চলচ্চিত্রমোদী দর্শকের প্রাণের তৃষ্ণা মেটাতে সক্ষম হয়েছেন। এসব কারণেই এ ধরনের চলচ্চিত্রগুলো চিরকালের চলচ্চিত্র।
হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত