ব্যস্ততম নগরীর পথ ধরে অনেক দিন যাবৎ খুঁজে বেড়াচ্ছি এক চপলা মেয়েকে। বহু কষ্টে মনের খাতা ওলটাতে ওলটাতে তার নামটাও খুঁজে পেলাম। তানিমা—নামের সঙ্গে চেহারা ও স্বভাবের বিস্তর মিল। একেবারে কল্পতরুর মতো কোমল ও উদ্দীপ্ত। বহু অপেক্ষার পর ওর খোঁজে আবারও এসেছি কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে। উপচে পড়া ভিড়ে তন্নতন্ন করে খুঁজেছি বহুবার; কিন্তু এত মানুষ চোখে পড়ে, ওর মতো দ্বিতীয় কাউকে আর চোখে পড়ে না।
গত রাতে আয়োজন করে খুঁজতে বসেছি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, বিশেষ ফায়দা হয়নি। একবার ভাবলাম, তাহলে কি পুরো শহর তন্নতন্ন করে খুঁজে বের করতে হবে? স্বল্প বুদ্ধিতে যেন কুলাচ্ছে না আর। কিন্তু আমার ওকে খুব প্রয়োজন; একটা বিশেষ মুহূর্তে সে আমাকে প্রবলভাবে ঋণী করেছে। কেন মন হঠাৎ এত উন্মত্ত হয়ে উঠল, জানি না। সেদিন ওকে এত কাছে পেয়েও হারিয়ে ফেলার ব্যাপারটা খুব নিরর্থক বোকামি মনে হলো। একটা মানুষকে ধরে রাখার ঔদ্ধত্য এখনো তৈরি হয়নি দেখে নিজেকে ধিক্কার জানালাম। প্রতিজ্ঞা করলাম, যদি কোনো দিন ওর সঙ্গে দেখা হয়, সবকিছু বলে দেব। আমার হৃদয়ে যে কতটুকু খুঁড়েছে ওর সংস্পর্শ, তার গভীরতা দেখাব। হাজার মাইল দূর থেকে যে গভীর নিশ্বাসের আশ্লেষে জড়িয়ে নিচ্ছি বুকের ভেতর সব ওকে জানাব। তখন আমাদের মধ্যে আর দেয়াল থাকবে না। সব খোলাসা করে নেব শত জনমের পরিচিত মানুষের মতো।
সেদিন মুহূর্তে মেয়েটি যে কাছে এসে পুরো অস্তিত্বে তাণ্ডব ঘটিয়ে চলে গেল, আমি এটুকুই শিহরিত হইনি। কিন্তু এখন অষ্টপ্রহর ট্রেনের ঝনঝনানি শুনি, সঙ্গে ওর মিহি কণ্ঠ; সহসা পাশে এসে যখন বলেছিল, ‘এক্সকিউজ মি ভাইয়া, ওপাশের সিটটা আমার।’ ঘুমজড়ানো চোখে বিরক্তি নিয়ে ওকে সিটে বসার জায়গা করে দিলাম। আমিও নাদুসনুদুস হয়ে চোখ বুজে বসে আছি পাশের সিটে। আগের রাতের জার্নিতে একেবারে কাবু হয়ে গেছি, তাই শরীরকে নিস্তার দেওয়ার চেষ্টা করলাম। পাশে বসা মেয়েটি হন্তদন্ত হয়ে উঠে পড়ছিল ভুল বগিতে, পরে খুঁজতে খুঁজতে ঠিক জায়গায় এসেছে। ভেবেছিলাম পাশের সিট খালি যাবে, শুয়ে–বসে যাব পুরো পথ। তা আর হলো না।
মেয়েটি সহসা বলে উঠল, ‘হাই ভাইয়া, আমি তানিমা রহমান; ঢাকা যাচ্ছি। আর আপনি?’ বাধ্য হয়ে চোখ খুলে বললাম, ‘জি, আমি ইমন হাসান, আমিও ঢাকা যাচ্ছি।’ মনে মনে সৃষ্টিকর্তার নাম জপতেছি, যাতে ওদিক থেকে আর কোনো প্রশ্ন না আসে। কিন্তু পারলাম না; একতরফা প্রশ্ন করেই যাচ্ছে। আমার বাড়িঘর থেকে শুরু করে বউ-বাচ্চা পর্যন্ত গড়াল প্রশ্নবাণ। সৌজন্যের খাতিরে আমিও দু-চারটা কথা বলে বসলাম। তবে ওর মতো বিয়ে হয়েছে কি না, এমন বেখাপ্পা কিছু জিজ্ঞেস করে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ফেলে দিইনি। ওর হাতে বালা নেই, কানে ঝোলানো দুল নেই, তাই কিছুটা আশ্বস্ত হলাম যে ও কারও কাছে সমর্পণ করেনি এখনো। মধ্যম পর্যায়ের সাজুগুজুতেও অপূর্ব দেখাচ্ছে। কপালে একটা তিল আনাড়ি পরা টিপের মতো উজ্জ্বল হয়ে আছে নিঃসঙ্গ শুকতারার মতো।
বিরস মুখে সিটে হেলান দিয়ে ঘুমকে বরণ করার চেষ্টা করলাম, মধ্যখানে চলন্ত ট্রেনের চাকার বিকট ঝনঝনানিতে লন্ডভন্ড করে দিয়ে যায় আহূত চোখের ঘুম। চোখের সামনে পলক টেনে দিলে সবকিছু যেন আরও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। চোখ খোলা বাঁধার মধ্যে আর পার্থক্য থাকল না। নড়েচড়ে বসে আবার চেষ্টা করলে গাড়িতে থাকা হকারদের অযাচিত উৎপাত শুরু হয়। কোনো একটা খাবারের নাম ধরে একতালে দরাজ গলায় জপতে থাকে। একটু আগেও একজনকে ধমক দিয়ে সরিয়েছি পাশ থেকে। ইতস্ততভাবে পাশ ফিরে তাকালাম, এর মধ্যেই দেখি আমার সহযাত্রী ঘুমাচ্ছে।
ঘুমাচ্ছে, নাকি ভান ধরছে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। মোবাইল ঘড়ির দিকে তাকালাম, রাত তিনটা বেজে দশ মিনিট। ঘুমানোর সময় আমি চোখ খুলে রাখছি বলেই কি সে ঘুমাবে না? আবার চোখ বন্ধ করতেও ভয় হচ্ছে; কারণ, ঘুমের ঘোরে আমার মাথা ঢলে পড়ে। অপরিচিত মেয়েমানুষের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাব ভেবে ভালো লাগছে না। মনে মনে হাঁসফাঁস করতে করতে ভাবলাম এত চিন্তা কেন, অন্তত মেয়েটি একটু শান্তিতে থাকুক। ওর মুহূর্তটা সুন্দর কাটুক আর স্বপ্নের দেশে ঘুরে বেড়াক।
নিশ্চল নিশীথে আধখোলা জানালায় সজোরে বাতাস ঢুকছে, সঙ্গে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির পানি। মেঘ না চাইতে বৃষ্টির মতো আষাঢ়ী বৃষ্টিরও কোনো বিশ্বাস নেই। বাতাসে সহযাত্রীর চুল উড়ছে। ছড়িয়ে পড়ছে আমার মুখে ও বুকে। চুলের উদ্দাম নৃত্যে মোটেও বিরক্ত হচ্ছি না। ভোরের হিমেল হাওয়ায় ঘাসের ওপর জমে থাকা শিশিরবিন্দুর মতো বৃষ্টির ফোঁটা শোভমান হয়ে আছে ওর মুখে। শুধু একবার চেয়ে দেখলাম চেহারার দিকে; সদ্যোজাত শিশুটির মতো ঘুমোচ্ছে সে। একবার ওকে সোজা করে দিতে চাইলাম। ভাবলাম, যদি চোখ খুলে দেখে যে ওর স্নিগ্ধ চুলরাশি আমার হাতে জড়িয়ে আছে, তখন ব্যাপারটা কেমন বিশ্রী দেখাবে। নিজেকে প্রশ্ন করলাম, তাহলে কি সরিয়ে দেব? মন বলে, না। সরিয়ে না দিলে এক সমস্যা আর সরিয়ে দিলে সৃষ্টি হবে বহু সমস্যা! এই ভোররাতে বাদানুবাদের কোনো মানেই হয় না। থাকুক তাহলে যেমন আছে তেমনি।
বগির এমাথা-ওমাথার আবশ্যক সেন্ট্রাল লাইট দুটি অন করা সারারাত। ভেতরের সবকিছুই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, আমি বিব্রতবোধে এতটুকু হয়ে আছি। এক ঝাঁকানিতে মেয়েটির মাথা ঢলে পড়ছে আমার কাঁধে। যেভাবে দৈবাৎ এসে পড়েছে কাঁধে, আর নামানোর কি-ইবা দরকার?
একবার চোখ বুজে ভাবলাম, আমার উড়ো মনে যদি জীবনের জন্য কেউ এমন ভার চাপাত, এলোমেলো জীবনকে স্নিগ্ধ সুরে সাজিয়ে দিত, কেউ এমন আমোদে–আহ্লাদে। তাকে হৃদয়ের আলেখ্যে স্থান দিতাম; মনমন্দিরের দেয়ালে টাঙিয়ে রাখতাম নিপুণ শিল্পকর্মের মতো।
আমার এ ভাবাবেগের ফল্গুধারা বেশি দূর এগোতে পারেনি। মিথ্যা সুখানুভবের ইতি টানতে হলো অকস্মাৎ। এতক্ষণের সস্নেহে লালিত পরিতোষের ফোড়ন কাটল। ক্ষুব্ধ মনের বিচলিত চোখে সামনে তাকালাম; টিকিট চেকার এসে জন জন টিকিট চেক করা শুরু করলেন। এবার আমার পালা। মোবাইল থেকে দেখালাম। টিকিট চেকার জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার মিসেসের টিকিট কই?’ মনে মনে বললাম আমার মিসেস কে আবার? কী আপদ! যদি মুখ ফুটে বলি যে ও আমার কেউ না, তাহলে কেমন বেমানান দেখাবে। আমার কাঁধে ওর মাথা রাখা আছে, এতে যদি উনি বলে ওঠেন লাম্পট্যের একটা সীমা থাকা দরকার, তখন কী হবে?
টিকিট চেকারকে ইতস্ততভাবে বললাম, ‘জি জনাব, ওরটা ওর কাছেই আছে। কিন্তু ঘুমের ডিস্টার্ব করা বোধ হয়... ’ ওকে ঠিক আছে বলে সামনে এগিয়ে গেলেন। স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লাম একবার। তবে ওকে আমার মিসেস বলে সম্বোধন করাতে মন বেজার করিনি; কিছুটা বিব্রতবোধ করেছি মাত্র। আমাদের মধ্যে কী এমন সংগতি দেখে উনি এমন মন্তব্য করলেন? যাহোক বিষয়টি এতটুকু মন্দ নয়।
অবিশ্রান্ত গলায় তর্জন–গর্জন তুলে ছুটতে ছুটতে ট্রেন পৌঁছে গেল স্টেশনে। ততক্ষণে পুবাকাশ ফ্যাকাশে হতে শুরু করেছে। স্টেশনে ঢোকার সময় হুইসেল গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিলে আমার সহযাত্রীর ঘুম ভেঙে যায়। ও আস্তে করে মাথা তুলে নেয় আমার কাঁধ থেকে। ঘুম ঘুমচোখে বলে বসে, ‘সরি, কিছু মনে করবেন না। গত দুই রাত ভালোমতো ঘুম হয়নি, তাই এমনটা হয়েছে।’ আমি আশ্বাসের জোরে বললাম, ‘না না, কোনো সমস্যা নেই, আমি কিছুই মনে করিনি।’
আমার কথা শুনে ও মুচকি হেসে জানালা দিয়ে প্ল্যাটফর্মের দিকে তাকাল। মুহূর্তেই যে যার মতো ছোটাছুটি শুরু করে দিল তল্পিতল্পা নিয়ে। আমরা ভাববোধহীনের মতো তখনো বসে আছি সিটে। কেউ কাউকে কিছু বলছি না। মনে মনে দুজনেই অপেক্ষা করলাম কথা বলার জন্য। শুরুটা কেউ একজন করলে চলতে থাকবে দ্বিধাহীনভাবে। একপর্যায়ে আমাদের নীরবতার যবনিকাপাত ঘটল। সহসা ও বলে উঠল, ‘আমার একটু তাড়া আছে, উঠতে হবে এবার।’ কিছু না বলে ওর বড় লাগেজটা এক হাতে নিয়ে আমার ব্যাগটা পিঠে নিলাম। টানতে টানতে প্ল্যাটফর্মে এসে থমকে দাঁড়ালাম। বড় লাগেজটা ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললাম, ‘ বাই দ্য ওয়ে, আপনি এখানে কী করেন এবং কোথায় থাকেন কিছুই তো বললেন না।’ ‘আমি থাকি মতিঝিল। একটা প্রাইমারি স্কুলে ইংলিশ টিচার।’
আমারও প্রোগ্রামের সময় হয়ে আসছে, সকাল সকাল অংশগ্রহণের তাগাদা আছে। আর কথা বাড়াইনি। মানুষের ভিড় ঠেলে কোনোমতে বেরিয়ে এসেছি স্টেশনের বাইরে। শেষে ও বলল, ‘ঠিক আছে, আবার দেখা হবে আমাদের।’ আমি মুচকি হাসিতে ঘাড় বাঁকা করলাম। দুজন দুদিকে মুখ করে হাঁটা শুরু করলাম। ভাবলাম, আমাদের কি আদৌ দেখা হবে কখনো? ঘাড় বেঁকিয়ে পেছনে ফিরে দেখলাম মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে। চোখে চোখ পড়াতে লাগেজ টানতে টানতে এগিয়ে গেল। আমিও মিশে গেলাম উপচে পড়া ভিড়ে।
বন্ধু, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধুসভা