চিঠি
বাসুন বারোতে (পর্ব ১৫)
চিঠিটি আমার একমাত্র ছেলেকে উদ্দেশ করে লেখা। এই চিঠি যখন লিখি, তখন তার বয়স ছিল ১২ বছর। এখন সে ২৫ বছরের তরুণ।
বাসুন,
ঠিক এক মাস হয়ে গেল তোকে দেখি না। গত মাসের এই তারিখে তোকে কানাডা-আমেরিকার বর্ডার ব্যাফেলো শহর থেকে আমেরিকার বিমানে তুলে দিয়েছিলাম।
কেমন করে মাস পার হয়ে গেল বাবু? সময় কী দ্রুত চলে যায়! আজ লিখতে বসেছি, শনিবার সকাল। খুব ভোরে ঘুম ভেঙে যায়। আমরা দুজনই তো মর্নিং পারসন, তা–ই না বাজান! আরও দশ দিন পরে দেখা হবে তোর সঙ্গে।
সেই সকাল থেকে এখন বেলা একটা অবধি কী করলাম, শোন তাহলে। মনিকা পারকিনসন নামে ৬৪ বছরের বয়স্ক এক মহিলা থাকে আমাদের বাসার সামনেই।
তবু কি জীবন একই রকম হয় কখনো? কোনো মানুষই কি পৃথিবীতে একই রকম? হয়তো দুঃখ-কষ্টের বা জীবনের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো কাছাকাছি মিলে যায়;
মনে পড়ে তোর, বাবু? ওই যে তুই চলে যাওয়ার কিছুদিন আগে থেকেই মনিকা আমার বন্ধু হয়ে উঠল। আমাদেরই নিরিবিলি অ্যাপার্টমেন্টের পেছনের জায়গাজুড়ে যে বাংলো ধরনের বাসা, তার আশপাশে এক বিকেলে হাঁটতে গিয়ে দেখি, কালো মহিলা নিজের বাগানে পানি দিচ্ছে। গ্রীষ্মের পাগল করা বিকেল তখন, মোহনীয় সুন্দর বাতাস মে-জুন মাসে। এগিয়ে গিয়ে মনিকার সঙ্গে পরিচিত হই।
মূল বাড়ি জ্যামাইকায়। কানাডায় মনিকা এসেছিল যখন ওর বয়স মাত্র ২০ বছর। ৪৪ বছর ধরে মনিকা আছে কানাডায়।
চাকরিজীবনে কাজ করেছে রেজিস্টার্ড নার্স হিসেবে। শহরের বড় বড় হাসপাতালে কাজ করত। কানাডার মতো দেশে একবার যদি কেউ নার্স হিসেবে পেশা গড়ে তুলতে পারে, তাহলে আর তাকে বাকি জীবন পেছন ফিরে তাকাতে হবে না।
খুব স্থায়ী কয়েকটি চাকরির ভেতর নার্সিং অন্যতম। তাই মনিকা যেদিন প্রথম বলল যে ও নার্স ছিল, সেদিনই বুঝেছিলাম ওর জীবন এই দেশে ১০০ ভাগ নিরাপদ। তাই মনিকা এখন পায়ের ওপর পা তুলে খাচ্ছে। এরপর তো প্রায়ই বিকেলে দেখা হতে লাগল ওর সঙ্গে। কথার পিঠে কথা, গল্পের সঙ্গে সঙ্গে মনিকার জীবনে আমি প্রবেশ করতে থাকি। আমাদের একটা জায়গায় মিল আছে; দুজনই একা জীবন যাপন করি। তাই গল্প মিলতে সময় লাগে না।
তবু কি জীবন একই রকম হয় কখনো? কোনো মানুষই কি পৃথিবীতে একই রকম? হয়তো দুঃখ-কষ্টের বা জীবনের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো কাছাকাছি মিলে যায়; তাই মানুষ সমমনা মানুষ খোঁজে, বন্ধু খোঁজে, নির্ভরতা খোঁজে। এভাবেই জীবনের বাঁকে বাঁকে মানুষ খুঁজতে খুঁজতে একদিন মানুষ থিতু হয়; সময়ের কাছে। জীবনের কাছে আমরা মাথা নত করি।
আমরা মানুষেরা একদিন বেলা শেষের আলোর দিকে তাকিয়ে নিজেকে মিলিয়ে নিই। বাসুন, আমিও সেই সব মানুষের একজন, যে মানুষ খুঁজি, বন্ধু খুঁজি। এক বিকেলে তাই আলাপ করতে করতেই জানতে চাইলাম, মনিকা, তুমি কোনো দিন বিয়ে করোনি সেটা বুঝলাম, কিন্তু ভালো নিশ্চয়ই বেসেছিলে কাউকে। তোমার সৃষ্টিকর্তা তো তোমাকে ভালোবাসাবিহীন জীবন দিতে পারে না, তা–ই না?
এবার মনিকার চোখে ছায়া পড়ে। গভীর ছায়া। ওকে একটু বিহ্বল দেখায়। সন্ধ্যার আগে আগে ও গাছে পানি দিচ্ছিল। তার বাগান দেখলে বোঝা যায়, ভালোবাসা না থাকলে এমন করে ফুল ফুটবে না কোনো দিন। ও এবার একটু বসে, আমাকেও পাশে বসতে বলে। ‘শোনো লুনা, ১৬ বছর ধরে একজন মানুষের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব ছিল। কিন্তু জানো, ও আমাকে সব সত্যি বলেনি। আমাদের বন্ধুত্বের সাত–আট বছর পরে জেনেছিলাম, ওর স্ত্রী–সন্তান আছে। আমি মানতে পারিনি লুনা, আমি কিছুতেই মানতে পারিনি। আমার চেয়ে ১৬ বছরের বড় ছিল সে। কিন্তু আমি তাকে কিছুতেই ভুলতে পারিনি। তাই আর কোনো দিন বিয়েও করিনি। শেষে একাকিত্ব কাটানোর জন্য জ্যামাইকা থেকে খালাতো বোনের ছেলেকে দত্তক নিয়েছিলাম। এখন সেই ছেলের বয়স ৩৪। কই, আমার ছেলে কি আমাকে সময় দেয়? বলো, আমি কী করতে পারি? বাড়ি-টাকা সবই তো আছে। কিন্তু মানুষ কি আমি পেয়েছি? সঠিক মানুষ কি মানুষ আসলে পায়? হয়তো পায়। কিন্তু আমি পাইনি। তাই তোমাকেও বলি লুনা, জীবন যেভাবে আছে, সেটাকেই সহজ করে মেনে নিতে হবে। আমি এর বাইরে আর কিছুই বলতে শিখিনি বা বলতে পারব না বা জীবন আমাকে বলতে শেখায়নি।’
এর কিছুক্ষণ পরে মনিকার টিভিরুমে গিয়ে বসি। বলি, তোমার সেই বন্ধুর ছবি দেখাও আমাকে। সে স্মৃতির অ্যালবাম বের করে। আমার সঙ্গে সঙ্গে ও ফিরে যায় ৩০ বছর আগে। কত স্মৃতি মনিকার। দেশে-বিদেশে, টগবগে তরুণী মনিকা। একটা ছবিতে চোখ আটকে যায় আমার। মনিকার অনামিকায় রিং আর হাতে গোলাপ। আমি তাকাতেই ও বলে, ‘জানো, আমরা রিংও পরেছিলাম। তারপরও আমাদের সম্পর্কটা টেকেনি।’
আজ সকালে আমাদের বাসায় মনিকা এসছিল, বাবু। আমিই আসতে বলেছিলাম। আজ শনিবার। আমার নীরব সময়, কিছু করার নেই। তুই না থাকলে সংসারে কাজ কী, বল বাসুন! তাই ভেবেছিলাম মনিকার সঙ্গে গল্প করে তোকে লিখতে বসব। কত আলাপ হলো ওর সঙ্গে, জীবনের কত পথ, বাজান; কী করে লিখব সব বল?
শান্ত দুপুর, ভীষণ নীরব হয়ে আছে বাসা, বাবু। তুই নেই, যেন জীবন থেমে আছে। মনে পড়ে প্রিয় দেশের কথা। বাংলাদেশে এখন মধ্যরাত। প্রিয় মানুষ কি জেগে আছে? বড় বেশি একা লাগে, বাবু। কারও গলার স্বর শুনতে ইচ্ছে করে খুব। কারও উত্তাপ পেতে ইচ্ছে করে। মনিকার মতো ভয়াবহ একা হয়ে যাওয়ার আগেই যেন জীবন থেকে চলে যেতে পারি, বাবু।
তুই তো বড় হয়ে গেছিস। আর কিসের তাড়নায় বাঁচা, বাসুন? আদর, সোনা।
তোর মা
২৮ জুলাই, ২০১২
ব্রাম্পটন, অন্টারিও, কানাডা