করোটির কথামালা (পর্ব ৯)

চিঠি লেখাপ্রতীকী ছবি
জীবন একটা মায়ার খেলা। মায়া দিয়ে ভরে থাকা জীবনের অপার রহস্য, ঘোর লাগা একটা সময় পার করি আমরা সবাই হয়তোবা।

জোহরের নামাজ সেরে এইমাত্র ইনেদের বাসার মেইন ফ্লোরে এলাম। ঘড়িতে এখন সন্ধ্যা পৌনে ছয়টা। সাগা কথা বলছে ওর বন্ধুর সঙ্গে, আবার ডিনারও তৈরি করছে। মাত্র ১৭ বছরের মেয়ে। বন্ধুর ব্যাপারে কী ভীষণ সৎ আর নিবেদিতপ্রাণ, ভাবলেই ভালো লাগে।

শেষ লেখায় তোকে ইনেদের কথা বলেছিলাম, মনে আছে? সেখান থেকেই শুরু করার কথা ছিল আমাদের, তা–ই না? কিন্তু দেখ, এই এক দিনের ভেতরই ভাবনা আর অনুভূতির কত রং বদলায়! মানুষ হওয়ার এই এক বিচিত্র খেলা। ক্ষণে ক্ষণে রং বদলায়, এই ভালো লাগে তো এই আবার বিষণ্নতায় ভরে যায় মন। যাহোক, গতকাল ইনেদের সঙ্গে ইফতার করলাম, করতে বাধ্য হলাম। কারণ, ইনেদ বসে থাকল আমার জন্য রাত নয়টা পর্যন্ত, জুস বানিয়ে দিল, আমাকে সঙ্গও দিল; যদিও ওর ডিনার সাতটার ভেতরই শেষ।

এই দেশে এটাই নিয়ম, বীথি। আমি নিজেও কিন্তু এই নিয়ম খুব ভালো করে মেনে চলি।

এই বাড়িটার তিনটা তলা। নিচে বেজমেন্ট, মাঝখানে মেইন ফ্লোর আর ওপরতলায় তিনটা আলাদা ঘর। ইনেদের দুই মেয়ে গেছে ওদের নানির বাসায়। একটা ঘরে আছে সাগা, অন্য ঘরে ইনেদ; আর মূল শোবার ঘরে আমি। থাকার কথা ছিল বেজমেন্টে। কিন্তু থাকতে হচ্ছে বাড়ির সবচেয়ে বড় ঘরে। এর নাম কি রিজিক, যা গলার মালার মতো পরম করুণাময় সবার গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছেন?

আসলেই তা–ই বীথি। আমাদের এই বাড়ির নিয়ম হচ্ছে, যার যার খাবার সে সে তৈরি করবে, কিনবে এবং রান্না শেষে কিচেন পরিষ্কার করে বের হবে। আমি গতকাল মানে সোমবারেই আসার সময় তিনটা বড় মাছের টুকরা রান্না করে এনেছি নিজের বাসা থেকে; যেহেতু জানি যে রোজা ভাঙতে হবে, তাই প্রস্তুতি সব নেওয়াই আছে।

সেইমতো গতকাল করেছিলাম সবজি খিচুড়ি। ইনেদকে বললাম, তুমি আমার সঙ্গে খাবে, কোনো কথা শুনব না। সামান্য দুটো ভাত বা খাবার, তা–ই না বীথি! কত যে ধন্যবাদ দিতে থাকল বারবার। মনে মনে বললাম, ‘ইনেদ, তোমাকে পেয়ে যে কতখানি উপকার হলো, সেটা তোমার জানার কথা নয়। এই যে দুই মাস নাইয়া নেই, নিজের শূন্য বাড়িতে ফিরতে হচ্ছে না, একা একা ইফতার করতে হচ্ছে না, এসব প্রবল অনুভূতি কি কাউকে বোঝাতে পারব, নাকি সেটা সম্ভব, বল?

আরও পড়ুন

আসলে কি জানিস, জীবন একটা মায়ার খেলা। মায়া দিয়ে ভরে থাকা জীবনের অপার রহস্য, ঘোর লাগা একটা সময় পার করি আমরা সবাই হয়তোবা।

এই যে তোকে লিখি, একটানা বসে লিখে ফেলি; যেন কথা বলছি তোর সঙ্গে আর তুই বসে আছিস সেই ছোটবেলার মতো মুখের সামনে। মনের ভেতরের সব কষ্ট-দুঃখ-হাহাকার চাপকলের পানির মতো বেরিয়ে আসে। তারপর ভাবি, কী লিখছি এসব? কিন্তু যখন দেখি কেউ লিখছে, ‘আবার কবে লিখবে, আপু?’ তখন মন উচাটন হয়ে ওঠে। তাহলে নীল বেদনার পাহাড় আমি একাই পাড়ি দিই না, আরও কেউ আছে আমার সঙ্গী, তা–ই না বীথি? এই লেখা পড়ে তারাও হয়তো কিছুক্ষণ ভাবে।

অন্য একটা কথা, বীথি। গত দুদিন হলো দেখছি হুমায়ূন আহমেদের নাটক ‘কুসুম’। ১৯৮১ সালে লেখা নাটক। গরিব মা–বাবা পয়সার অভাবে বেচে দিয়েছে মেয়ে কুসুমকে। বাংলাদেশের সেরা এবং সবচেয়ে গুণী অভিনেত্রী সুবর্ণা মোস্তফা হয়েছেন কুসুম; অভিনয় কাকে বলে!
হু হু করে কাঁদছি আর মনে পড়ছে ফেলে আসা দেশকে। আমার দুঃখিনী দেশ, অভাবে–অনটনে, মানুষ দিশা হারিয়ে ফেলে, বীথি।

এই যে সঙ্গী খোঁজার তাড়না মানুষের; প্রতিদিন যুদ্ধ করতে করতে মানুষ একেকটি বিছিন্ন দ্বীপ হচ্ছে ক্রমাগত। কোথায় যেতে চাই আমরা? কার কাছে?

গরিব মানুষের কি গাটস থাকে? নাকি থাকে সৎ থাকার মতো প্রবল সাহস? থাকে শুধু বেঁচে থাকার তীব্র বাসনা। আমি সেই দেশের মেয়ে, বীথি। খুব কাছে থেকে, বলতে পারিস নিজের জীবন দিয়ে সেই সব মানুষকে দেখেছি। আবার এ–ও জানি, কেবল সেই সব সরল মানুষেরই থাকে বুক উজাড় করা ভালোবাসা।

জানিস তুই? কষ্ট আর দুঃখ দেখলেই দেশের কথা মনে পড়ে। পেছনে ফেলে এসেছি কিছু সময়, কিছু ভালোবাসা, জীবনের সেরা স্মৃতি; যা বুকে করে বেঁচে থাকতে হবে বাকি জীবন। বেঁচে হয়তো থাকব, কিন্তু সুখ কি পায় মানুষ মনের ভেতর থেকে?

আজ দশ বছর বিদেশে, বীথি। আমি একা নই, প্রত্যেক মানুষ, যাঁরাই আমার মতো প্রবাসী, সবার হয়ে বলতে পারি, কেউ মোট ৬০ সেকেন্ডও নিজের অতীত ভুলে থাকে না। প্রিয়জনকে ভুলে থাকে না। দেশকে ভুলে থাকে না। তবু বেঁচে থাকে মানুষ। এই এক অদ্ভুত জীবন আমরা পার করি, বীথি।

মনে হয়, ঐ যে দূর–বহু দূর, ওখানেই বুঝি সব সুখ। ইনেদের শোবার ঘরে, দুটো আলাদা জারে অসাধারণ দুটো মাছ রাখা আছে। গাড় নীল, সবুজ আর হলুদের লম্বা ঝালর মাছ দুটোর, সাদা রুপালি স্বচ্ছ পানিতে মাছ দুটো ঘুরছে।

অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে সকালে ইনেদকে বলি, ‘তুমি ওদের আলাদা রেখেছ কেন, ওদের এক জারে রাখলে কী হয়?’ ইনেদ বলে, ‘লুনা, এই মাছগুলোর নাম ফাইটার। একসঙ্গে থাকলে যুদ্ধ করে’, বলেই ইনেদ হাসতে থাকে।

তাইতো, এই যে সঙ্গী খোঁজার তাড়না মানুষের; প্রতিদিন যুদ্ধ করতে করতে মানুষ একেকটি বিছিন্ন দ্বীপ হচ্ছে ক্রমাগত। কোথায় যেতে চাই আমরা? কার কাছে? নিজেরাই কি জানি আমাদের গন্তব্য?

আদর, বীথি। আবার ফিরব তোর কাছে।

৮ জুলাই ২০১৪

টরন্টো, কানাডা