বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের তুখোড় সেই বান্ধবীর গল্প করছিলাম আমরা দুই বান্ধবী। টরন্টো শহরেই, কথা বলছিলাম ফোনে। বাইরে তখন তীব্র শীতের বাতাস। সারা কানাডায় যে কনকনে শীতের বাতাস থাকে, এমন রাতে দুজন মধ্যবয়সী মেয়ের ফোনে কথোপকথনের গল্প বলছি এখন।
ডাউনটাউন টরন্টোর এক কেতাদুরস্ত ভবনে তখন রাতের পার্টি জমে উঠেছে। নানা স্বাদ ও রঙের মদ, নারী-পুরুষ। এই শহর তখন এক আহ্লাদি নারী। পার্টটাইম সিকিউরিটির কাজে আছি। আর আমার বান্ধবী, যে এই শহরে প্রায় ২০ বছর থাকার পরে বাংলাদেশ থেকে বেশ কিছু ডলার নিয়ে এসে ডাউন পেমেন্ট দিয়ে বাড়ি কিনেছে কয়েক বছর হলো—কথা বলছিলাম এই দুজন মিলে।
জীবনের মধ্যবয়স, হিসাব মেলানোর টানটান সময়। কীসের হিসাব?
করোটির গোপন রন্ধ্রে যে সত্য লুকিয়ে থাকে, যৌবনের সেই বিপ্লবী দিনে যখন মনে হতো—আরে, জীবন কোনো ব্যাপার না, সেই দামি হিসাব। হেলায় হারানো, খেয়ালি বাতাসে বলা সেসব কথা এই মধ্যবয়সে এসে মিলেছে কি না, সেই হিসাবের কথা বলতে ইচ্ছা করে, জানতে ইচ্ছা করে ভীষণ। বারবার মনে হয়, জীবনের কাছে এই করুণ পরাজয় কি আমার একার, নাকি অন্য অনেকেই আছে এই ধীরে বয়ে চলা নৌকা-কায়?
জীবনঘনিষ্ঠ দুই বান্ধবী। ১৪ বছর ধরে কথা বলেছি, আবার হয়তো বলছি না; যা বলা দরকার তা না বলে অন্য কিছু বলছি। কিন্তু বলছি, বারবার কথা বলছি। বারবার নিজেরা মুখোমুখি বসে প্রশ্ন করেছি, আসলেই কী চেয়েছিলাম এই জীবনের কাছে?
তুই বলতে পারিস দীনা?
নারে, এই উত্তর মেলে না। কিছুতেই মেলে না।
আচ্ছা দীনা, তাহলে কি রুমির হিসাব মিলল?
হয়তো রুমির ছায়ায় আমরা নিজেরাই। তবু রুমিকে নিয়ে কথা বলি।
মনে আছে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছায়াঘেরা সেই সবুজ ক্যাম্পাসে, নব্বইয়ের দশকে তখনো দেশ হয়তো এতটা পচেনি, তাই না? মনে আছে, খুব সংস্কৃতিমান সুঠাম এক ছেলে রুমির সঙ্গে দেখা করতে আসত ঢাকা থেকে। আমরা যখন ক্যাম্পাসেই অন্য কোনো ছেলেবন্ধুর সঙ্গে ঘুরতে বেড়িয়েছি কনে দেখা শেষ বিকেলের আলোয়, তখন ভীষণ রুচিমান, তকতকে ঢাকার হলি ক্রস কলেজ থেকে পাস করে আসা রুমির সঙ্গে দেখা করতে আসত ঢাকা থেকে সেই ছেলেটা। রুমির চেয়ে বয়সে একটু বড় হয়তো, কিন্তু তাতে কী।
আসলে রুমির কাছে আমরা অনেকেই তখনো গ্রাম্য। রুমি মুখটা একটু বাঁকা করে বলত, ‘আমার ডেট আছে রে।’
জানিস দীনা, তখনো ডেট শব্দের সঙ্গে পরিচিত নই। মধ্যবিত্ত কলেজশিক্ষকের মেয়ে, তার ওপর বড় হয়েছি চার বোন একসঙ্গে। মাত্র এক জেনারেশন ঢাকায় আমরা। অনেক মেয়েলি বিষয় বুঝতে একটু সময় লেগেছিল। আমরা অনেকেই জানতাম, রুমির কাছে আসা সেই ছেলেটা সেটেলড, ভালো চাকরি করে, রুমি জীবনে সুখী হবে। হয়তো মনে মনে একটু অবাক লাগত, রুমি কি আমাদের চেয়ে অনেক বেশি আগানো? ও যে আমাদের অনেক আগেই জীবনের হিসাব বুঝে গেল!
দীনাই বলছিল রুমির কথা। জানিস লুনা, ‘সেই রুমি ভীষণ দিশাহারা রে এখন। সেই বড় ভাই তো রুমিকে ছেড়ে গেছে অনেক আগেই, বিয়েও হয়নি ওদের। তত দিনে অবশ্য অন্য অনেক অপশন বের করতে পারত রুমি। কারণ, ও তখন মহিলা আতেল হিসেবে খ্যাত—অনেকেই হয়তো রুমির পাণি পেতে চায়। কিন্তু শেষ অবধি রুমির বিয়ে হয়েছিল রফিকের সঙ্গে।’
‘রফিক?’ ফোনের এই প্রান্তে আঁতকে উঠি। প্রায় শতভাগ অবিশ্বাসের সুরে বলে উঠি, ‘রফিক তো গ্রামের ছেলে, ভীষণ খ্যাত, গায়ে ঘামের দুর্গন্ধ, পাশে হাঁটা যায় না, মুখ থেকে অরুচিকর খাবারের গন্ধ আসে, গায়ে বোঁটকা গ্রাম্য গন্ধ। কী বলিস দীনা, রুমির সঙ্গে শেষে রফিকের বিয়ে!’
এবার দীনা হেসে ওঠে সজোরে। ‘লুনা, জীবন মানুষকে কোথায় নেয়, আজও জানিস না তুই। রফিক তো নিজেকে মানুষ করেছে, ঘষেমেজে নিজেকে জীবন–উপযোগী করেছে।’
বারবার ভিন্ন ভিন্ন ছেলেমেয়ের কথা, জীবন আমাদের মুখে মুখে ঘুরছে। কোনো হিসাব মিলছে না, কিছুই মিলছে না। কিন্তু জীবন বয়ে যাচ্ছে।
আমাদের তুখোড়, স্মার্ট অনেক ছেলেবন্ধু, যারা ভীষণ কাব্য করে, আকাশের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারত বা চমৎকার করে ভালোবাসায় আপ্লুত করতে পারত, কিংবা যারা না জেনে বাম রাজনীতির কথা বিশ্বাসের সঙ্গে বলতে শিখেছিল অনেকটা তোতা পাখির মতো, তারা তো আজকে অনেকেই রাস্তায় ঘুরছে। তাহলে রুমি কেন রফিককে বিয়ে করবে না বল?
অবাক কাণ্ড কী জানিস, বরং রুমিই নিজেকে প্রস্তুত করেনি। ওই যে কায়দা করে শাড়ি পরতে পারত, ওই যে ওপর দিয়ে ফাঁপা বুলির মতো দুই-তিনটা বইয়ের নাম বলতে পারত; রুমির দৌড় অতটুকুই। তাই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়ার আগেই রফিক যখন শিক্ষক হিসেবে জয়েন করল, তখন তো রফিক বিয়ের বাজারে ঈর্ষা করার মতো সেরা পাত্র। রুমিই তো উল্টো এসে রফিককে বিয়ে করেছে। জীবনের সেটেলমেন্টের গায়ের গন্ধ, বগলের নোংরা চুল, কথা বলতে না পারা, এমনকি কায়দা করে সেক্স করতে না পারা—এগুলো কোনো পয়েন্টের ভেতরেই পড়ে না লুনা। তুই এই সহজ সত্য বুঝতে পারিস না কেন?
আমি মুখে স্বীকার করি না হয়তো; কিন্তু মনের গভীরে বিশ্বাস করি ১০০ ভাগ। নইলে কোন হিসাব থেকে আমার পাশের ঘরে যে মেয়েটা থাকত, কী যেন নাম মেয়েটার—নীলু। এখন আমেরিকার সান হোসে শহরে থাকে। ওখানে একটা কলেজে পড়ায়। আর আমি লুনা, বেঁচে থাকার জন্য পার্টটাইম সিকিউরিটির কাজ করি। নীলু তো পাবনা থেকে ঢাকায় এসেছিল। ঢাকায় বেড়াতে যেতে পারে, এমন কেউ ছিল না ওর।
আর আমি?
যখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শীতে জিনস পরতাম, সেই সময় নীলু জবুথবু হয়ে দুটো সালোয়ার পরত। মনে মনে ভাবতাম, ইশ্, নীলু কী গ্রাম্য! হয়তো আমি যে সময় ছেলেবন্ধুদের সঙ্গে বাসে করে ঢাকায় যাচ্ছি শাহরিয়ার কবিরের সঙ্গে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির মিটিং করতে, নীলু সেই সময় অন্ধকার শীতে ভালো করে পাঠ্যবইটা আয়ত্তে আনত। তাই নীলু বিভাগের শিক্ষক হয়েছিল।
আর আমি? ভাসা ভাসা বিদ্যা নিয়ে বাবার এক কলিগকে ধরে চাকরির চেষ্টা করছি। নীলু যখন বিভাগে পড়াচ্ছে, আমাকে তখন মা–বাবা যে কারও সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দায় সারছেন। কারণ, আমার মতো অসংখ্য লুনা প্রমাণ করেছে, আমরা কত দূর যেতে পারব।
নীলু এগিয়েছিল মেধা দিয়ে। জব ইন্টারভিউয়ে তো গায়ের বা মুখের গন্ধ শুঁকে না, বরং মাথা থেকে কী শব্দ বের হয়ে মুখ পর্যন্ত আসে, আসলেই মাথার ভেতরে কিছু আছে কি না, সেটা জানতে চাওয়া হয়। আমরা অনেকেই এই দৌড়ে ডাহা ফেল। কারণ, কায়দা করে আকাশের ছবি দেখা বা বাংলাদেশে কয়েক ডজন বিখ্যাত মানুষ আমাকে চেনে, সেটা দিয়ে আর যা–ই হোক নীলুর মতো ক্যালিফোর্নিয়াতে যে শিক্ষক হওয়া যাবে না, সেটা বুঝে ফেলেছি এত দিনে।
তাহলে আমিও কি অনেক অনেক প্রাপ্তির পরে একা একটা জীবন রচনা করলাম? কীসের হিসাব মেলাতে গিয়ে পার করলাম এই যাপিত জীবন?
যদিও তত দিনে অনেক দেরি। আমার মতো অনেকের কপালে জুটেছে সিকিউরিটির জব। আর নীলু নিজের মেধা ও চেষ্টা দিয়ে প্রায় হিরোর মতো এক জামাই নিয়ে ছুটির দিনে পার্টিতে যাওয়ার আয়োজনে ব্যস্ত। অন্যদিকে রফিক তখন বিয়ের ১৯ বছর পরে নিজের যোগ্যতায় পাড়ি দিয়েছে নিউজিল্যান্ডে। সেখানে পরিচয় হয়েছে মরক্কোর এক সুন্দরী তামান্নার সঙ্গে। রফিক তত দিনে বুঝে গেছে, রুমির এক দিনও নিজেকে চালানোর শক্তি নেই। তাই রুমির সামনেই রফিক এখন সেই ললনার সঙ্গে ডেট করে।
আর রুমি? সেই রুমি, যার সঙ্গে একটু কথা বলার জন্য, একটু সময় পাওয়ার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে থাকত অনেক তরুণ, সেই রুমি এখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ। এখন আর সেই টানটান নিতম্ব বা বুক কোনোটাই নেই, কারোরই থাকে না। জীবনে যা থাকে তার নাম হচ্ছে মেধা, বিদ্যা; যা অর্জন করতে হয় সাধনা ও অধ্যবসায় দিয়ে।
সিকিউরিটির আট ঘণ্টা শিফটে তখনো বারবার দীনার সঙ্গে কথা বলছি। বারবার ভিন্ন ভিন্ন ছেলেমেয়ের কথা, জীবন আমাদের মুখে মুখে ঘুরছে। কোনো হিসাব মিলছে না, কিছুই মিলছে না। কিন্তু জীবন বয়ে যাচ্ছে।
আচ্ছা দীনা, তোর মনে আছে ওই যে মেয়েটা, কী যেন নাম— হ্যাঁ, রুবি। পদার্থবিজ্ঞানে পড়ত। সারা বছর কেমন মুখ লুকিয়ে থাকত, কথা বলত না। একবার কী একটা ঘটানায় মেয়েটা সবার আলোচনায় চলে এলো, মনে আছে তোর দীনা?
হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে থাকবে না! সেই তো ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন, তাই না? সবে শুরু ১৯৯১-৯২ সাল হবে, তাই না?
সেই মেয়ের এখনকার কথা জানিস? যে মেয়ে পরে ছাত্র ইউনিয়ন থেকে সেন্ট্রাল কমিটির ইলেকশনে জিতেছিল। আজকে ওরা দুজনই ঢাকার বেশ বড় বড় এনজিওর হর্তাকর্তা। সব সাম্যবাদের কথা ভুলে গিয়ে কী করে বিদেশি টাকা দিয়ে জীবন যাপন করা যায়, কী করে দেশে থেকে বিদেশে ছেলেমেয়েদের পড়ানো যায়, সেই বিদ্যা রপ্ত করেছে। ওরা অনেক সফল কিন্তু, জানিস তুই?
দীনা, নীলু, রফিক, রুবি, রুমি—সবাই মাথার করোটিতে ভিড় করে থাকে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজিলাতুন্নেসা হলের ৫০০ ব্লকে মাঝরাতে উঠে খিচুড়ি রান্নার রাতগুলো আলোর মতো জ্বলজ্বলে হয়ে ওঠে। তীব্র শীতের বাতাসে রাত ১১টায় শিফট শেষে পাতাল ট্রেনে চেপে বসি, নিজের একান্ত হিসাব মেলাতে ইচ্ছা করে ভীষণ। মেলে না কিছুতেই। ১৯ বছর ধরে এক হাতে ছেলেকে বড় করছি। সব হিসাবের স্প্রেডশিট নিয়ে বসি। মেলানোর চেষ্টা করি। নিজেকে বোঝাই, এই তো সব ঠিক আছে। ফোন ছাড়ার আগে দীনাও বলে, জানিস লুনা, তুই কাজ করিস বলেই ভালো আছিস। নিজেকেও তাই বলতে চাই, ম্যাক মাস্টার ইউনিভার্সিটি থেকে নাইয়া বাসায় এসেছে।
ফুলটাইম, পার্টটাইম মিলে তিন-চারটা জব আছে আমার। ডলারের খুব সমস্যা নেই। জীবনের অনেক বড় বাধা পার হলাম একা একা। তবু ওই যে দৃশ্য ভাসতে থাকে করোটিতে। বারবার মনে পড়ে সেই মুখ, কেন মনে পড়ে?
পাতাল ট্রেনে পাশে বসা মধ্যবয়সী এক নারী তার পোষা কুকুরের সঙ্গে কথা বলছিল, হাসছিল, কুকুরের মুখে চুমু দিচ্ছিল। এই দৃশ্য বারবার চলে আসে সামনে; কী ভীষণ সুন্দর মহিলা, কিন্তু কী ভীষণ একা।
তাহলে আমিও কি অনেক অনেক প্রাপ্তির পরে একা একটা জীবন রচনা করলাম? কীসের হিসাব মেলাতে গিয়ে পার করলাম এই যাপিত জীবন? রুমি, রুবি, নীলু, রফিক—তোরা কি কেউ জানিস এর উত্তর?
২ ডিসেম্বর ২০১৮
টরন্টো, কানাডা