১৯৮২ সালে নির্মিত চলচ্চিত্র ‘দেবদাস’ বাঙালি জীবনের চিরকালের দেবদাসের যে ছবি, সমাজজীবনের ভাবধারা, বাংলাদেশের রং-রূপ-রসে রাঙিয়ে একটা মহাবৃত্তকে সম্পূর্ণ করেছে।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাঙালি জীবনের বহুল পঠিত কথাসাহিত্যিক। তাঁর অমর সৃষ্টি নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে সর্বাধিক। শুধু দুই বাংলাতে নয়, বাংলার বাইরেও ভিন্ন ভাষায় চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। শরৎচন্দ্র চিরকালীন আধুনিক একজন লেখক, সাহিত্যিক। তাঁর লেখার আবেদন, মানুষের জীবনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার কথা, মানব-মানবীর মনস্তত্ত্ব চিরকালের সমকালকে যেমন ছুঁয়ে ফেলতে পেরেছে; আবার বাঁধনহীন জীবনের গতিধারার ছবি, সীমার মধ্যে অসীমের প্রতিচ্ছবি, বিন্দুর সঙ্গে সিন্ধুর দ্বন্দ্ব, সংঘাত যা ভবিষ্যতের গৃহে, পথে প্রান্তরেও অমিল হবে না।
এই কথাসাহিত্যিকের রচনা নিয়ে গুণী পরিচালক চাষী নজরুল ইসলামও চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। ভিন্ন ভাষার পরিচালক বা বর্তমান তরুণ প্রজন্মের পরিচালকেরা যখন অতীতের গুণী স্রষ্টাদের নিয়ে কাজ করেন, অনেক সময় ভাষা এবং সংস্কৃতির মূল ভাবধারা, সময় এবং ইতিহাসের আবেদন ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারেন না, নিজের সৃষ্টিতে প্রতিফলিত করে ধরতে পারেন না। সেদিক থেকে চাষী নজরুলের মতো সুপণ্ডিত পরিচালকেরা একেবারে শরৎচন্দ্রের যুগের মানুষ এবং বাংলাদেশের মা–মাটি–মানুষের গন্ধে নিজের মতো করে স্রষ্টার সৃষ্টিকে প্রতিফলিত করতে পেরেছেন।
১৯৮২ সালে নির্মিত তাঁর চলচ্চিত্র ‘দেবদাস’ বাঙালি জীবনের চিরকালের দেবদাসের যে ছবি, সমাজজীবনের ভাবধারা, বাংলাদেশের রং-রূপ-রসে রাঙিয়ে একটা মহাবৃত্তকে সম্পূর্ণ করেছে। দেবদাসের চরিত্রে অভিনয় করেছেন বুলবুল আহমেদ। ভিন্ন ধারার ছবির মেধাবী শিল্পী, গুণী নায়ক থেকে তাঁর মহানায়কের পথে উত্তরণ। দেবদাস চরিত্রের ভাঙা-গড়া ফুটিয়ে তোলা খুবই কঠিন কাজ। বুলবুল আহমেদের এই উত্তরণ, চাষী নজরুলের এই উত্তরণ একই সঙ্গে বাংলাদেশের উত্তরণ।
দুরন্ত কিশোর দেবদাসকে নিয়ে তার জমিদার বাবার কাছে কাছারিবাড়িতে অভিযোগের শেষ নেই। পাঠশালায় পড়তে গিয়ে দুষ্টুমি করে। একরত্তি ছেলেটা বাঁশবাগানে লুকোনো হুঁকোতে তামাক খায়। একমাত্র পার্বতী তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। লুকিয়ে খাবার নিয়ে এসে খেতে দেয়। পার্বতীর সঙ্গেও ঝগড়া হয়; এই ঝগড়া তো এই ভাব। দুজনই দুজনকে চোখে চোখে হারায়। কেউ কাউকে ছাড়া থাকতে পারে না। দেবদাস পার্বতীকে প্রহার করে শরীরে দাগ তুলে দেয়। অথচ পার্বতী তার ঠাকুরমার (অভিনয়ে রওশন জামিল) সাহায্য নিয়ে জমিদার বাবুর কাছে নালিশ করলে গোবিন্দ পণ্ডিত মেরেছে। কায়েত হয়ে বামুনের গায়ে হাত তোলা এর একটা বিহিত হওয়া দরকার। সব শুনে জমিদার বাবুও রেগে যান। এদিকে পার্বতীর বুদ্ধিতে ভিতু দেবদাস দোষ করেও মুক্তি পায়, আর পার্বতীর জন্য হৃদয় আরও উতলা হয়। এমন দুষ্টু–মিষ্টি কৈশোরকাল অবশ্য বেশি দিন স্থায়ী হয় না।
ছেলে মূর্খ চাষা হয়ে যাচ্ছে; দেবদাসের মায়ের দুশ্চিন্তা কমাতে বাবা সিদ্ধান্ত নেয় কলকাতায় ওর মামার বাসায় থেকে পড়াশোনা করতে পাঠিয়ে দেবে। গৃহপরিচারক ধর্মদাস দেবদাসকে কলকাতায় রেখে আসবে। পার্বতীর মনে দুঃখ, চোখে জল। এই ধর্মদাসকে পরবর্তী সময়েও আমরা দেখব বারবার কলকাতায় এসে বড় হয়ে যাওয়া দেবদাসকে নানা খবর দিচ্ছে, কেমন আছে দেখে যাচ্ছে। দেবদাসের শেষযাত্রার ট্রেনেও সঙ্গী হবে পরিবারের সুখ-দুঃখের এই পরিচারক। শরৎচন্দ্রের কাহিনির প্রতিটি চরিত্র জলজ্যান্ত মাটির মানুষ। চাষী নজরুল নিপুণ চিত্রনাট্য সাজিয়ে অভিনয়ের যোগ্য চরিত্র নির্বাচনেও সেই সূক্ষ্ম জায়গাগুলো ধরে রাখতে পেরেছেন। ধর্মদাস চরিত্রে আনোয়ার হোসেনের অভিনয় তা প্রমাণ করে গেছে।
দেবদাস কলকাতায় চলে যাওয়ার পর বিরহকাতর কিশোরী পার্বতী গ্রামের বোস্টব, বোস্টবীর কাছে গান শুনতে চায়। এ ধরনের দৃশ্য নির্মাণে পরিচালক চিরকাল সিদ্ধহস্ত। সুবীর নন্দী, রুনা লায়লার দরদি কণ্ঠে এখানে ব্যবহার করা হয় মোহাম্মদ রফিকুজ্জামানের লেখা, খন্দকার নূরুল আলমের সুর করা ‘বলো কেবা শুনিছে এমন পিরিতি কথা...’ গানটি। গানটিকে এই চলচ্চিত্রের শীর্ষ সংগীত এবং দেবদাস-পার্বতীর প্রেমের জয়গান হিসেবেও ধরা যেতে পারে। পরবর্তী সময়ে ‘শুভদা’ চলচ্চিত্র নির্মাণের সময়েও চাষী নজরুল সুবীর নন্দীর দরদি কণ্ঠে এ ধরনের একটি গান ব্যবহার করেন ‘তুমি এমনই জাল পেতেছ সংসারে...’। একই গীতিকারের লেখা এবং একই সুরকারের সুর করা সেই গানটিও কালজয়ী হয়। ‘দেবদাস’ চলচ্চিত্রে সুবীর নন্দীর কণ্ঠে আরও একটি অসাধারণ গান আছে ‘মোনো রে ওরে মন, সুখপাখি তোর হইল না, হইল না আপন...’ ভালো লাগে। শুরুতে ছবির নাম, চরিত্র, শিল্পী, কলাকুশলী পরিচয়ের সময় ব্যবহার করা মাটির সুরও মন ছুঁয়ে যায়। একই সঙ্গে ছুঁতে চেষ্টা করে অমর কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্রকে। ছবির সংগীত পরিচালক খন্দকার নূরুল আলম, কিংবদন্তি শিল্পী সাবিনা ইয়াসমীনও গানে কণ্ঠ দিয়েছেন।
মানবজীবনে প্রেম ঘাটে ঘাটে ডুবে মরে, ঘাটে ঘাটে জল খায়। এখন যে আমরা আধুনিক ভাষায় ত্রিকোণ প্রেমের দ্বন্দ্ব বলে অভিহিত করি, আমাদের শরৎ বাবু কত যুগ আগে বসেই এই ত্রিকোণ প্রেমের দ্বন্দ্বকে সাহিত্যে রূপ দিয়ে গিয়েছেন। দেবদাসের সঙ্গে পার্বতীর সম্পর্ক একরকম, চন্দ্রমুখীর সম্পর্ক অন্যরকম। মানুষকে আনন্দ দেওয়া চন্দ্রমুখীর কাজ। তার দরবারে কত পুরুষ আসে। আনন্দ নিয়ে যায়। আবার গণমানুষের আনন্দদায়িনীকে গণমানুষেরা ঘৃণা করে। অপবাদ, কলঙ্ক তাঁদের ভূষণ। কখনো কখনো কোনো মানুষ আসে এই কলঙ্ক ভাগ করে নিতে চায়। অর্থের বিনিময়ে শুধু ফুর্তি নিয়ে পালিয়ে যায় না। চন্দ্রমুখীর জীবনে দেবদাস তেমন পরম পুরুষ। মদ্যপান করে ডাস্টবিনের পাশে শুয়ে থাকা দেবদাসকেও চন্দ্রমুখী ঘরে তুলে এনে তাই শুশ্রূষা, সোহাগ–ভালোবাসা দেয়। আবার এই সম্পর্ককে শুধু মানব–মানবীর জৈবিক সম্পর্ক ভাবলেও ভুল হবে। সাধক রামকৃষ্ণের চরণ স্পর্শে যেভাবে বিনোদিনী দাসী থেকে মহামানবী শিল্পীতে পরিণত হয়েছেন, দেবদাসের সংস্পর্শও যেন চন্দ্রমুখীকে নরক থেকে স্বর্গের পথে উদ্ধার করতে এসেছে। পার্বতী ও চন্দ্রমুখী দুটি চরিত্রে কবরী এবং আনোয়ারা দাগ কেটেছেন। তাঁদের শিল্পীসত্তা, চোখের ভাষা, অভিব্যক্তি, অসাধারণ মগ্ন বিভোর নিপুণ অভিনয় শতকোটি টাকা বাজেটের চলচ্চিত্রকেও হার মানায়। ঐতিহাসিক চরিত্র এভাবে অভিনয়ের গুণেও ঐতিহাসিক হয়ে ওঠে।
উপন্যাসের শেষ কথাগুলো চলচ্চিত্রের আঙিনায় ভাস্বর করে তোলেন পরিচালক—‘দেবদাসের জন্য বড় কষ্ট হয়। যদি কখনো দেবদাসের মতো এমন হতভাগ্য, অসংযমীর পরিচয় ঘটে। তাহার জন্য একটু প্রার্থনা করিও, আর যাহাই হোক, যেন তাহার মতো এমন করিয়া কাহারও মৃত্যু না ঘটে। মরণে ক্ষতি নাই, কিন্তু সে সময়ে যেন একটি স্নেহ-করস্পর্শ তাহার ললাটে পৌঁছে; যেন একটিও করুণাদ্র স্নেহময় মুখ দেখিতে দেখিতে এ জীবনের অন্ত হয়। মরিবার সময় যেন কাহারও এক ফোঁটা চোখের জল দেখিয়া সে মরিতে পারে।’
আমাদের হৃদয় দুঃখে ভরে যায়। এভাবে চিরকালীন হৃদয় নিংড়ে নেওয়া সাহিত্য এবং চলচ্চিত্র গণমাধ্যমও একই সারিতে এসে দাঁড়ায়। সাহিত্যের ভাষা, সাহিত্যের সংলাপও চোখের সামনে অপরূপ ডানা মেলে সুদূরপ্রসারী বৃক্ষ হয়ে ওঠে। ‘আহা এমন করে কেউ মরে? এখন এই মরাটাকে ছোবেই বা কে? কি জাত তাই তো জানিনে’, ‘যেন পূর্ব জন্মের মাটি কেনা ছিল তাই মরতে এসেছে..’। মানুষের মুখের এসব সংলাপের মধ্যে দিয়ে তৎকালীন সমাজজীবন, জাতপাত ভেদাভেদ, কুসংস্কার—এসবেরও পরিচয় মেলে। পার্বতীর দুয়ারে এসে মৃত্যু হয় দেবদাসের। পরিচয় মেলে কাব্যের, যেখানে জীবন–মৃত্যুর, ভালোবাসা আর সম্পর্কের খুঁটি বাঁধা আছে।
চলচ্চিত্রে আরও অভিনয় করেছেন গোলাম মুস্তাফা, প্রবীর মিত্র, এ টি এম শামসুজ্জামান, সুমিতা দেবী, রহমান, আরিফুল হক, আমির আলী, রাণী সরকার, অমিতা বসু, ডলি সরকার, সুচেতা মালিয়াসহ অনেকে। চাষী নজরুল ইসলাম পরবর্তী সময়ে ‘দেবদাস’কে রঙিন করে নতুন চরিত্র নিয়ে আবার নির্মাণ করেছিলেন। সেই চলচ্চিত্রটিও বেশ ভালো হয়েছে। পুরোনো সাদা কালো চলচ্চিত্রের আবেদনও কখনো ফুরোনোর নয়।
হাওড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত