সকাল আটটার সময় মামা এসে অন্তরকে ঘুম থেকে ডেকে তুললেন। অনেক দিন পরে মামাকে দেখে কিছুটা চমকে গেল। চোখ কচলাতে কচলাতে বলল, ‘মামা, কেমন আছ?’
‘ভালো নেই রে।’
‘কেন, কী হয়েছে?’
‘তোর মামির সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে।’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘তোর অবস্থা কী? পড়ালেখা চলছে ঠিকঠাক?’
‘হ্যাঁ, মামা, চলছে। বাইরে দাঁড়িয়ে আছ কেন, ঘরে আসো।’
মামা ঘরে ঢুকে খাটের এক পাশে রাখা প্লাস্টিকের টুলটাতে বসতে বসতে বললেন, ‘কয়টা বাজে, এখনো ঘুমাচ্ছিলি?’
‘আজ শুক্রবার ছুটির দিন, তাই ঘুমাচ্ছিলাম। সকালে কিছু খেয়েছ?’
‘হ্যাঁ। আগের মতো আর রুচি নেই। মনে চাইলে দু–এক বেলা খাই।’
‘তোমার সুতার ব্যবসা কেমন চলছে?’
‘বেচাকেনা কম। চলে না রে। এই টাকায় সংসার চলে না।’
‘নীলা আর মিলা কেমন আছে?’
‘আছে কোনোরকম! তোর মামি ওদের কড়া নজরদারিতে রাখে। যেন সে গোয়েন্দা সেজে বসে আছে। ওর ধারণা, নীলা মাঝেমধ্যে তোর সঙ্গে দেখা করতে আসে। তুই ভুলেও আমার বাসায় যাবি না। গেলে ওর ধারণা পাকাপোক্ত হবে। যা-তা আচরণ করার সম্ভাবনা আছে।’
মামা শুকনা মুখে এসব কথা শুনিয়ে যাচ্ছে দেখে অন্তর ভ্যাবাচেকা খেয়ে তাকিয়ে রইল। এসব কথা শুনতে ভারি অস্বস্তি লাগে।
‘তোর কাছে আসছি শান্তিতে একটু ঘুমানোর জন্য। অসুবিধা হবে না তো?’
‘না না। অসুবিধা হবে কেন?’
মামা পাতলা একটা কাঁথা নিয়ে পা থেকে মাথা অবধি ঢেকে শুয়ে পড়লেন।
তিনি অত্যন্ত ভালো মানুষ। কারও মনে কষ্ট দিতে চান না। কিন্তু এ কী হাল! যারা অন্যের মনে কষ্ট দিতে জানে না, তারা বেশির ভাগ সময়ই অসুখী হয়। সংসারধর্ম পালনে ব্যর্থ না হলেও লাঞ্ছনার বোধ হয় শেষ থাকে না।
জোহরের আজান হয়েছে সাড়ে ১২টায়। অন্তর গোসল শেষ করে কালো পাঞ্জাবি আর সাদা পায়জামা পরল। শরীরে সুগন্ধি মাখাল। কালো পাঞ্জাবিতে ওকে দারুণ মানিয়েছে। সাদা রঙের টুপিটা মাথায় দিয়ে ঘর থেকে বের হচ্ছিল, এমন সময় আদ্রিতা দরজার মাঝখানে এসে দাঁড়াল। দরজার দুদিকে দুহাত ঠেলে ধরে দাঁড়িয়ে অন্তরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনাকে যা লাগছে না!’
এই প্রথম অন্তরের কিছুটা লজ্জা লাগছিল। লজ্জা কাটিয়ে সে বলল, ‘ধন্যবাদ আপনাকে।’
‘আপনি বয়সে আমার চেয়ে বড়। সে হিসেবে আমাকে তুমি করে বলাটাই বেটার।’
‘তা অবশ্য ঠিক।’
কাঁথা গায়ে দিয়ে জড়সড় হয়ে শুয়ে থাকা মানুষটার দিকে তাকিয়ে আদ্রিতার চোখ কপালে উঠল। তারপর চেঁচিয়ে বলল, ‘ছি ছি! আপনি এত নোংরা মনের মানুষ? আবার সেজেগুজে যাচ্ছেন নামাজ পড়তে?’
অন্তর বিব্রত হয়ে বলল, ‘কেন, হয়েছেটা কী?’
আদ্রিতা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, ‘এটা কে? স্ট্রিটগার্ল এনেছেন বাসায়? আপনার লজ্জা করে না? ভেবেছিলাম আপনি ভালো মানুষ। এই তার নমুনা?’
‘এত চেঁচাচ্ছেন কেন? আগে আমার কথাটা তো শুনুন।’
‘কী শুনব?’
দুজনের চেঁচামেচিতে মামা কাঁথা ছেড়ে উঠে বসলেন। চোখে বিস্ময়। আতঙ্কিত গলায় বললেন, ‘কী হয়েছে রে ভাইগ্না?’
আদ্রিতা নিজের ধারণার সবটাই যখন মিথ্যা বলে জানল, তখন সে–ও কিছুটা চমকে তাকিয়ে রইল। প্রথমে ভীষণ খেপেছিল। মামাকে দেখে কী বলবে তা বুঝতে পারল না। কয়েকবার ‘সরি’ বলে সেখান থেকে দ্রুত পালাল। মামা কিছু বুঝতে না পেরে বললেন, ‘মেয়েটা কে রে?’
‘এই বাড়ির বড় মেয়ে।’
‘নাম কী?’
‘আদ্রিতা।’
‘আদ্রিতা?’
‘হ্যাঁ। আমি নামাজে যাচ্ছি। তুমি গোসল সেরে নাও। নামাজে যাবে না?’
‘যাব তো।’
‘তাহলে বসে আছ কেন? লুঙ্গি, গামছা, সাবান; সবই আছে। আমার একটা শার্ট পরে নিয়ো।’
মামা বিছানা থেকে নামতে নামতে বললেন, ‘আচ্ছা তুই যা, আমি আসছি।’
মামার রোজগার তেমন বেশি না হলেও ফ্ল্যাট নিয়ে থাকেন। মামি জরাজীর্ণ বাসা একদম পছন্দ করেন না। অল্প আয়ে সবকিছু আবার ঠিকঠাকমতো চালাতে জানেন।
বেলা আড়াইটার দিকে খাবার এল। মামা আর অন্তর ভাগাভাগি করে খেল। আজ অবশ্য অন্যদিনের তুলনায় খাবার একটু বেশিই ছিল। একজনের হাতের রান্না একাধারে বেশি দিন ভালো লাগে না। মামা আজ আরাম করে খেলেন। খেতে খেতে বললেন, ‘তোর মামির হাতের রান্না আর খাওয়া যায় না।’
অন্তর না হেসে পারল না। মামা বেশ রসিয়ে কথা বলতে জানেন। তার ভাষ্যমতে আজকের খাবার যে রান্না করেছে, তার হাতে নিশ্চয়ই জাদু আছে। নয়তো এত ভালো রান্না করতে কতজনই-বা জানে! অন্তরের ভাগ্য নাকি সুপ্রসন্ন।
মামার এসব কথা শুনতে অন্তরের যেমন ভালো লাগছিল, তেমনই মায়ের কথা মনে করে খারাপও লাগছিল। দারিদ্র্য পরিবারে অতিকষ্টে দিনযাপন। কত দিন হলো বাড়ি যায় না। বাবা হয়তো অনেকটা বদলে গেছে। মানুষ কি চিরকাল একই স্বভাবের থাকে? আর ছোট বোনটা কাছে থাকলে কতই-না আবদার করত। ওর কোনো শখই মেটাতে না পারার আক্ষেপ থেকে যায় সব সময়। মাস শেষ হয়, বছর পেরিয়ে যায় অথচ সময়ের নাগাল পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। চার বছর মেয়াদি অনার্স কোর্স ছয় বছরেও শেষ হবে না বোধ হয়। এত সময় ব্যয় করে অনার্স করার পর কী হবে? মাস্টার্স করা হবে? নাকি চাকরির পেছনে ছুটতে হবে? নিজের আসন্ন ভবিষ্যতের কথা ভাবলে কখনো কখনো ঘোর সংশয় জাগে। অজান্তেই মন খারাপ হয়। এভাবেই কি স্বপ্নগুলো পিছিয়ে পড়ে?
মামা ডাকলেন, ‘অন্তর!’
ওর হাতের গ্লাসটা কেঁপে ওঠল। তারপর মামার দিকে একপলক তাকিয়ে আবার নিচের দিকে তাকিয়ে রইল সে।
মামা সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, ‘মন খারাপ নাকি তোর?’
‘না।’
‘তোরে এখন আমার বাসায় নিয়া যাওয়ার কথা ভাবছি। রাতে একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া করবি। আলাদা একটা ঘর আছে; দেখবি আজ রাতে তোর সঙ্গে কথা বলতে বলতে রাত কাবার।’
সকালে মামার অকপটে বলা শব্দগুলো অন্তরের বেশ মনে আছে। সে কথা ভেবে ও মাথা নেড়ে বলল, ‘না, মামা।’
‘কেন, কোনো সমস্যা?’
‘সমস্যার কথা তো তুমিই বলেছিলে।’
‘দুরু বেডা! আমার সংসারে আমিই রাজা। তুই আয় আমার সঙ্গে।’ তারপর জানালার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আকাশে মেঘ জমছে, দিন অন্ধকার লাগছে। বৃষ্টি আসতে পারে। তাড়াতাড়ি আয়।’
অনিচ্ছা সত্ত্বেও অন্তর চলল মামার বাসায়। অটোরিকশা করে পৌরসভার সামনে পৌঁছাতেই ঝুম বৃষ্টি নামল। বাতাসের ঝাপটায় বৃষ্টিতে দুজনেই ভিজে যেতে লাগল।
মামার রোজগার তেমন বেশি না হলেও ফ্ল্যাট নিয়ে থাকেন। মামি জরাজীর্ণ বাসা একদম পছন্দ করেন না। অল্প আয়ে সবকিছু আবার ঠিকঠাকমতো চালাতে জানেন। মাঝেমধ্যে বাড়াবাড়ি রকমের ঝগড়া হয়।
কলিং বেল চাপতেই মামি দরজা খুলে দিলেন। অন্তর অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলল, ‘আসসালামু আলাইকুম। ভালো আছেন?’
‘এত দিন পরে মামির কথা মনে পড়ল? ভালোই হয়েছে এসেছ। বৃষ্টিতে তো একদম ভিজে গেছ দেখছি। এসো, গা-হাত-পা মুছে নাও।’
১০ বছরের মিলা ‘ভাইয়া এসেছে’ বলে দুহাতে তালি বাজাতে লাগল। তারপর বড় বোন নীলাকে খবরটা দিতে সে ছুটে গেল। সব দেখে মামার চোখ-মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
চলবে...
বন্ধু, ভৈরব বন্ধুসভা